নতুন-সূর্যের-অপেক্ষায়-শে্-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

নতুন সূর্যের অপেক্ষায় (শেষ পর্ব)

নতুন সূর্যের অপেক্ষায় (শেষ পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

পর পর দু’বার মোবাইলে রিং বেজে চলেছে। কোথাও আবার কোন অঘটন ঘটলো কিনা। বাজে সময় যাচ্ছে। মোবাইল হাতে নিতেই চোখে পড়ে তার বাবার নম্বর। মনের ভেতরে কেমন যেন একটা ভয়ের ঢেউ খেলে গেল। তার মা ব্লাড প্রেশার রোগী।
– বাবা, সব ঠিক আছে তো?
– আমরা সবাই ভালো আছি খোকা। একটা বিপদে পড়ে এত সকালে তোকে বিরক্ত করছি।
– বাবা, এমন করে বলছো কেন? কি হয়েছে খুলে বলো।
– আনোয়ার কে তো চিনিস?
– বারে চিনবো না, তোমার শিক্ষকতা জীবনের সেরা একজন ছাত্র। তাকে নিয়ে গর্ব করো। বল কি হয়েছে?
– আর বলিস না, গত রাতে ওর বাবাসহ ওকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছে।
– কি বলছো বাবা!
– হ্যাঁ রে খোকা ঠিকই বলছি। কিছু একটা করা দরকার। ছেলেটার জীবন এ ভাবে নষ্ট হতে পারে না।
হায়াত কাজীর ঘটনা খুলে বলেন তার ছেলেকে।
– বাবা, তুমি কাউকে সাথে করে থানায় গিয়ে আমাকে ফোন করবে। দেরি করবে না।

আরও পড়ুন গল্প তিল তাল

বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের চৌকস এসিপি গোয়েন্দা হেড অফিসে কর্মরত। মেধাবী এবং বুদ্ধিমান। ইতোমধ্যে পুলিশ বিভাগে সবার নজর কেড়েছেন জনাব জহুরুল করিম। নীতিমান এবং সৎ বলে পরিচিত শিক্ষক আব্দুল করিম সাহেবের ছেলে। তাৎক্ষণিক দেখে নিলেন পাবনা পুলিশ বিভাগে তার কোন ব্যাচমেট আছে কি-না। মিলে গেল। তার শুধু ম্যাচমেট নয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী আহমেদ তারেক। একজন সৎ এবং করিৎকর্মা অফিসার। শুধু তাই নয় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। দেরি না করে মোবাইলে বিস্তারিত ঘটনা খুলে বললো।
– জহুর কোন চিন্তা করবে না। একজন সৎ মানুষকে ফাঁসানো। মজা দেখাছি।

হেড মাস্টার সাহেব তার একজন বিশ্বস্থ প্রাক্তন ছাত্রের মোটর সাইকেল যোগে থানায় উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে বড় বাবু একটু চিন্তায় পড়লো। সে জানে হেড মাস্টার সাহেবের একমাত্র ছেলে পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা। তাকে সম্মান করা দরকার। সালাম দিয়ে ভেতরে গিয়ে বসতে বললো। হেড মাস্টার সাহেব তার ছেলেকে মোবাইলে অবগতি করলেন।
– অপেক্ষা করো।
পাবনা শহর হতে থানা ঘন্টা দুয়েকের রাস্তা। সুন্দর যোগাযোগের ব্যবস্থা। দুজন পুলিশ কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলেন। দশটার মধ্যে পোঁছে গেলেন থানায়। এসিপি (তদন্ত)। তাকে দেখে থানার বড় বাবু হতে আরম্ভ করে নিচের সব ধরনের পুলিশ বাবুদের আত্মারাম মুহূর্তের মধ্যে বরফের মতো ঠান্ডায় পরিণত হলো।
– বলুন, ওসি সাহেব। মস্ত বড় দুই জন ক্রিমিনালকে নাকি শীতের রাতে ধরে এনে থানায় রেখেছেন?
– স্যার…
– স্যার স্যার করছেন কেন? এত বড় একটা ভালো কাজ করেছেন। তাই নিজেই এলাম দেখতে। ও বুঝেছি কোন শক্তিশালী এভিডেন্স নেই। শুধু হয়রানি আর একজন মেধাবী প্রতিভাবান ছেলের জীবন নষ্ট করার জন্য মাত্র কযেক হাজার টাকার জন্য এত বড় একটা জঘন্য কাজ করতে আপনার বিবেকে একটু বাধলো না? যে ভদ্রলোক আপনাকে দিয়ে এই কাজটা করিয়েছে, সে বা তাদের মতো তথাকথিত উচ্চবর্গের মানুষেরা এ দেশের সাধারণ মানুষের সন্তান বড় পদে আসীন হোক; এটা তারা চায় না। তাদের ধ্যান-ধারনা এখনো বৃটিশ-পাক আমলের গন্ডির ভেতরে আটকে আছে। আপনি কি সেই ধ্যান-ধারণা নিয়ে চলেন?

আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা

এত সময় আগন্তুক পুলিশ অফিসারের কথা শুনে যাচ্ছিলেন হেডমাস্টার সাহেব। খুশি হলেন এমন একজন পুলিশ অফিসার তার ছেলের সহকর্মী। এবার পুলিশ অফিসার চোখ রাখলেন হেড মাস্টার সাহেবের দিকে। তার সহপাঠী জহুরের চেহারার সাথে অবিকল মিল, শুধু বয়সের পার্থক্য। সালাম দিয়ে পরিচয় দিলেন।
– আমি এত সময় আপনার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম; আর মনে মনে গর্ববোধ করছি আমরা ভবিষ্যত গড়তে পারবো। আমাদের সৎ মানুষ আছে।
– চাচাজি, আমি সব শুনে নিজেই ছুটে এলাম, বিষয়টি কি এবং রহিম আনোয়ারকে দেখতে। দুদিন পর আমাদের সহপাঠী হতে চলেছে। অবশ্য ও প্রশাসন ক্যাডারের আমাদের ছোট ভাই। কই ওসি সাহেব, নিয়ে আসুন। আর আমাকে আপনি বলে লজ্জা দিবেন না। আমাকে তুমি বলতে পারেন। আপনাদের মতো সৎ এবং শিক্ষিত মানুষ আছেন বলেই আমরা কাজ করে যেতে পারছি।

আনোয়ার এবং তার বাবাকে সসম্মানে অফিস রুমে আনা হলো। তারা এখন মুক্ত। থানার ভেতরে আলাদা একটা মুহূর্ত ঘটে গেলো, যেটা ওসি সাহেবের কল্পনার বাইরে। নবাব কাজী খবর পেয়ে চলে এসেছে। এসে দেখে গনেশ উলটে গেছে। তাৎক্ষণিক হায়াত কাজীকে জানিয়ে, চোরের মতো গা ঢাকা দিলো। গ্রামের উঠতি বয়সের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের অনেকেই এসেছে। তাদের প্রিয় বড় ভাই। তাদের আর্দশ। খবর শুনে চলে এসেছে। থানার আঙ্গিনা ভরে গেছে।
– ওসি সাহেব, বাইরে চেয়ে দেখুন। কজনকে হাজতে ঢোকাবেন? এদের চোখ খুলে গেছে। আমরা এখন এদের রক্ষক। আপনার তো মাফ চাওয়া উচিত। চিন্তা করতে পারছেন কত বড় জঘন্যতম কাজ করতে যাচ্ছিলেন? আপনাদের মতো কিছু সংখ্যক মানুষের জন্য ডিপার্টমেন্টকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। একটা মেধাবী এবং প্রতিভাবান ছেলের জীবন চিরদিনের মতো নষ্ট করতে চলেছিলেন। কোন এভিডেন্স নেই বলে কাজীকে শায়েস্তা করা গেলো না। কিন্তু আপনার তো শান্তি হবেই। তবে বাকি একটা কাজ আপনার হাত দিয়ে করতে চাই। আপনি আগামীকাল দশটার মধ্যে সিলসহ আমার অফিসে উপস্থিত হবেন।
ওসি রুহুল আমিন জি স্যার বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে। অন্যান্য পুলিশ কর্মী ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে। তারা হুকুমের দাস।

আরও পড়ুন গল্প পরাজিত নাবিক

হেড মাস্টার আব্দুল করিম কিছু বলার জন্য অফিসারকে দৃষ্টি আর্কষণ করলেন। অফিসার সানন্দে বলার জন্য অনুরোধ করলেন।
– আজ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিন অতিবাহিত করছি। এত বড় আনন্দের দিন হয়ত আর আসবে না। আমার ছেলের সুযোগ্য সহপাঠীর সততা এবং দেশপ্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছে। শুধু তাই নয় একজন মেধাবী ছেলের জীবন দান করেছে। সেও ভবিষ্যতে বিসিএস ক্যাডারের সদস্য হতে চলেছে। আমি এবং আমার এলাকার পক্ষ হতে তাকে দোয়া করবো। আর একটা কথা বলতেই হবে। এই দেশটা সাধারণ জনগণের। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলো। এটা চিরসত্য। আজও আমাদের মধ্যে উচ্চবংশ-নিম্নবংশের ভেদাভেদের দ্বন্ধ বিরজমান। কাজীদের মতো অনেক পরিবার এ ধরণের ভেদাভেদ সৃষ্টি করে রেখেছে। তবে সবাই নয়। অনেক ভাল মানুষ আছেন।

কাজ করতে পরিবারের কজনের সাথে আমার পরিচয় আছে, তারা অন্তত হায়াত কাজীর মতো নয়। তবে তারা গ্রামের সাথে কোন সম্পর্ক রাখেন না। আবার একাত্তরে কাজীদের মতো অনেক পরিবার হয়তো পালিয়েছিল, না হয় হানাদার বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছিলো। এখন তারা নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমি সব সময় বিশ্বাস করি, জন্ম আর কর্ম এক জিনিস নয়, কর্মই মানুষকে চির স্মরণীয় রাখে। ইতিহাস সেটাই বলে। চাষাভুষার ছেলে বলে কি তারা নাগরিক সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত হবে? তা হতে পারে না। শিক্ষার অধিকার যেমন সবার, আবার রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সমান অধিকার রয়েছে।
আজও মনে পড়ে –“দাবাইয়া রাখতে পারবা না।”

দিন বদল হতে চলেছে। দেশটা, এ দেশের কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের। সময়ের সাথে সাথে আরও দিন বদলাবে। প্রতি দিন নতুন একটি সূর্যের অপেক্ষায় আমরা।

আরও পড়ুন নতুন সূর্যের অপেক্ষায়-
১ম পর্ব
২য় পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

নতুন সূর্যের অপেক্ষায় (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!