জারজ (৩য় পর্ব)
জারজ (৩য় পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
বিচারক নাসরিন জাহান হেনা তার দীর্ঘ কর্মজীবনে এমন বিস্ময়কর ঘটনার সম্মুখীন হননি। মনটা কেমন যেন বিচলিত হয়ে উঠেছে। স্বাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া তো কোন মামলার বায় ঘোষণা করা যায় না। এখানে স্বাক্ষ্য নেই কিন্তু জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে। যে অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে, তাতে তার আঙ্গুলের ছাপা প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তাই নয় এটা তার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা। ঘৃণার বর্হিঃপ্রকাশ। মানুষ কতটা কষ্ট পেলে, এ রকম জঘন্য কর্মকাণ্ড ঘটাতে পারে। তবে ছেলেটি কেন উকিল নিয়োগ করতে অনিহা প্রকাশ করেছে, এর পিছনে নিশ্চয় কোন যুক্তি আছে। প্রায় নয়টা বেজে গেছে। এখনই বের হতে হবে। আদালত কোন আবেগের জায়গা নয়। সে একজন নিরপেক্ষ দায়িত্ববান বিচারক।
ঘড়ির কাঁটায় দশটা বাজার দশ মিনিট আগেই অফিসে পোঁছেছিলেন বিচারক নাসরিন জাহান হেনা। দশটায় হাজির হলেন এজলাসে। এজলাসে আজকে লোকের সংখ্যা একটু বেশি। কৌতূহলে অনেকে এসেছে। আবার আসামীর প্রতি সহানভূতিশীল তারাও এসেছে। এছাড়া এসেছে জুনিয়র-সিনিয়র কিছু সংখ্যক আইনজীবী। আজকের বাদীর পক্ষের আইনজীবী হাসমত আলী কিছুটা চিন্তাযুক্ত। বাদী তার সম্পর্কে আত্মীয় হন।কেসটা কিছুটা জটিল মনে হচ্ছে।
মাননীয় বিচারক আসন গ্রহণ করে বাদী পক্ষের উকিলকে আসামীকে জেরা করার অনুমতি দিলেন।
আসামীর কাঠগড়ায় নাসিম দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে গর্ভধারিনী একজন মহিলা। যাকে সে মা বলে স্বীকৃতি দেয়া না। আগে মা বলে জানতো। শুধু জানতোই না পাগলের মত মাকে ভালবাসতো।
-আচ্ছা নাসিম, সামনে যে মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন তাকে কি চেনো?
চিনি বলেই তো এখানে আনতে অনুরোধ করেছিলাম। সম্মানিত আদালত আমার আরজি গ্রহণ করেছেন এ জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। মাননীয় আদালতের কাছে আমার আর একটু আবেদন। আমি আমার কিছু কথা বলতে চাই।
আদালত বলার সুযোগ দিচ্ছে। আসামী তার বক্তব্য আদালতের কাছে পেশ করতে পারে।
আরও পড়ুন গল্প সুরেন বাবু
-মাননীয় আদালত। আমার বয়স তখন দশ-এগার তো হবেই। ৫ম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা হবে। আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। হাতের লেখা হতে শুরু খেলাধুলায় আমি সবার ওপরে। শিক্ষকরা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। এ সবের পিছনে অবদান ছিল ঐ মহিলার। যেদিন ফর্মফিলাপ হবে, সেই দিন হলো বিপত্তি।
আমার জন্মদাতা ততদিনে নতুন বিয়ে করে গাজীপুর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। মানে রাতের আঁধারে আমাদের পরিত্যাগ করেছে। বস্তির ভেতর আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে আমি নাকি অবৈধ সন্তান। আমার গর্ভধারিনী তা স্বীকার করেছিল। সাত বছর অবৈধ সন্তান আর অবৈধ একজন মহিলার সঙ্গে জীবন কাটানোর কথা আমার মনের ভেতরে উথাল-পাথাল শুরু করত।
ঔ বয়সে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, এর প্রতিশোধ নিতে হবে। যে লোক আমাকে পিতৃ পরিচয় হতে বঞ্চিত করেছে এবং তার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে তাকে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। ঘৃণিত ইদ্রিশ আলীর ঠিকানা সহজেই পেয়ে গেলাম তারই একজন পরিচিত লোক মারফতে।
একদিন রাতে ঔ মহিলার জমানা টাকা হতে পাঁচশত টাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জে এসে উপস্থিত হলাম। অনেক কষ্টে মোটর গ্যারেজে কাজ পেয়ে গেলাম। অল্প দিনের মধ্যে ভাল মেকানিক হয়ে গেলাম। সারাদিন কাজ করি আর সন্ধ্যায় শহর এবং তার পাশে গার্মেন্টসের সামনে ইদ্রিশ আলীকে খোঁজ করতে থাকলাম। একদিন পেয়ে গেলাম আর খুন করার পরিকল্পনা শুরু করে দিলাম। একদিনে হয়নি, প্রায় চার-পাঁচ বছর লেগেছিল।
মাননীয় আদালত, নারায়ণগঞ্জে এসে এলাকার মানুষের সাথে পরিচিত হতে থাকি। আর রাতের বেলায় বই আর পুরানো খবরের কাজ পড়তাম। এইভাবে প্রায় দু’বছর চলে যায়। বাকী দুই-তিন বছর লাগে মানসিক প্রস্তুতি নিতে। এটা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত।পুলিশের কাছে ধরা তো দেবই। হত্যাকাণ্ডে বিচারে মৃত্যুদণ্ড হবে। কিন্ত বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায়।
আরও পড়ুন গল্প একটি মিষ্টি স্বপ্ন
অজান্তে একটা মেয়ে আমাকে ভালোবেসে ফেলে এবং এখনো পাগলের মত ভালোবাসে। তার কাছ হতে দূরে সরে থাকার জন্য জায়গা বদল করি। কিন্তু লাভ হয়নি। মেয়েটিকে একদিন খুব অপমান করেছিলাম। শুধু তাই নয়, আমার অবৈধ জন্মের কথা বলাতেও সে আমাকে ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি। আমি অনড়। কারণ এই ভদ্র সমাজে আমার কোন বৈধ পরিচয় নেই। ভালোবাসা-মায়ামমতা আমার জন্য নয়। সিদ্ধান্তে অটল আমি। জেনে শুনে কারো জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার আমার নেই।
মাননীয় আদালত, ভাবছেন একজন মোটর মেকানিক এত সুন্দর করে গুছিয়ে কিভাবে কথা বলতে পারে। এটা আমার গর্ভধারিনীর অবদান। এর আগে তার কথা তো শুনেছেন। সময় পেলেই হুমায়ুন আহমদের বই পড়েছি। পত্রিকা পড়তাম নিয়মিত।
ইদ্রিশ আলীর খোঁজ পেয়ে গেলাম। শুধু অপারেশনের অপেক্ষায়। একদিন পেয়েও গেলাম। দুর্ভাগ্য আমার। সাথে তার দুটো অল্প বয়সী সন্তান। মায়া হলো, ছেড়ে দিলাম। দেখাতো মিলছে। ওর অপমৃত্যু আমার হাতে এটাই আমার প্রতিজ্ঞা।
মাননীয় আদালত আর একটা ঘটনা আপনাকে বলতে চাই। আমার এই হতাশা দেখে একজন মৌলভী সাহেব তার সাথে তাবলিগে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন। আল্লাহর পথে থাকলে মন ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু জন্ম বৃত্তান্ত বলার পর মৌলভী সাহেব আমার থেকে দূরে চলে গেলেন। বুঝলাম ধর্ম-কর্ম-সমাজ আমার জন্য নয়।
আবার শিকারী চোখ নিয়ে ইদ্রিশ আলীর দিকে প্রতিনিয়ত নজর রাখতে শুরু করে দিলাম। পেয়ে গেলাম মোক্ষম সময়। বিধাতা ওর জন্য এই সময়টা নির্ধারণ করে রেখেছিল। সময় সন্ধ্যা। আষাঢ় মাস। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। চারিদিকে অন্ধকার। হাঁটছি ধীর গতিতে। কালো টাওজার পরেছি। গায়ে কালো টি-শার্ট এবং মাথায় কালো রঙের ক্যাপ। চেয়ে দেখি প্রায় পাঁচ-ছয় গজ দূরে আমার শিকারী। মাথায় টুপি, মুখে কালো দাড়ি।দেখে হাসি পেল। কি পরহেজগার! বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, বিয়ে না করে একটা অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়ে, রাতের অন্ধকারে এলাকা হতে গায়েব হয়ে যায়। আর একটা অবৈধ সন্তান বৈধ করে মহিলাকে বিয়ে করে।নিয়মিত ধর্ম-কর্ম করে।
আরও পড়ুন গল্প কবর
একটু অভিনয় করলাম। চোখে পোকা পরেছে, বের করে দেওয়ার জন্য সাহায্য চাইতে রাজি হয়ে গেল। তার চেয়ে আমি একটু লম্বা। তাই মাথা উঁচু করে চোখের ভেতরে পোকা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি সুযোগের অপেক্ষায়। প্যান্টের পকেট হতে চকচকে ধারালো খুর বের করে, সজোরে টানটান গলায় দিলাম এক পোঁচ। আর হাঁটু দিয়ে তল পেটে মারলাম গুঁতো। ব্যাস একেবারে শেষ। চিৎকার করার সুযোগ পেল না। বস্তির খুপরিতে ফিরে এলাম। রক্তমাখা পোশাক বদলিয়ে এই পোশাক পরি। রক্ত মাখা পোশাক একটা পলিথিনের ব্যাগের মধ্যে রেখে দিলাম।
শুনেছি মানুষ খুন করলে না-কি খাবার খেতে পারে না । কিন্তু আমি তো মানুষ খুন করিনি। তাই মাংস-বড় রুই মাছ দিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম। তারপর মিষ্টির দোকানে গিয়ে বড় বড় চারটা রসগোল্লা খেয়ে, আবার ফিরে এলাম বস্তির খুপরিতে। শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। আর খুরখানা কাগজে মুড়িয়ে যত্নসহকারে রেখে দিলাম।
অনেক ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। খুরখানা আর রক্তমাখা পোশাক হাতে সোজা থানায় এসে সত্য ঘটনা খুলে বললাম। খুর আর পোশাক পুলিশের কাছে জমা দেই। কিন্তু পুলিশ প্রথমে বিশ্বাস করেনি। খোঁজ-খবর নেওয়ার পর, তারা আমাকে হাজতে আটক করে। বাকী ঘটনা তো মাননীয় বিচারক সবই জানেন। আমার আর কিছু বলার নাই।
আরও পড়ুন জারজ-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
জারজ (৩য় পর্ব)