তৎকালীন-গ্রামীণ-চিকিৎসা-ব্যবস্থা  
আত্মজীবনী,  লেখক পরিচিতি,  সাহিত্য,  স্মৃতিচারণ

তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা

তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা  

তাহমিনা খাতুন

 

আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, গ্রামের মানুষের রোগবালাই তেমন একটা ছিল না!। ভেজাল মুক্ত খাবার, কায়িক পরিশ্রম, অনেক বেশি হাঁটা-হাঁটি করার অভ্যাসের কারণে গ্রামের মানুষের মধ্যে অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা বিস্ময়করভাবে কম ছিল। কোথাও যেতে হলে কোনো যানবাহনের সহজ লভ্যতা বর্তমান সময়ের মত ছিল না। স্বভাবতই লোকজনকে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো। 

সাধারণত বর্ষাকালে বা শীতকালে ঠাণ্ডাজনিত কারণে জ্বরে ভুগতো মানুষ। আমরা ভাই-বোনেরা জ্বরে আক্রান্ত হলে মাথায় অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালতেন মা। কখনও কখনও দ্রুত জ্বর কমানোর জন্য পুকুর থেকে ভেজা কাদা তুলে এনে কাপড়ে জড়িয়ে পেটের উপর দিয়ে রাখতেন! বড় জোর আব্বা আমাদের গ্রামের ডা. খলিলুর রহমান সাহেবের নিকট থেকে কাঁচের বোতলের উপর কাগজে দাগ কাটা লাল গোলাপী বা সাদা তরল ওষুধ এনে দিতেন। ওই ওষুধ খেয়েই দুই চারদিনের মধ্যেই জ্বর ভালো হয়ে যেত। জ্বর হলে ভাত খেতে দেওয়া হতো না।

তখন টিনের বোতলে রবিনসন্স বার্লি নামে এক ধরনের পাউডার জাতীয় বার্লি পাওয়া যেতো। সেই পাউডার পানিতে গুলিয়ে ভালো করে জ্বাল দিয়ে লেবুর রস আর মিছরি দিয়ে খেতে দেওয়া হতো। বড় জোর পাউরুটি-যা ওই সময়ে  জোগাড় করা সহজ সাধ্য ব্যাপার ছিল না। কারণ ওই দুর্লভ পাউরুটি কিনতে পাবনা শহরে যেতে হতো। আমার এখনও মনে আছে, একবার আমার জ্বর হওয়ায় কিছুই খেতে পারছিলাম না। মেজভাই প্রায় ৪২ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পাবনা শহর থেকে আমার জন্য পাউরুটি কিনে এনেছিলেন! জ্বর ভালো হয়ে গেলে কম মশলায় পেঁপে দিয়ে শিং মাছের পাতলা ঝোলের তরকারি; নরম ভাতের সঙ্গে খেতে দেওয়া হতো কয়েক দিন পর্যন্ত। 

আরও পড়ুন সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর

শরীরের কোথাও কেটে  গেলে গাঁদা ফুলের পাতার রস বা তেলাকুঁচা লতার পাতা হাতের তালুতে থেঁতো করে লাগিয়ে দিলেই রক্ত পড়া বন্ধ হতো। কাশি হলে তুলসি পাতার রস আর  আদার রস মধুতে মিশিয়ে খাওয়ালেই কাশি ভালো হতো। আবার গন্ধ ভাদাল নামে এক ধরনের বুনো লতার পাতা পানিতে জ্বাল দিয়ে কয়েক দিন খাওয়ালে হুপিং কাশি নামের এক ধরনের তীব্র যন্ত্রনাদায়ক কাশিও কয়েক দিনেই ভালো হতো!

আমাদের পাড়ায় একজন বয়োজ্যেষ্ঠ গুরুজন মহিলা ছিলেন। ওনাকে সবাই ‘ইসলামের মা’ নামে চিনতেন। বেশিরভাগ মুরুব্বী শ্রেণির মানুষ ওনাকে চাচি, খালা বলে সম্বোধন করতেন। আমরা ভাই বোনেরা ওনাকে দাদি বলে ডাকতাম। ধাত্রী বিদ্যায় উনি খুবই পারদর্শী ছিলেন। এছাড়া কারোও হাত-পা মচকে গেলে উনি চুলার ছাই দিয়ে এমনভাবে মালিশ করে দিতেন যে, দুই-তিন দিনেই সেটা ভালো হয়ে যেতো! আবার অনেক সময় কয়েক দিন বয়সের শিশু হয়তো কোনো কারণে ঘাড়ের বা গলার  হাড়ের ব্যথায় কান্না-কাটি করতো। মায়ের বুকের দুধ ঠিকমতো খেতে পারতো না। স্থানীয় ভাষায় শিশুদের এই সমস্যাকে ‘খেড়ি ওঠা’ বলতো। তখন ‘ইসলামের মা’ দাদির ডাক পড়তো। ওনার তেল মালিশেই ওই শিশু সুস্থ হতো!

আমাদের বাড়িতে একটা শিউলী ফুলের গাছ ছিল। প্রায়ই দাদিকে দেখতাম শিউলী গাছের কিছু পাতা ছিঁড়ে শিলে ছেঁচে তার রস বের করে খেতেন এবং সুস্থ থাকতেন! ওনার অসুখ-বিসুখের কথা তেমন একটা শুনিনি কখনও। ওনার এসব সেবা প্রদানের বিনিময়ে কোনো আর্থিক দাবির কথা কোনো দিনও শুনিনি। অনেক বছর আগে এই ভালো মানুষ দাদি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারের বাসিন্দা হয়েছেন। এমন সহজ সরল নির্লোভ মানুষ আজকের বস্তুবাদী দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া দুরূহ!

আসলে প্রকৃতি তার প্রাণীকূলের জন্য সব ব্যবস্থাই করে রেখেছে। মানুষ তার উদগ্র চাহিদায় প্রকৃতির ব্যবস্থাপনা থেকে যত দূরে সরে যাচ্ছে, প্রকৃতিও তার প্রতিদান ভয়ঙ্কর ভাবে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা

আমাদের গ্রাম থেকে মাইল চারেক দূরের গ্রাম কয়া। সে গ্রামে একজন ডা. ছিলেন। নাম শচীন চন্দ্র। আমি তখন খুব ছোট। আমাদের বাড়িতে কারও অসুখ হলে সাধারনত আমাদের গ্রামের ডা. খলিলুর রহমান সাহেবের চিকিৎসায়ই সুস্থ হয়ে যেতাম। তবে কারও অসুখের বাড়াবাড়ি হলে তখন ডাক পড়তো শচীন ডাক্তার সাহেবের। শচীন ডাক্তার রোগী দেখতে আসতেন ছোট একটা ঘোড়ায় চড়ে। ঘোড়াটাকে দেখে ‘গাধা’ বলে ভুল হতো। ষাটের দশকের প্রথম দিকের কথা। ওই সময়েই শচীন ডাক্তারের রোগী দেখার ফি ছিল পাঁচ টাকা! আব্বাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন শচীন ডাক্তার। সম্পূর্ণ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন।

আব্বা একবার ডাক্তার সাহেবকে তাঁর সব সময় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার কারণ জিজ্ঞাসা করায় উনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন,”বুঝলেন খোন্দকার সাহেব, বইয়ের ভাষায় কথা বললে স্নায়ুর উপর চাপ পড়ে। এ জন্যে বইয়ের ভাষায় যত কম কথা বলবেন, তত ভাল থাকবেন।” এমন একজন মানুষের জীবনের অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা ঘটেছিল। ডাক্তার সাহেবের অত্যন্ত মেধাবী দুটি ছেলে নবম অথবা দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যায়। ছেলে দুটি এতোটাই উন্মাদগ্রস্থ হয়ে গিয়েছিল যে তাদের পায়ে সব সময় লোহার শেকল পড়িয়ে রাখতে হত। ছেলে দুটির শেষ পরিণতি কি হয়েছিল তা অবশ্য আর জানা হয়নি।

আমাদের গ্রামে চিকিৎসা দিতেন আহাম্মদ হোসেন নামে আরও একজন গ্রাম্য চিকিৎসক। আমার মেজভাই মরহুম খন্দকার শহীদুল্লাহ সাহেবের সাথে তাঁর ছিল বেশ অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। মেজ ভাইকে দেখতাম, অবসর সময়ে ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে চিকিৎসা বিদ্যা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে। ওনার কাছ থেকেই মেজ ভাই ইনজেকশন দেওয়া, ব্লাড প্রেশার চেক করা, সর্দি, কাশি, সামান্য জ্বর ইত্যাদি অসুখ-বিসুখে চিকিৎসা দিতে পারতেন! এ সময়ে হয়তো অনেকেই এমন চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন, তবে ষাটের দশকে এমন সব অসুখে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া সহজ সাধ্য ব্যাপার ছিল না।

 

সঙ্গীহীন হওয়ার গল্প:

দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার অল্প দিনের মধ্যে শুরু হল মুক্তযুদ্ধ। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর দেশ হানাদার মুক্ত হলো। আমরা দু’বোন তখনও ঢাকায়। গ্রামে তখন পর্যন্ত বাড়ি-ঘর তৈরি হয়নি বা পরিবার কৃষি কাজেও সম্পৃক্ত হতে পারেনি। পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি তখন বেশ নাজুক। তৃতীয় ভাই মরহুম জনাব আবুল খায়েরের সরকারি চাকুরির স্বল্প বেতনই সংসার চালানোর একমাত্র উপায়। আমি সহ মোট চার ভাই-বোন স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। উপায়ান্তরহীন ভাই দুই বোনের মধ্যে আমি বড় হওয়ায় আমাকে বিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। তবে সৌভাগ্য আমার, ভাইয়ের মতো আমার স্বামী মরহুম আনোয়ারুল হক রাশেদও ছিলেন বিদ্যোৎসাহী। কাজেই বিয়ের পরেও আমার শিক্ষা জীবন ব্যাহত হলো না।

বিয়ের পরে এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম। কিন্তু বাস্তবতা বাদ সাধল। সন্তানের জন্ম, নিজের অসুস্থতা আর ও নানা কারণে শিক্ষা জীবন অব্যাহত রাখা দুরূহ হয়ে উঠল। কাজেই বাধ্য হয়ে লেখাপড়া স্থগিত রাখতে বাধ্য হলাম।

যাহোক, লেখাপড়া স্থগিত রাখতে বাধ্য হলেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বাসনাটুকু মনের গহীনে জিইয়ে রেখেছিলাম। অনুকূল পরিবেশে মনের সুপ্ত বাসনাটি জেগে উঠল। স্বামীর উৎসাহ আর সহযোগিতায় এসএসসি পাশের ১৪ বছর পর আবার কলেজে ভর্তি হলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে এলএলবি (অনার্স সহ) এলএলএম পাশ করলাম।

অনেকের ধারনা ব্যবসায়ীরা বিদ্যোৎসাহী বা সংস্কৃতিমনা হয় না! কিন্তু ধারনাটা ঠিক নয়।

আরও পড়ুন সাহিত্য চর্চার একাল সেকাল

আমার স্বামী কেবল মাত্র বিদ্যোৎসাহীই ছিলেন না। ছিলেন মুক্তমনা, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী। অল্প বয়সে কবিতা লিখতেন। অকালে পিতৃহীন হওয়ায় সংসারের দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হওয়ায় সাহিত্যচর্চায় ইতি টানতে হয়েছিল! গান শোনা, ভালো সিনেমা, মঞ্চনাটক দেখা, বইমেলা, বাণিজ্যমেলা সহ যেকোনো মেলা দেখতে যাওয়া,পয়লা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে যাওয়া-এসব সুকুমার বৃত্তির চর্চা ছিল আমাদের পরিবারের নিয়মিত আনন্দের অংশ। ২০০৩ সালে অক্টোবর মাসে শেষবারের মত তাকে নিয়ে কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম বেড়াতে গেলাম। কক্সবাজার থাকাকালীন সময়েই প্রচণ্ড পেটে ব্যথাসহ আরো কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দিল। ঢাকায় ফিরেই ডাক্তারের শরনাপন্ন হলাম। ডা. পরীক্ষা করে অভিমত দেওয়ার আগেই ডাক্তারের অভিব্যক্তি দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম আমার দূর্ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। এরপর শুরু হলো দূরন্ত মরণব্যাধি পাকস্থলীর ক্যান্সারের সাথে লড়াই। 

কোলকাতার একটি বিখ্যাত ক্যান্সার হাসপতালে নিয়ে গেলাম। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আদভানীর তত্বাবধানে চিকিৎসা শুরু হলো। অনেকগুলো কেমোথেরাপির পর ডা. অপারেশন করে পাকস্থলীর পঁচাশি ভাগ ফেলে দিলেন। বেশ কয়েকবারই তাকে নিয়ে কোলকাতা গেলাম। দেশেও বেশিরভাগ সময় হাসপাতালের বিছানায় কাটতো। যমে-মানুষে টানাটানি চললো দেড় বছর ধরে। শেষ পর্যন্ত সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ২০০৫ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর কাছে হার মানতে বাধ্য হলো আমার কাছের মানুষটি। 

সংসারের দায়িত্ব পালন, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া, সমাজের দুস্থ, অসহায়, নির্যাতিত মানুষদের জন্য কিছু করার চেষ্টা-সব কিছুই সম্ভব হয়েছিলো যাঁর সহযোগিতায় সেই মানুষটি আমাকে ছেড়ে, দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। আমার স্বামী কেবল স্বামীই ছিলেন না, ছিলেন আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী, ছিলেন সুখ-দুঃখের অকৃত্রিম সহচর। অনেক বছর পার হয়ে গেছে। একাকীত্বের দুঃসহ বোঝা টেনে চলেছি আজও।

আরও পড়ুন যাপিত জীবনের কথকতা-  
দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আত্রাই নদী 
আমার বাবা
আমার মা
ভাই-বোনদের কথা
আমার শিক্ষাজীবন
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো 
যেভাবে আইনজীবী হলাম
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
সংসার ও আইনজীবী জীবন
পাশের বাড়ির আপনজন
আমার নানী
প্রথম শহর দেখা ও  প্রথম বিদেশ ভ্রমণ
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
ছেলেবেলার ষড়ঋতু  
মধুর স্মৃতি
স্নেহশীল কজন

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা  

Facebook Comments Box

তাহমিনা খাতুন একজন বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। তিনি ছড়া, কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি এবং নারীর অধিকার নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। পেশায় তিনি একজন আইনজীবী। তার পেশাগত জীবনে তিনি নারীদের আইনি সহায়তা প্রদান এবং তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করতেন। তাহমিনা খাতুন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের দ্বারিয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও কৈশোর কাটে এই গ্রামেই।

error: Content is protected !!