মাধবী নিশীথিনী (শেষ পর্ব)
মাধবী নিশীথিনী (শেষ পর্ব)
কুপির আবছা আলোয় দেখে, কুচকুচে কালো কারুকার্যময় পালঙ্কে রক্তিম মখমলের বিছানায় শায়িত এক নারী। গোটা শরীর ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা। শুধু মুখ অনাবৃত। যেন একটি মমের শব। গোটা মুখে হীরকের ঔজ্জ্বল্য। যেন মমির দেশের কোনো রাণীকে মমি করে রাখা হয়েছে। শাওনের ছুটে পালানোর কথা। কিন্তু সে সম্মোহিতের মতো পালঙ্কের দিকে এগিয়ে যায়। তার দৃষ্টি শবের মুখমণ্ডলে নিবদ্ধ। দৃষ্টি ফেরানোর ক্ষমতা যেন হারিয়ে গেছে। ভীষণ চেনা এই মুখ, বড় আপন! কে ইনি?
“শাওন, এসেছিস?”
শবের ঠোঁট মৃদু নড়ে ওঠে। তিনি অতি ক্ষীণ স্বরে ফিসফিস করে বলেন।
রুদ্র শাওন কেঁপে ওঠে। ছিটকে সরে যায়। সে গভীরভাবে তাকিয়ে শায়িত নারীর বুকের মৃদু ওঠা নামা লক্ষ্য করে। শায়িত নারী কম্পমান হাত বাড়িয়ে শাওনকে কাছে ডাকেন। শাওন ছুটে গিয়ে তাঁর অস্থির হাতটি দুহাতে জড়িয়ে ধরে।
“কে তুমি? আমায় চেনো কী করে?”
“সে অনেক কথা। অত কথা বলার শক্তি আমার নেই। মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে আজও আমি বেঁচে আছি শুধু তোর অপেক্ষায়!’
“তুমি কে? বলো আমায়।”
“আমি কে? তোর দিদাকে জিজ্ঞেস করিস। আমি জানি, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি এখনো বেঁচে আছেন। শাওন, আমার সময় বড় কম। যে শুভক্ষণটি দেখার জন্য, যে দায়িত্বটি পালন করতে এই মাটির শবে এখনো প্রাণটি টিকে আছে, সেটি আমায় করে যেতে হবে।”
আরও পড়ুন গল্প ঊর্মিমালা
মুমূর্ষু নারীর দুচোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
“কী সেটি?”
শাওন মাতৃসমা বিধুর নারীর হাত ধরে তাঁর শিয়রে হতভম্বের মতো বসে থাকে।
মৃতপ্রায় নারী শীর্ণ হাতের ইশারায় কাকে যেন ডাকেন। গাঢ় কৃষ্ণ অন্ধকার ভেদ করে শ্বেত বসনা সেই অপূর্ব রূপতরুণী বেরিয়ে আসে। মৃদুপায়ে হেঁটে পালঙ্কের পাশে এসে দাঁড়ায়।
রুদ্র শাওন চমকে ওঠে। তার মনে হয়, দুহাতে মেঘ কেটে আঁধার সরিয়ে চাঁদের দেশ হতে এইমাত্র মর্তে নেমে এল চন্দ্ৰকন্যা মাধবী নিশীথিনী। তার আলতো পায়ে নূপুরের মৃদু ঝঙ্কার। চন্দ্রকন্যার মুখে ঈষৎ হাসি। সে বাঁকা চোখে শাওনের দিকে তাকায়। শাওন কেঁপে ওঠে। খুব চেনা ভঙ্গি; অতি আপন কেউ! বহুকাল আগের স্মৃতির উঠোনে অস্পষ্ট একটি মুখ ভেসে ওঠে। সেই মুখের সঙ্গে এই তরুণীর মুখের কী আশ্চর্য মিল! কিন্তু কে এই তরুণী? শাওনের মাথার মধ্যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়।
মৃতকল্প নারী তাঁর অস্থির আন্দোলিত হাতে তরুণীর হাত শাওনের হাতে তুলে দিয়ে বলেন,
“শাওন, তূর্ণা তোর। তোরা আজন্ত পরস্পরের। মাতৃপিতৃহীন এই মেয়েটি কতকাল তোর অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে! সেই পুতুল খেলার বয়স থেকেই ও তোর। ওর মায়ের প্রবল ইচ্ছেয় আমি এবং আমার স্বামী দুবছরের তূর্ণাকে তোর হাতে সমর্পণ করেছিলাম। তোর বয়স তখন তিন কি চার। তোরা একসঙ্গে পুতুল খেলতি। তোর বাবা তোকে লুকিয়ে আমার কাছে দিয়ে যেত। ওর মামা মানে আমার স্বামী মারা যাবার পর ওকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ও পড়াশুনা করে। এবার এইচএস পাস করল। ছুটিছাটায় ও মামির কাছে ছুটে আসে । মামিকে মার চেয়ে একটুও কম ভালোবাসে না। অভাগী মেয়েটির মার আদর পাওয়া হয়নি। আমিই ওকে মাতৃস্নেহে বড় করেছি। ওর বয়স যখন ষোলো, ওকে সমস্ত কিছু খুলে বলি। ও তোকে পাগলিনীর মতো ভালোবাসে। ওর বিশ্বাস ছিল, তুই নিশ্চয়ই একদিন ওর কাছে আসবি। বিশ্বাস আমারও ছিল। এবার আমি শান্তিতে মরতে পারব।
আরও পড়ুন গল্প বেলীফুলের ঘ্রাণ
শাওন, তূর্ণাকে নিয়ে দিঘির পুব পাড়ে যা। ওখানে তোর বাবা এবং তূর্ণার মা পাশাপাশি শুয়ে আছে। তূর্ণার মার ইচ্ছেনুযায়ী তাকে দাহ না করে সমাধিস্থ করা হয়। তোরা দুজন ওদের সমাধির পাশে দাঁড়ালে ওদের অতৃপ্ত আত্মা শান্তি পাবে। তারপর সোজা বাড়ি গিয়ে তৃণার হাত ধরে দিদার সামনে গিয়ে দাঁড়াবি। আমি জানি, তিনি তোদের দুজনকে বুকে পাবার জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করে আছেন। কারণ, তিনিও এক অভাগী মা।”
মমতাময়ী নারীর মৃদু সঞ্চারিত শীর্ণ হাতখানি হঠাৎ খসে পড়ে। তূর্ণা মাতৃতুল্য মামির বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিলাপ করে কাঁদে। শাওন তূর্ণার মাথায় হাত রাখে। তার চোখে অশ্রু। কাকভোরে রুদ্র শাওন তূর্ণার হাত ধরে দিদার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
অশীতিপর বৃদ্ধা শুধান,
“শাওন এলি? সঙ্গে কে?”
তিনি চোখে ভালো দেখেন না।
“তুমিই বলো কাকে নিয়ে এলাম?”
“দৃষ্টি বড় ঝাপসা রে দাদু!”
বৃদ্ধা তূর্ণার মুখে হাত বুলিয়ে ঠাওর করার চেষ্টা করেন। তাঁর মুখ সহসা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি আনন্দে প্রায় চেচিয়ে ওঠেন—আমার তূর্ণা! আমার দিদিভাই! তিনি ছোঁ মারার মতো করে তূর্ণাকে শাওনের কাছ থেকে নিজের বুকে টেনে নেন। স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করে বলেন,
“তুই এসেছিস দিদিভাই! আমি জানতাম, তোর দেখা আমি পাবো। তাঁর একগুঁয়েমির জন্য সব ছারখার হয়ে গেছে।”
“দিদা, সামন্ত জমিদার বাড়ির সঙ্গে কী সম্পর্ক তোমার?”
“প্রাণের সম্পর্ক দাদুভাই। আমার প্রাণটাই তো ওবাড়ির মাটিতে মিশে আছে! সব হারিয়ে তোকে নিয়ে বেঁচে আছি। এই দিনটির অপেক্ষায় যেন যন্ত্রণাময় সহস্রাব্দ পেরিয়ে এসেছি। তাঁর একগুঁয়েমির জন্য জীবনটাই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে আমার।”
“কিছুই বুঝলাম না দিদা। সমস্তটা শুনতে চাই আমি।”
আরও পড়ুন গল্প একজন কিশোরীর প্রেম
অশীতিপর বৃদ্ধা কিছুক্ষণ হাঁপান। যেন দম ফুরিয়ে গেছে। তাঁর চোখে অশ্রু। তিনি বড় করে শ্বাস নেন। অতঃপর শাওন এবং তূর্ণার হাত ধরেন। যেন শক্তি সঞ্চয় করতে চান। তিনি শাওনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘দাদুভাই, দুটি সন্তান নিয়ে আমি বড় সুখী ছিলাম। অর্থী আর অরব ছিল আমার স্বর্গ। ত্রিশ দশকের প্রথম দিকের কথা। অর্থী কলেজে পড়ে আর অরব ক্লাস এইটে। জমিদার অমূল্য মোহন সামন্তের ছেলে মোহিত মোহন সামস্তের সঙ্গে অর্থীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তোর ফুপি ছিল অতি রূপসী এবং চঞ্চল স্বভাবের। বাবার মতোই একরোখা। তোর দাদু ছিলেন ভীষণই রক্ষণশীল। তিনি কিছুতেই সম্পর্কটি মেনে নিলেন না। সুতরাং যা হবার তাই হলো। অর্থী পিতৃগৃহ ত্যাগ করে মোহিতকে বিয়ে করল। এ বিয়েতে সামন্ত পরিবারের তেমন আপত্তি ছিল না। তোর দাদু মেয়েকে ত্যাজ্য করলেন ।
তোর বাবার সাথে তার দিদির ছিল খুবই ভাব। দুই ভাইবোন একে অপরকে ছাড়া কিছু বুঝত না। অরব এমনিতেই ছিল চুপচাপ ধরনের। দিদি চলে যাবার পর সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকত। আমি ছিলাম নিরুপায়। চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। তবুও সুযোগ পেলেই অরবকে তার দিদির কাছে পাঠাতাম। এভাবে যাতায়াত করতে করতে মোহিত মোহনের একমাত্র ছোট বোন বেলা সামন্তর সঙ্গে অরবের গভীর প্রণয় গড়ে ওঠে। যদিও সামন্ত পরিবার ছিল যথেষ্ট উদার প্রকৃতির, কিন্তু তাঁরা নতুন করে আরেকটি অশান্তির জন্ম দিতে চাননি। কৌশলে বেলাকে কোলকাতায় নিয়ে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়। অরব এলোমেলো হয়ে যায়। সারারাত পাগলের মতো পথে পথে ঘুরত। তুই তোর বাবার সেই স্বভাবটিই পেয়েছিস।
আরও পড়ুন গল্প এখানে স্নিগ্ধ সকাল
তোর দাদু জোর করে ছেলের বিয়ে দেন। কিন্তু ঘরমুখো করতে পারলেন না। সুযোগ পেলেই তোর বাবা সামন্ত বাড়ির দিঘির পুব পাড়ে গিয়ে বসে থাকত। বেলার সাহচর্যের স্মৃতিঘেরা জায়গা।
ইতোমধ্যে তোর জন্ম হলো। তোর বয়স যখন দেড় বছর, তখন বেলা পালিয়ে মামার বাড়ি চলে আসে। সে তখন তিন মাসের গর্ভবতী।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তোর বাবা ভারতে চলে যায়। যাবার সময় আমায় বলে যায়—মা যুদ্ধে গেলাম। যদি ফিরি বেলা এবং স্বাধীনতা নিয়ে ফিরব। যদি না ফিরি, যদি আমার মৃতদেহ পাওয়া যায়, তবে সামন্ত বাড়ির দিঘির পুব পাড়ে আমায় সমাহিত করো।
অরবকে আটকানোর সাধ্য আমার ছিল না। আটকাতে চাইওনি। ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১। মোহিত খবর পায়, কুষ্টিয়ার একটি রণাঙ্গনে তোর বাবা গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হয়েছে। আমি কিছুই জানতাম না।
মোহিত অনেক খুঁজে তোর বাবার মৃতদেহ উদ্ধার করে সামন্তবাড়ির দিঘির পাড়ে তাকে সমাহিত করে।
বেলা তার অতি কাঙ্ক্ষিত প্রিয়জনের মৃত্যু বহন করতে না পেরে শয্যা নেয়। মাস ছয়েকের মাথায় সেও মারা যায়। শত চিকিৎসায়ও কোনো কাজ হয়নি। সে যেন মরবে বলে পণ করেছিল। তোর বাবার কবরের পাশেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
শাওন, মানব মনের প্রবল বাসনার অপমৃত্যু হলে এভাবেই বুঝি সমস্তই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ছেলেকে হারিয়েছি। এক অর্থে মেয়েকেও। অরব বেঁচে থাকতে মাঝে মাঝে লুকিয়েচুরিয়ে অর্থীর কাছে যেতাম। যতক্ষণ থাকতাম, মেয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে থাকত। ছাড়তে চাইত না। কতদিন যাওয়া হয়নি! আমি আর কদিন! তোদের মিলন দেখব বলেই হয়তো তিনি আমায় এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
আরও পড়ুন গল্প কপিশ নয়ন
“দাদাভাই, খুব শীঘ্রই তোরা আমায় একবার অর্থীর কাছে নিয়ে যাবি। আমি আর বেশিদিন টিকব না রে!”
দিদা আঁচলে চোখ মোছেন। শাওন তূর্ণার হাত শক্ত করে ধরে। তার মনে হয়, এই অশীতিপর বৃদ্ধা যেন প্রিয়জনের মৃত্যু যন্ত্রণা পেরনো এক বিয়োগবিধুর আলেখ্য। ওদের দুজনকে পেয়ে এই মুহূর্তে তাঁর মুখ উজ্জ্বল। এই ঔজ্জ্বল্যটুকু গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাক, ওরা চায় না। শাওন কী করে বলবে ফুপিকে তাঁর ভাইয়ের পাশেই শায়িত করে এসেছে! না, সে পারবে না।
আরও পড়ুন মাধবী নিশীথিনী-
১ম পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
মাধবী নিশীথিনী (শেষ পর্ব)