ভাই-বোনদের কথা
ভাই-বোনদের কথা
তাহমিনা খাতুন
আমারা মোট এগারো ভাই-বোন। আমাদের সবার বড় ভাই মরহুম খন্দকার আবু তাহের। আমাদের বড় ভাইকে আমরা ‘মিয়াভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। মিয়া ভাই বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড় ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। গ্রাম থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে, মিয়া ভাই আমাদের গ্রাম থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে ধোবাখোলা করোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন, আমার জন্মেরও আগে! মাত্র ৫ম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া এক বালক নিজ পরিবার ছেড়ে দূর গ্রামের অপরিচিত এক পরিবারে ‘লজিং’ বা ‘জায়গীর’ থেকে লেখা-পড়া চালিয়ে গেলেন। লজিং বা ‘জায়গীর থাকার’ ধারণাটা হয়তো এখন অনেকেরই অপরিচিত।
বৃটিশ ভারতের শেষের দিকের কথা। শহরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা, সেখানে গ্রামের চিত্র তো কল্পনাতীত। তখন হয়তো ১৫/২০ মাইলের দূরত্বে একটি হাই স্কুল। এ কারণে দূরবর্তী গ্রামে কেউ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের অথবা শিক্ষকতার জন্য যেতে বাধ্য হলে তাকে উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিকটস্থ কোন বাড়িতে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হত। বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট বাড়ির ছেলে-মেয়েকে লেখা-পড়ায় সাহায্য করতে হত। এ ব্যবস্থায় উভয় পক্ষই উপকৃত হত। এ ছাড়া দুই পরিবারের মধ্যেও একটি আত্মীক সম্পর্ক তৈরি হত। শুধু মাত্র মিয়া ভাই নন, গ্রামের অনেকেই এভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতেন।
আমার ২য় ভাই খন্দকার শহীদুল্লাহ। আব্বার অসুস্থতার কারণে মেজ ভাই পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হলেও মেজ ভাই ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত মানুষ! নিয়মতান্ত্রিক পড়ালেখার গন্ডীমুক্ত হয়ে মেজ ভাই যেন হয়ে উঠেছিলেন জ্ঞান চর্চার এক মুক্ত মানুষ! জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করার সুযোগ ভালভাবেই কাজে লাগাতেন। এমনকি স্বাস্থ্য বিষয়েও মেজ ভাইয়ের ছিল ব্যাপক লেখাপড়া। এছাড়া সমাজ সচেতন মানুষ হিসাবে, একজন ভাল মানুষ হিসাবে আমাদের গ্রামীণ সমাজে মেজভাই ছিলেন একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।
আরও পড়ুন গল্প সোনালী
আমার তিন নং ভাই মরহুম খন্দকার আবুল খায়ের। ছোট ভাই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে আতাইকুলা হাই স্কুলে ভর্তি হন। বর্তমান সময়ে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে দ্বাড়িয়াপুর থেকে আতাইকূলা যাতায়াত কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে দ্বাড়িয়াপুর থেকে আতাইকূলা গিয়ে প্রতিদিন ক্লাস করা অসম্ভব ছিল। কাজেই ছোট ভাইকে আতাইকূলায় একটি বাড়িতে ‘লজিং’ থেকে লেখা-পড়া চালিয়ে যেতে হয়।
ম্যাট্রিক পাশ করার পরেই ছোট ভাই ঢাকায় চলে আসেন এবং চাকুরীতে যোগ দেন। চাকুরীর পাশাপাশি নৈশ কালীন কলেজে ভর্তি হয়ে নিজের লেখা-পড়া চালিয়ে যান। কেবল নিজের লেখা-পড়াই নয়, আমরা ছোট ভাই-বোনেরা যাতে উচ্চ শিক্ষা লাভ করি, সেদিকেও ছোট ভাই ছিলেন সচেষ্ট। আমাদের শিক্ষার ব্যাপারে ছোট ভাইয়ের অবদান সব সময়ই স্মরণ করতে হবে।
কেবল মাত্র নিজের ভাই বোনদের জন্যই নয়, গ্রামের ছেলে-মেয়েদের বিশেষত মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম করার জন্য নিজে সরকারি চাকুরী ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে যান এবং অক্লান্ত চেষ্টায় গ্রামে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এখন গ্রামের ছেলে-মেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য আর দূর-দুরান্তে ছুটতে হয় না। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে সহজে কলেজে ভর্তি হতে পারছে, উচ্চতর ডিগ্রী গ্রহণ করছে।
কলেজে পড়াকালীন সময়ে ছোটভাই তৎকালীন প্রগতিশীল মুক্ত চিন্তার রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন। ছোট ভাইয়ের আদর্শবাদী মুক্তচিন্তার প্রভাব আমাদের ভাই-বোনদের উপরও প্রতিফলিত হয়।
আরও পড়ুন গল্প অশরীরী আত্মা
পিতা-মাতার চার নং সন্তানটির নাম ছিল হেনা। আমাদের হেনা বু। আমার জন্মের বহু আগেই মাত্র পাঁচ বছর বয়সে হেনা বু বাবা-মার কোল খালি করে, তাঁদেরকে শোক-সাগরে ভাসিয়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আর তাই বুঝি শোক বিহ্বল পিতা-মাতার শোক সন্তপ্ত অন্তরকে কিছুটা প্রশমিত করার জন্য বিধাতা তাঁদের কোলে তুলে দিয়েছিলেন তাঁদের পাঁচ নং সন্তান আয়েশা খাতুন বিনাকে-যাঁকে আমরা তাঁর কনিষ্ঠ ভাই-বোনেরা বড় বু বলে সম্বোধন করি। আমাদের বড় বু কে খুব অল্প বয়সে মায়ের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। বড় বু আমার চেয়ে বছর দশেকের বড়। সম্ভবত আমার জন্মের পর থেকেই শুরু হয়েছিল ছোট ভাই-বোনদের প্রতি তাঁর দায়িত্ব পালন।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বোন মায়ের প্রতিনিধি’ কথাটি যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের বড় বু’র মধ্যে। ছোট বেলা থেকেই প্রচন্ড পরিশ্রমী আমাদের বড় বু। ছোট ভাই-বোনদের যত্ন নেওয়া ছাড়াও মাকে সব সময় সংসারের সব কাজে সাহায্য করতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। লেখা-পড়া, ঘর-গৃহাস্থলির কাজ, রান্না করা, অতিথি আপ্যায়ণ সব খানেই ছিল বড় বু’র সরব পদচারণা। কিন্ত দুঃখের বিষয় এবং তৎকালীন পশ্চাদপদ গ্রামীণ জীবনের রুঢ় বাস্তবতা হলো আমাদের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ছাড়া আশেপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে মেয়েদের জন্য তো দূরে থাক ছেলেদের জন্যও কোন হাই স্কুল ছিল না।
আমার ভাই বোনেরা সবাই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। আমার বড় বোন আয়েশা খাতুন বীনাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করার পর, আশপাশের কয়েক মাইলের মধ্যে হাইস্কুল না থাকায়, লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ হয়নি বড় বু’র। পঁচাত্তরোর্ধ আমার বোনের এখনও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ এবং স্মরণ শক্তি রীতিমত বিস্ময়কর। এই বয়সেও আমার বোনের হাতে সবসময়ই কোন বই বা দৈনিক সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিন! স্বশিক্ষিত মানুষই সুশিক্ষিত-এই আপ্ত বাক্যটির প্রতিফলন ঘটেছিল-আমার ভাই বোনদের মধ্যে। এ কারণে আমার ভাই বোনদের, উচ্চ শিক্ষিত-স্বল্প শিক্ষিত নির্বিশেষে সবাইকে দেখা যায় বইয়ের মধ্যে ডুবে থেকে, জ্ঞান সমুদ্রে ডুব দিয়ে অরুপ রতনের সন্ধান করতে!
আরও পড়ুন গল্প তৃতীয় স্বাক্ষী
আমার তৃতীয় বোন আকলিমা খাতুন রাঙ্গা। আমার এই বোনটিও ছিলেন অসম্ভব মেধাবী এবং লেখা-পড়ায় অসম্ভব মনোযোগী! বই পেলে জগত-সংসার ভুলে জ্ঞান সমুদ্রে ডুব দিতে মেজ বু’র কোন জুড়ি ছিল না, এমনকি এখনও নাই। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ‘প্রাইমারী স্কুল বৃত্তি’ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল এবং ওই পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য পাবনা শহরে যেতে হয়েছিল মেজ বু’কে। আমার স্পষ্ট মনে নাই। শুধু এটা মনে আছে বছর দশেক বয়সের মেজ বু’কে মায়ের একটি তোলা শাড়ি (যে শাড়ি বিশেষ কোন সময়ে পরা হত এবং আমার মায়ের একখানা শাড়িই ছিল। প্রকৃতপক্ষে সহজ সরল গ্রামীণ জীবনে মানুষের উচ্চাভিলাষ বা চাহিদাও ছিল খুবই সীমিত) পরিয়ে দিয়েছিলেন মা।
আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে ছিল নগরবাড়ি-পাবনা সড়ক। সুরকী ঢালা ভাঙ্গা এবরো-থেবরো রাস্তা। সে সময়ের (সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে) ভাঙ্গা এবরো-থেবরো সড়কটি আজ রীতিমতো পাবনা-রাজশাহী-রংপুর-দিনাজপুর হাইওয়ে এবং বাংলাদেশের অনেক গুলি জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটিতে কংক্রিটের সড়কে রুপান্তরিত করা হয়। সেসময়ে ভোর ছয়টা বা সাতটা থেকে এই রাস্তায় চলতো পেট্রোল- চালিত ১৫/২০ জন যাত্রী বহন উপযোগী লক্কড়-ঝক্কর বাস। সেই বাসে পাবনা শহরে পৌঁছাতে সময় কত লাগতো-আমার কোন ধারণা নাই। মেজ বু’কে ওই বাসে পাবনা শহরে যেতে হয়েছিল। সম্ভবত কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল মেজ বু’র।
আরও পড়ুন গল্প কবর
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া দরিদ্র পরিবারের একটি মেয়ে। অতি অল্প বয়সে অনেকগুলি ভাই-বোনের বড় পরিবারে সংসারের দায়িত্ব খানিকটা পালন করা এবং তৎকালীন পশ্চাৎপদ গ্রামীণ সমাজের নারীশিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ ইত্যাদি প্রতিকূলতার মাঝেও প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারাটাই ছিল এক কঠিন পরীক্ষা! কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেজ বু প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার মেধা তালিকায় পাবনা জেলার মেধা তালিকায় ১ম স্থান অধিকার করেন! কিন্তু মেধার কি দুঃখজনক অপচয়! এত অসাধারণ ফলাফলের পরেও আমাদের গ্রামের কয়েক মাইলের মধ্যে হাইস্কুল না থাকায় মেজ বু উচ্চ শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত হন এবং তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার প্রচলিত অভিশাপ ‘বাল্য বিয়ের’ শিকার হন। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এক অসাধারণ মেধার সৃজনশীল সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। আর অসীম সম্ভাবনাময় ভুক্তভোগী মেজ বু বঞ্চিত হন উজ্জ্বল ভবিষ্যত থেকে। অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি অধরাই থেকে গেছে মেজ বু’র কাছে। আর তাই চার দেয়ালের বন্দী জীবনে রান্না ঘরেই কাটছে আমার অসীম প্রতিশ্রুতিশীল বোনের সময়গুলি!
আমার চতুর্থ বোন তসলিমা খাতুন জোসনা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন এবং তাঁকেও যথারীতি বড় দুই বোনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাল্য বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। কেবল মাত্র আমার বোনেরাই নয়, চাচাতো-ফুফাতো বোনদেরও একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। মূলত তৎকালীন গ্রামীণ সমাজের চালচিত্র একই। এখন দ্বাাড়িয়াপুর বা অন্য যে কোনো গ্রামের মেয়েরা দলে দলে স্কুল ফাইনাল শেষ করে কলেজ, কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,কৃষিবিদসহ নিজেদের পছন্দমত যে কোন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে এবং পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে তাদের মেধার অবদান রাখছে!
আরও পড়ুন যাপিত জীবনের কথকতা-
দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আমার বাবা
আমার মা
আমার শিক্ষাজীবন
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো
যেভাবে আইনজীবী হলাম
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
সংসার ও আইনজীবী জীবন
পাশের বাড়ির আপনজন
আমার নানী
প্রথম শহর দেখা ও প্রথম বিদেশ ভ্রমণ
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
ছেলেবেলার ষড়ঋতু
মধুর স্মৃতি
স্নেহশীল কজন
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
ভাই-বোনদের কথা