প্রথম-শহর-দেখা-ও-বিদেশ-ভ্রমণ
আত্মজীবনী,  লেখক পরিচিতি,  সাহিত্য,  স্মৃতিচারণ

প্রথম শহর দেখা ও বিদেশ ভ্রমণ

প্রথম শহর দেখা ও বিদেশ ভ্রমণ

তাহমিনা খাতুন

 

শহর দেখা

সম্ভবত দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় পাবনা শহর দেখতে গিয়েছিলাম মেজ ভগ্নিপতি কাজী মর্তুজা মজিদের (মেজ দুলাভাই) এর সাথে। পেট্রোল চালিত লক্কড়-ঝক্কর বাসে চড়ে পাবনা শহর দেখতে গেলাম। এর আগে কোথাও বেড়াতে যাওয়া বলতে নিজের গ্রাম থেকে ৫/৬ কিলোমিটার দূরে মেজ বোনের শ্বশুর বাড়ি চরগোবিন্দপুর অথবা মাইল দুই/তিন দূরে বড় ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি সৈয়দপুর গ্রামে! আর সে ভ্রমণও ছিল মহিষের বা গরুর গাড়ি অথবা নৌকায় চড়ে।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইঞ্জিন চালিত কোন যানবাহনে প্রথম ভ্রমণ করা! কাজেই বাসে চড়ে সেই প্রথম ভ্রমণ ছিল রীতিমত রোমাঞ্চকর! পাবনা শহরে ভ্রমণ করতে গিয়ে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি এবং বৈদ্যুতিক পাখা দেখে রীতিমত চোখে ধাঁধাঁ লেগে গিয়েছিল! স্নেহশীল মেজ দুলাভাই ছোট্ট পাবনা শহরের বিভিন্ন জায়গা দেখাতে নিয়ে গেলেন। হোটেলে বসিয়ে খাবার খাওয়ালেন, নতুন কাপড় কিনে দিলেন। শান্ত নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে অভ্যস্থ এক গ্রাম্য বালিকার সেই প্রথম শহর ভ্রমণ! প্রথম শহর ভ্রমণের সেই স্মৃতিচারণ মনেকে আজও দারুণ ভাল লাগায় ভরিয়ে তোলে।

আরও পড়ুন শানশি লাইব্রেরি ও মোরগের ডাক

মাঝখানে কয়েক বছরের বিরতিতে আবার পাবনা শহরে যাওয়া হলো, তিন নম্বর বোনের শ্বশুর বাড়ি রাধানগরে। সে সময়ের কিছু স্মৃতি মনে আছে আজও! বোনের ননদ মাতোয়ারা সাকি একদিন নিয়ে গেল ওর স্কুল দেখাতে। পাবনা ‘সেন্ট্রাল গার্লস’ স্কুল! আর দশটি সাধারণ স্কুলের মতই। অতি সাধারণ এই স্কুলই এক সময় ধন্য হয়েছিল এক সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের মহা নায়িকা সুচিত্রা সেনের পদস্পর্শে। মহা নায়িকার জন্মও হয়ছিল পাবনা শহরেই।

কবিতা, গল্প, উপন্যাস রচয়িতা, চিত্রকর, সাংবাদিক ইত্যাদি বহু গুণের অধিকারী কবি বন্দে আলী মিয়ার বসত বাড়িও রাধানগরে‌। আমার বোনের শ্বশুর বাড়ির খুব কাছেই ছিল। সাহিত্য, শিল্পকলা, সাংবাদিকতায় যিনি বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁর বাড়িটি যাদুঘরের মর্যাদা দিয়ে তাঁর সৃষ্টিগুলোকে সংরক্ষণ করা হলেই তাঁর প্রতি যথার্থ সন্মান প্রদর্শন করা হবে।

 

বিদেশ ভ্রমণ

সব মানুষেরই সাধ বা আকাঙ্খা জাগে জীবনে একবার পাখীর মতো আকাশে ওড়ার। আর সেই সাধ থেকেই ‘রাইট’ ভাইদের মাথায় আকাশে ওড়ার চিন্তা মাথায় এসেছিল এবং বিমান তৈরিতে তাঁরা সফল হয়েছিলেন। তাদের আগেও অনেকে দুঃসাহসী হয়ে গ্যাস বেলুনে অথবা গ্লাইডারে চড়ে আকাশে ওড়ার চেষ্টা করেছিলেন। বিফল হয়ে জীবনও দিয়েছেন কেউ কেউ! এমনকি আজকের এই সময়ে এসেও যারা বিমান ভ্রমণ করতে পারেননি, তাঁরাও স্বপ্ন দেখেন বিমান ভ্রমণের। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।

আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী ঘুরে এলাম পর্তুগাল

কাজেই প্রথম বিমান ভ্রমণের স্মৃতি মনে থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। ১৯৯৫ সালে আমার ভাই বাসার ও ওর পরিবারের সাথে আমি আর আমার ছেলে সুহৃদ সুন্দরবন বেড়াতে গেলাম। সুন্দরবন থেকে ফেরার পথে যশোর এবং বাগেরহাট বেড়ালাম। যশোর থেকে ঢাকা ফিরলাম বাংলাদেশ বিমানে। মাত্র সতের মিনিটের ছিল সে বিমান ভ্রমণ! তবে প্রথম বিমান ভ্রমণের আগে যেমন উচ্ছ্বাস এবং আগ্রহ অনুভব করতাম, স্বল্প সময়ের প্রথম বিমানে ভ্রমণ করার পর, আমার তখনও মনে হয়েছিল এবং এখনও ১৭/১৮ ঘণ্টার বা তারও বেশী সময়ের দূরত্বের বিমান ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় মনে হয়, বিমান ভ্রমণের মত একঘেয়ে, বিরক্তিকর ক্লান্তিকর ভ্রমণ আর কোন যানে হয় না।

কোলকাতার মানুষ টানা রিক্সা বা টাঙ্গা থেকে শুরু করে বাস, ট্রাক, ট্রেন, ট্রাম, স্টীমার, লঞ্চ, নৌকা,স্পীড বোট অথবা গরু, মহিষ, ঘোড়া, উট টানা গাড়ি,ভ্যান, রিক্সা সব কিছুতেই তো চড়া হল! এমনকি ডিজনী ল্যান্ডের থিম পার্কে বেড়াতে গিয়ে স্পেস শীপ বা রকেটে চড়ে মঙ্গল গ্রহেও ঘুরে এলাম! আর সে তো ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চকর, ভীতি জাগানিয়া গতির! কিন্তু একমাত্র বিমান ভ্রমণই মনে হয় গতিহীন, রোমাঞ্চহীন, একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। দূর যাত্রার বিমান ভ্রমণ হলেতো কথাই নাই! আমার সাথে অনেকে হয়তো একমত হবেন না। কিন্তু বিমান ভ্রমণের ব্যাপারে আমার অনুভূতি এরকমই!

বিদেশ ভ্রমণের বেলাতেও একই ধরনের অনুভূতি বেশীর ভাগ মানুষের হয় বলে আমার বিশ্বাস। প্রথম বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলাম ‘পাহাড়ি সৌন্দর্যের রাণী দার্জিলিং’ ভ্রমণের মাধ্যমে! তবে বিমান ভ্রমণ আর বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনুভূতি সম্পূর্ণই আলাদা! বিদেশ ভ্রমণ অর্থ ভিন্ন দেশ, ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন প্রকৃতি, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন আবহাওয়ার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ, মনের জানালা অবারিত করে দেওয়ার হাতছানি! আর সে হাতছানি উপেক্ষা করা সত্যিই কঠিন! পরবর্তীতে বহু দেশ ভ্রমণের, অনেক কিছু দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু প্রথম বিদেশ যাত্রার সে আনন্দ, উচ্ছ্বাস, ভাল লাগার সে অনুভূতি ভাষায় অবর্ণনীয়!

আরও পড়ুন যাপিত জীবনের কথকতা-  
দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আত্রাই নদী 
আমার বাবা
আমার মা
ভাই-বোনদের কথা
আমার শিক্ষাজীবন
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো 
যেভাবে আইনজীবী হলাম
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
সংসার ও আইনজীবী জীবন
পাশের বাড়ির আপনজন
আমার নানী
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
ছেলেবেলার ষড়ঋতু  
মধুর স্মৃতি
স্নেহশীল কজন
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

প্রথম শহর দেখা ও বিদেশ ভ্রমণ

Facebook Comments Box

তাহমিনা খাতুন একজন বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। তিনি ছড়া, কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি এবং নারীর অধিকার নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। পেশায় তিনি একজন আইনজীবী। তার পেশাগত জীবনে তিনি নারীদের আইনি সহায়তা প্রদান এবং তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করতেন। তাহমিনা খাতুন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের দ্বারিয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও কৈশোর কাটে এই গ্রামেই।

error: Content is protected !!