নতুন সূর্যের অপেক্ষায় (১ম পর্ব)
নতুন সূর্যের অপেক্ষায় (১ম পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
শীতের বিকেল। একটা দামী পাজেরা গাড়ি এসে থামলো কাজী বাড়ির আঙ্গিনায়। কাজী বাড়ির সামনে দিয়ে ডিস্ট্রিক বোর্ডের পুরাতন রাস্তাটা বাজারের দিকে আঁকাবাঁকা হয়ে চলে গিয়েছে। রাস্তার উত্তর পাশে কাজীদের সেই আমলের পাকা দালান ওয়ালা একতলায় বেশ কটা রুম বিশিষ্ট একটা পুরাতন বাড়ি। এটাই তাদের জমিদারী আর আভিজাত্যের উত্তরসূরী। বাড়িটি বয়স কত কেউ তা অনুমান করে বলতে পারে না। গ্রামের সবচেয়ে বায়োজ্যেষ্ঠ প্রবীণ রহমত শেখের ভাষ্যানুযায়ী, বাড়িটির বয়স একশত বছরের উপরে। দুই পুরুষ পর্যন্ত এ বাড়িতে বসবাস করার পর পরবর্তী পুরুষ শহরবাসী। কাজী একারামুল্লাহ এই বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা। তার নামানুসারে সবাই কাজী বাড়ি বলে থাকে। এখন সেই নামে পরিচিত। আবার অনেকে কাজী পাড়া বলে থাকে। তাদের পুর্বপুরুষ এ এলাকার অধিবাসী ছিলো না। সেই বৃটিশ আমলে এখানে এসে বসবাস শুরু করে। চাষাভুষা মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের কিছু হিন্দু সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কোন লোকের বসতি চোখে পড়ে না।
‘৪৭ পর হতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কিছু লোক গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে। এক সময় কাজী পরিবার ছাড়া কারো শিক্ষা লাভের সুযোগ ছিলো না। তাই এই পরিবারের লোকজন মফস্বল শহরে লেখা পড়া করতো। বিচক্ষণ বড় কাজী মফস্বল শহরে ছোট একটা বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন, তার সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার ইচ্ছায়। শিক্ষিত হলেও সবাই যে সুশিক্ষিত হয়েছে তা বলা যাবে না। নৈতিকতাবোধের অভাব অনেকের ভেতরে আছে বলে মনে হয়। গ্রামটির আশেপাশে বেশ কয়টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও, এ গ্রামের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। তাই বাধ্য হয়ে কিছু পরিবারের সন্তান অন্যত্র শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করছে। কাজী বাড়ির সামনের রাস্তার পরই দিগন্ত জুড়ে মাঠান জমি। এর অধিকাংশের মালিক কাজী বংশের সন্তানগণ।
আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা
সবেমাত্র ধান কাটা শেষ হয়েছে। খালি জমিতে গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেরা, পুরাতন একটা ফুটবল নিয়ে খেলায় ব্যস্ত, আর কিছু ছেলেপেলে গোল হয়ে বসে মোবাইলে গেম খেলছে। তাদের অনেকেই দামী গাড়ির দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। দরিদ্র ঘরের কিছু বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দৌড়ে এসে গাড়ির চারপাশ ঘিরে দাঁড়ালো। তাদের পরিধানে ছিন্ন ময়লা জামা। গাড়ির ভেতর বসা লোকটি গাড়ির স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে শীতের বিকেল আর গ্রামের চাষাভুষা ছেলে-মেয়েদের করুণ দৃশ্য অবজ্ঞা চোখে দেখছে। বর্তমান কাজী বাড়ির কিছু লোকের একটা বৈশিষ্ট্য আছে, তা হলো গ্রামের যে ক’জন ছেলে এসএসসি বা এইচএসসি পাস করেছে, তাদের শহরে নিয়ে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছে। কিন্তু কাউকে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ করে দেয়নি। তাই এ শ্রেণির মানুষের, কাজীদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাদের ভাষায় চাষাভুষার ছেলেরা বেশি পড়ালেখা করলে বড় কোন চাকরি পাবে না। তাই সামান্য সুযোগ তাদের কাছে বড় আর্শীবাদ।
ড্রাইভার গাড়ি হতে নেমে মনিবের অপেক্ষায় স্ট্যান্ডবাই দাঁড়িয়ে আছে। হর্ণের শব্দ শুনে কাজী বাড়ির নিবেদিত প্রাণ কাজী নিয়ামুল হক নবাব এক দৌঁড়ে গাড়ির পাশে দাঁড়াতেই এবার গাড়ি হতে নামলো পঞ্চাশোর্ধ বয়স্ক একজন ভদ্রলোক। গায়ে দামী সুট। নবাব কাজীর সাথে কথা বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে যেতে থাকে। নবাব কাজী এ বাড়ির কেয়ারটেয়ার। তবে সেটা সে মানতে রাজি নয়। তার দাদা বড় কাজীর সম্পর্কে নিকটতম আত্মীয়। লেখাপড়া এইচএসসি পাস। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি।
আরও পড়ুন গল্প পক্ষিরাজের ডানা
বছরখানেক আগে কাজী পরিবারের বড় ছেলের কোম্পানিতে চাকরি করলেও, যোগ্যতার অভাবে সুবিধা করতে পারেনি। বে-হিসাবি মানুষ। নিজেকে সব সময় বড় কিছু মনে করতো। ফলে অন্যান্য কর্মচারীগণ একজোট হয়ে নবাব কাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করাতে তাকে চাকরি হতে ছাঁটাই করে, কাজী বাড়ির কেয়ারটেকার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু সে কখনো অপরাধ স্বীকার করেনি বরং সবার কাছে বলে বেড়ায়, সে কাজী বাড়ির বিশ্বস্ত একজন লোক, তাকে দেখাশোনা করার জন্য বাড়িতে রেখেছে এবং বাড়ি এবং মাঠান জমির কিছু অংশ দান করেছে। সেই দাবিতে রাজার মতো বসবাস করে আসছে।
কাজীদের স্থাবর সম্পদ জমিজমার দায়িত্ব কাজী বাড়ির ছোট ছেলে কাজী হায়াতউল্লাহর। সবাই তাকে হায়াত কাজী বা ছোট কাজী বলে চেনে। গ্রামে কোথায় কি ঘটছে, কার ছেলে কোথায় কোন কলেজে পড়ছে ইত্যাদি বিষয় খুঁটিনাটি খোঁজ-খবর প্রতিনিয়ত নবাব কাজীর কাছ হতে মোবাইলে পেয়ে থাকে। কোভিড-১৯ এর পর দীর্ঘ তিন বছরেও বেশি গ্রামে আসা হয়নি হায়াত কাজীর। দীর্ঘ তিন বছর পর পৈতৃক বাড়িতে পা রাখলো। ইতোমধ্যে এলাকায় বেশ উন্নয়ন হয়েছে তা গাড়িতে বসে দেখে আসছে, আর বাকিটা নবাব কাজীর জবানবন্দি হতে জেনে নিবে। দীর্ঘ সময় ভ্রমণে পেটে খিদে লেগেছে। এবার একটা বিষয় চোখে পড়েছে, আগের মতো কাউকে তার আগমনে বয়স্কদের মধ্যে কোন আগ্রহ দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন গল্প কাঠগোলাপ ও প্রেম
নবাব কাজী অবশ্য বলেছে আজ হাটবার আর কৃষি কাজে সবাই ব্যস্ত। আরও কি যেন বলতে চেয়েছিল; হাত তুলে নিষেধ করাতে অতিকথন নবাব কাজী চুপ হয়ে যায়। শীতের সন্ধ্যায় নতুন পিঠা খুব তৃপ্তির সাথে খেয়ে নিজের সাথে আনা কফি, কফি কাপ নবাবের বৌয়ের হাতে দিয়ে কপি তৈরি করতে বলে, নবাবের সাথে করে দাদার আমলের ড্রইং রুমে গিয়ে বসলো। দশ মিনিটের মধ্যে কপি নিয়ে হাজির হলো নবাব গিন্নী। নবাব গিন্নী হায়াত কাজীর মায়ের দিক হতে আত্মীয়। তাই তার ভেতরে আভিজাত্যভাব নিয়ে চলাফেরা করে থাকে। কফি কাপ হায়াত কাজীর হাতে দিয়ে একটু দূরে বসলো। এবার মুখ খুললো হায়াত কাজী।
– এবার বলো নবাব, তোমাদের গ্রামের হালচাল কি?
নবাব তার স্বভাব সুলভ অভ্যাসে দু-হাত কচলাতে কচলাতে বলতে থাকে,
– আর কি বলবো ছোট ভাই। গ্রাম আর আগের মতো নেই। গুণিজনের মান্য করে না। এখন চাষাভুষার ছেলেপেলেরা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে।
পাশে বসা নবাব গিন্নী এবার মুখ খুললো।
– জানেন ছোট ভাই, এই গ্রামের কার ছেলে যেন বিসিএস পাস করেছে। শুধু তাই নয় মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছে। শুনেছি তাড়াতাড়ি চাকরি পেয়ে যাবে।
– বলো কি! এটা তো রীতিমতো আশ্চর্যজনক খবর। কার ছেলে?
– কার আবার, ঐ যে পচা সরদারের ছেলে রহিম সরদারের বড় ছেলে। জীবনে কখনো টাকা পয়সা দিয়ে পড়াশোনা করেনি।
– ভিক্ষে করে?
– না, তা হবে কেন? সরকারি বৃত্তি দিয়ে। এখন শহরে একটা কোচিং সেন্টারের পড়ায়। ভাল আয়। রহিম আর এখন রহিম সরদার নেই।
আরও পড়ুন গল্প একজন অনন্যা
নবার-গিন্নীর কথাগুলো শুনছিলো আর মনের ভেতরে অহংকারি জেদ প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলো। নিজের পরিবাবের কেউ আজ পর্যন্ত বিসিএস পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেনি। তারই বাবার আমলের একজন কামলার নাতি ছেলে, বিসিএস পাস করে বসে আছে। ছোট মনের মানুষ। মোটা বেতনের চাকরির টোপ আর বাড়তি সুযোগ সুবিধার প্রস্তাব দিয়ে দেখতে চায় কি ফলাফল হয়। যদি টোপ না গেলে বিকল্প ব্যবস্থা করে রাখলো হায়াত কাজী, যার নাকি অনৈতিক কাজ করার কোন জুড়ি নেই। কাজী পরিবারের সে একেবারে স্বতন্ত্র ব্যক্তি। গ্রাম পেয়েছে নবাব কাজীর মতো স্বার্থপর একটা পরিবার।
– শোন, আজ আর বেশি কথা হবে না। আটটার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাবো। নবাব তুমি সকালে রহিম সরদার আর তার বিসিএস মার্কা ছেলেকে খবর দিবে আমার সাথে দেখা করতে। আর একটা কথা বরগাদাদের এগারোটার দিকে আসতে। ঠিক আছে? আমার ঘরে যাচ্ছি।
নবাব-গিন্নী দু’জন একই চরিত্রের লোক এবং লোভী। কারো সুনাম সহজে হজম করতে পারে না। তবে দুজনের মধ্যে আলাদা একটা রূপ আছে, সেটা হলো তাদের বংশ পরিচয় নিয়ে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে মাঝে মধ্যে তুমুল ঝগড়া ঘটে যায়। নবাব গিন্নী রেগে দুটো ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যেতো। এখন অবশ্য বয়সের কারণে আর ছেলেমেয়ে বড় হওয়াতে রাগের গতি কমে গেছে। তারা দুজনে তাদের ঘরে চলে গেলো।
আরও পড়ুন নতুন সূর্যের অপেক্ষায়-
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
নতুন সূর্যের অপেক্ষায় (১ম পর্ব)