পক্ষিরাজের-ডানা-শেষ-পর্ব
গল্প,  সাইফুর রহমান,  সাহিত্য

পক্ষিরাজের ডানা (শেষ পর্ব)

পক্ষিরাজের ডানা (শেষ পর্ব)

সাইফুর রহমান

 

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে জ্বর উঠলো জানে আলমের শরীরে। রাত যত গভীর হতে লাগলো, জ্বরও ততটাই প্রকট আকার ধারণ করতে লাগলো। সকাল বেলা দেখা গেল জ্বরের প্রকোপে জানে আলম সজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। মাজেদ শেখ ছেলের শরীরে হাত দিয়ে দেখলেন ভয়ানক তাপে শরীর যেন একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এই উত্তাপে খৈ, মুড়ি ভেজে নেওয়া যায় অনায়াসে। পাশ থেকে জুলেখা বিবি মাজেদ শেখকে উদ্দেশ্য করে আর্তনাদ করে বললেন,
_দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া তামশা না দেইখে টপ কইরে ডাক্তার ডাইকে নিয়ে আসেন। জ্বরে ছেলেডার সারা শরীর পুইড়ে যাচ্ছে।
মাজেদ শেখ ছুটলেন ডাক্তারের খোঁজে। হাতেম আলী পাশ করা ডাক্তার না হলেও তার হাত যশ বেশ ভাল। বিপদ আপদে গ্রামের লোকজন তার স্মরণাপন্নই প্রথমে হয়। জানে আলমের নাড়ি পরীক্ষা করে অসুখের সমস্ত বৃত্তান্ত দেখে ঔষধ-পত্র দিলেন হাতেম ডাক্তার। সঙ্গে এও বললেন,
_চিন্তার কিছু নাই। নাড়িতে ঠিকমত ঔষধ পড়লেই জানে আলম সেরে উঠবে দ্রুত।
পাঁচ সাত দিন কেটে গেলেও জ্বর নামার কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হলো না। উপরন্তু অবস্থা আরো খারাপের দিকে এগুলো।

আরও পড়ুন গল্প বাক্স বন্দি প্রেম

গ্রামের সবাই মাজেদ শেখকে বুদ্ধি পরামর্শ দিলো, পাবনা সদর নয়তো ঢাকার বড় কোন হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে জানে আলমের চিকিৎসা করাতে। মাজেদ শেখের মাথায় কিছুই যেন আর খেলছে না। কি করবেন তিনি। মনে মনে ভাবলেন নাহ আর দেরি করা চলে না। ঢাকাতেই তিনি নিয়ে যাবেন ছেলেকে। বড় কোন ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাবেন সেখানে।
যথা শীঘ্র জানে আলমকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে লাগলেন মাজেদ শেখ। প্রতিদিনই একবার পালা করে দেখতে আসে হাতেম ডাক্তার। প্রতিবারই ভিজিট নেন দু’শত টাকা। আর বললেন,
_এইবার যে ঔষধ দিয়েছি এর নাম হলো এন্টিবায়োটিক। এবার জ্বর বাপ বাপ করে পালাবে।
কিন্তু জ্বর বাপ বাপ করাতো দূরের কথা, কিঞ্চিৎ পরিমাণ জ্বরও কমার কোন লক্ষণ দেখা যায় না।
রাতে মনে হয় জানে আলমের জ্বর আরও একটু বাড়লো। পানি খেতে চাইলো মায়ের কাছে একবার। জুলেখা বিবি ঘরের কোণে মাটির অলিঞ্জর থেকে গেলাসে করে ছেলের মুখে পানি একটু তুলে দিলেন বটে কিন্তু সে পানি খেতে পারলো না জানে আলম। কাশি উঠে মুখ থেকে প্রায় সমস্ত পানি গড়িয়ে পড়ে গেল বিছানায়। সাথে ঈষৎ রক্তও গড়িয়ে পড়ল মুখের কষ বেয়ে। এরপর পরই জানে আলম একেবারে চিরদিনের জন্য শান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ল বিছানায়। আর চোখ খুলল না। সবকিছু যেন শেষ হয়ে গেল নিমিষে।

আরও পড়ুন গল্প সুরেন বাবু

মাজেদ শেখ ঘুমিয়ে ছিলেন। আর জুলেখা বিবি ছেলের শিয়রের পাশে বসে থেকেও কিছু বুঝলেন না। ভাবলেন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলে। সকালে হাতেম ডাক্তারকে ডাকা হলে তিনিই প্রথম মৃত্যুর সংবাদটি দিলেন। জানে আলম এ দুনিয়াতে আর নেই। শুধু দেহটি পড়ে আছে বিছানায়। হাতেম ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন। কিন্তু এবারই কোন ভিজিট নিলেন না। আর জানে আলম যে পুনরায় সুস্থ হয়ে আবার উঠে দাঁড়াবে সেরকম কোন আশার বাণীও শোনালেন না। শুধু সার্টিফিকেটটি বিছানায় রেখে সটকে পড়লেন সবার অজান্তে।

জুলেখা বিবি কান্নাকাটি করে উঠোনে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। মাজেদ শেখ শোকে পাথর। বোনদের চোখে মুখে ক্রমাগত আহাজারি। শুধু ছোট ভাই রঞ্জু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে।

হেড মাষ্টার আবুল কাশেমের কাছে জানে আলমের মৃত্যুর সংবাদটি যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। এ কী করে সম্ভব বেত্রাঘাতে জ্বর এরপর একেবারে মৃত্যু! এতো অবিশ্বাস্য! যা কিছু ঘটুক এটিই আজ সত্য যে জানে আলম আর এ দুনিয়াতে নেই। কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না আবুল কাশেম। তার কী মরা বাড়িতে যাওয়া উচিৎ? নাকি আবার অপ্রীতিকর কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। নানা সাত পাঁচ ভেবে শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন অবশ্যই যাবেন তিনি। না গেলে সমাজে এ নিয়ে কথা রটবে। নিন্দে মন্দ করবে লোকে। তিনি তো আর হত্যার উদ্দেশ্যে প্রহার করেননি জানে আলমকে। তাছাড়া মাজেদ শেখেরও এ বিষয়টি নিশ্চয়ই জানা আছে যে তার ছেলের কত বড় হিতৈষী ছিলো সে।

আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা

মরা বাড়িতে যা হয়, চারদিকে কান্নার রোল। জানে আলমদের বাড়ি পৌঁছে সেখানে আবসার শেখকে দেখে আবুল কাশেম কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। আবসার শেখ পন্ডিত প্রবর ব্যক্তি। সেই সঙ্গে জানে আলমদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। গ্রামের সবাই তাকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে। তার পাশে গিয়ে বসলেন আবুল কাশেম। আবসার শেখ আবুল কাশেমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
_এটা তুমি কী কাজ করলে কাশেম? ছোট ছেলেমেয়েদের এভাবে কেউ পেটায়?
_কিন্তু আমার কী করার ছিলো আবসার ভাই? জানে আলমের মুখ থেকে মিথ্যা কথা শুনে ভয়ানক রাগ চেপে গিয়েছিল মাথায়। নিজেকে আর সংবরণ করতে পারিনি। জীবনে কত ছাত্রকে পিটিয়ে মানুষ করেছি, কোন দিন কেউ অসুস্থ হয় নাই কিংবা কোন অভিযোগও আসে নাই। ছাত্রছাত্রীর মা-বাপেরা বরং খুশীই হয়েছে। লেখাপড়ার জন্য ছেলে-মেয়েদের শাসন করেছি বলে। অথচ আজ এমন একটি কাণ্ড ঘটে গেল। নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছি না আবসার ভাই। কাজটি যে খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে সেটা এখন আমি বেশ বুঝতে পারছি।
_আমি সবই শুনেছি। শোন কাশেম একটা কথা বলি, পৃথিবীতে অনেক কিসিমের মানুষ থাকে। জানে আলম হয়তো একটু বাড়িয়ে কিংবা অতিরঞ্জন করে অনেক সময় ভিন্ন রকম কিছু বলতো। তার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো আমাদের চেয়ে অন্যরকম। তার মানে এই নয় যে, সে মিথ্যা বলছে। জানে আলম তোমাকে বলেছে, ওর একটা লাল রঙের ভাই হয়েছে। এর পেছনের কারণটা কি তুমি জানো?

আরও পড়ুন গল্প বিষফুল

আবুল কাশেম মাথা নেড়ে বলে,
_না, জানি না।
_বছর দেড়েক পূর্বে জানে আলমের একটি ভাই জন্মে। শারীরিক নানা জটিলতার কারণে শিশুটির জন্ম হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের দু’মাস পূর্বে। জন্মানোর পর নবজাতকের সমস্ত শরীরে রক্তে লেগে লাল হয়েছিল। এই জন্যে জানে আলম তোমাকে বলেছে যে, তার একটি লাল রঙের ভাই হয়েছে। কিন্তু তুমি ভুল বুঝেছ আবুল কাশেম।
_কিন্তু সাত আট মাস আগে যে জানে আলম একদিন আমাকে বলল,
_ওর একটি নীল রঙের ভাই হয়েছে। সেটা কিভাবে সম্ভব?
_আরে বেওকুফ তখন যে শিশুটি জন্মে ছিল তার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা ছিল। এক দিনের বাচ্চা ঠিকমত নিঃশ্বাস নিতে পারছিলো না বলে, ব্যথায় শিশুটির সমস্ত শরীর নীল রং ধারণ করেছিল। সে জন্যই তো ক্লাসে তোমাদেরকে জানে আলম বলেছিলো যে, ওর নীল রঙের একটি ভাই হয়েছে। দু’টি ভাইয়ের একটিও তো বাঁচলো না।
এসব শুনে আবুল কাশেম নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইল চেয়ারটিতে। তার আশে পাশে কী ঘটছে, সেসব কিছুর এক বিন্দুও তার কর্ণগোচরিভূত হলো না।

আরও পড়ুন পক্ষিরাজের ডানা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

পক্ষিরাজের ডানা (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

সাইফুর রহমান মূলত একজন গল্পকার। মানবজীবনের বৈপরীত্য ও মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখিতা তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। প্রকাশিত নিবন্ধনগ্রন্থ: জানা বিষয় অজানা কথা, যুক্তি তর্ক ও গল্প, ভিঞ্চির কালো জুতো, করোনায় শেক্সপিয়র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য; গল্পগ্রন্থ: শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যান ও অন্যান্য গল্প, পক্ষিরাজের ডানা, মরিচপোড়া। তিনি ১৯৭৭ সালের ১২ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!