চোখের-আলোয়-দেখেছিলেম-১ম-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

চোখের আলোয় দেখেছিলেম (১ম পর্ব)

চোখের আলোয় দেখেছিলেম (১ম পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

শ্রাবণের শেষ বিকেল। রোদের তীব্রতা তখনো কমেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক হতে বের হয়ে সোজা হাঁটা শুরু করে দিয়েছে মোহাম্মদ জামী। উদ্দেশ্য ভালো; ছোটো এক রুমের বাসা। কিন্তু সে যে ব্যাচেলার! তাকে কে ভাড়া দিবে। মিষ্টি ভাইয়ের আদেশ, মেসে থেকে চাকুরির স্বপ্ন না দেখাই ভালো। জামীর ছোটো চাচির বড়ো বোনের ছেলে মিষ্টি। ভালো নাম জারিফ জাহিদ। মিষ্টি চেহারা এবং মুখখানা হাসি ভরা তাই সবাই মিষ্টি বলে ডাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারি পরিচালক পদে চাকরিরত। অমায়িক ব্যবহার।
কত বছর আগের কথা। সবেমাত্র ছোটো চাচার বিয়ে হয়েছে। ছোটো চাচির সাথে তার বড়ো বোনের বড়ো ছেলে মিষ্টি ভাইয়ের আগমন। তখন জামীর বয়স বছর ছয় হবে। একজন হাই স্কুলে, অপর জন প্রাইমারিতে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে দু’জনের মধ্যে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব। এরমধ্যে চাচির প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠে জামী। মিষ্টি এসএসসি পাস করার পর তাদের মধ্যে ক্রমশ দূরত্ব বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন পর আবার দেখা। এটা সম্ভব হয়েছে ছোটো চাচির জন্য। ছোটো চাচির ছোটো চিঠিতে, “জামী ঢাকায় যাচ্ছে। তার জন্য কিছু করতে পারলে খুশি হবো। ইতি ছোটো খালা।” চিঠিখানা হাতে পেয়ে মিষ্টি বেশ ক’বার পড়ে জামীর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল,
— মিস্টার মোহাম্মদ জামী, চাচাতো বোনের বয়স কত?
জামী মিষ্টির প্রশ্ন শুনে উত্তর না দিয়ে কৌতূহলী হয়ে মিষ্টির চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,
— বুঝতে পারলাম না। এখানে চাচাতো বোনের প্রশ্ন আসছে কেন? তাছাড়া বেনু তো এসএসসি পরীক্ষা দিবে।
— অসুবিধা নেই। বিখ্যাত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ আবু সায়ীদ আইয়ুবের কথা শুনেছে?
— হ্যাঁ, শুনেছি।
— তাঁর স্ত্রীর নাম গৌরী। তাদের দু’জনের বয়সে ব্যবধান কত ছিল তা কি জানো?
এবার সবগুলো দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল,

— থাক ও সব। ছোটো খালার আদেশ মানতেই হবে। আগামী সপ্তাহে এসে একটা খবর নিয়ে যাবে। মেসে থাকা চলবে না। এক রুমবিশিষ্ট একটা বাসা খুঁজে নিবে এই মাসের মধ্যে। একাডেমিক পরীক্ষায় পাশ করা আর চাকুরি পরীক্ষায় পাশ করা এক বিষয় নয়।

আরও পড়ুন গল্প খোয়ার

মিষ্টি ভাইয়ের পরামর্শে একটা বাসার জন্য মাঠে নেমেছে । মিষ্টি ক’টা এলাকার নাম বলেছে। এলাকাগুলো জামীর কিছুটা পরিচিত। আসলে মেসে পড়াশোনা করার মতো পরিবেশ নেই এটা সত্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পিছনে অনেকগুলো নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে। বেশ ক’টা টু-লেট দেখেছে কিন্তু তারা ব্যাচেলারকে ভাড়া দিতে রাজি নয়। মনটা খারাপ হয়ে যায় জামীর। তখনো সূর্য লাল রঙে রঙিন হতে আর বেশি দেরি নেই। একটা গলির ভেতর হাঁটছে আর রাস্তার লাইটপোস্টের দিকে চোখ রাখছে। যদি টু-লেট চোখে পড়ে। হঠাৎ অস্পষ্ট একটা সাইনবোর্ডের দিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়ায়। এক রুম ভাড়া হবে। টেলিফোন নম্বর দেওয়া নেই, তবে বাসার ঠিকানা লেখা আছে। সামনে একটা চায়ের দোকান। কাছে গিয়ে জানতে চায় জামী। চায়ের দোকানদার একটু বিরক্তিবোধ করল। দু’বার জিজ্ঞাসা করার পর আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল। ধন্যবাদ দিয়ে জামী বাসার সন্ধানে পা বাড়ায়।

মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ পড়ে দোতলা একটা জীর্ণশীর্ণ পুরানো বাড়ির ওপর। আশেপাশে সারিসারি চার-পাঁচ তলা সুন্দর অট্টালিকা। এ যেন সুন্দরী সাজগোছ করা মহিলাদের মধ্যে বেমানান একটা অজপাঁড়া গাঁয়ের বঁধু দাঁড়িয়ে আছে। মনের ভেতরে অনেক দ্বিধা নিয়ে গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর যাহোক কলিং বেল ঠিকই আছে। সাহস করে কলিং বেলের ওপর ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে একটা জোরে চাপ দিয়ে ছেড়ে দিল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে একজন যুবক এসে গেট খুলে জানতে চাইল,
— বাসা ভাড়া নিবেন?
— জি।
— ভেতরে চলুন।

গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই জামীর ধারণা পাল্টে গেল। বাইরে হতে জীর্ণশীর্ণ পুরানো বাড়ি মনে হলেও ভেতরে অন্যরকম। সামনে ছোটো জৌলুসহীন বাগান। দীর্ঘদিন পরিচর্যা করা হয় না। এককালে বাগানটির কদর ছিল। যত্নের অভাবে শ্রীহীন। ছেলেটির পিছনে হাঁটতে থাকে। সামনে আর একটা গেট। গেট পার হয়ে ঢুকতেই মাঝারি ধরনের অগোছালো ড্রইংরুম। ব্যবহার কমই হয় এমনটা মনে হলো জামীর। ছেলেটি একটা সোফা দেখিয়ে বসতে বলে ভেতরে পা বাড়ায়।

আরও পড়ুন গল্প দীপ্তিদের দেবতা

জামী চারদিকে তাকিয়ে অপরিষ্কার সোফায় বসল। প্রায় মিনিট দশেক পর একজন মহিলা এসে রুমে ঢুকল। বয়স আন্দাজ করা কঠিন। তবে দেখতে সুশ্রী মার্জিত। পরনে সূতিশাড়ি। আঁচলের একাংশ দিয়ে মাথার অর্ধেকাংশ ঢাকাশ; চোখে মুখে স্মৃত হাসি রেখা। তবে কোথায় যেন একরাশ দুঃখ লুকিয়ে আছে সারা চেহারায়। জামী উঠে সালাম দিল। মহিলা তাকে বসতে বলে নিজে একটা সোফায় বসল।
— ছোটো একটা রুম ভাড়া হবে।
— আমার ছোটো রুমের দরকার।
— ক’জন থাকবেন?
জামীর মনে সন্দেহের দানা বেঁধে ওঠে। ব্যাচালারকে ভাড়া দিবে তো? তবে সে সত্য কথা বলবে।
— জি। আমি একাই থাকব।
— ঠিক আছে, আগে দেখুন। পছন্দ হলে বাকি কথা হবে।
জামী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। একটু আশার আলো মনের ভেতরে জ্বলে উঠল।

ড্রইং রুমের যে দরজা দিয়ে ডুকেছিল সেই দরজা দিয়ে ভদ্রমহিলা আগে পা বাড়াল, পিছে জামী। বের হতেই ডান দিকে সোজা বাসার শেষ প্রান্তে ছোটো একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়াল দু’জন। দরজায় পুরাতন মরিচা ধরা ছোটো একটা তালা ঝুলছে। দেখে মনে হলো বেশ কিছুদিন এর গায়ে হাত পড়েনি। কি জানি ভেতরের অবস্থা হবে। শত চিন্তা মাথার ভেতরে ঘোরপাক খাচ্ছে। খট করে শব্দে তালা খুলে ভেতরে ঢুকল মহিলা। একটা উটকো বাতাস রুম থেকে বের হলো।

জামীর ধারণা ঠিকই, বেশ কিছু দিন ধরে রুমটা বন্ধ। রুমের চেহারা দেখে হাইস্কুলের অঙ্কের শিক্ষক সুবোধ ঘোষের কথা মনে পড়ে গেল। “যাহার চারটি বাহু সমান তাহাকে বর্গ বলে।” রুমটার অবস্থা ঠিক তেমনি। তবে খারাপ নয়। ছোটো একটা খাট, পাশে ছোটো টেবিল এবং চেয়ার। দেখে আরও আশ্চর্য হয়ে গেল বইবিহীন বুকসেলফ। মনে হয় রিডিং রুম হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল তা একটু নিরিবিলিতে। এমনও হতে পারে, এ বাসার কেউ লেখক ছিল। হয়তো এখানে এখন থাকে না। তাই ভাড়ায় চলে।

আরও পড়ুন গল্প তবুও ভালোবাসলাম

মুখ খুলল মহিলা।
— এই হলো রুম। পছন্দ হলে ভাড়ার বিষয়টি আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে। পরিষ্কার করে দেওয়া হবে। চিন্তা করবেন না বাথরুমের ব্যবস্থা আছে। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না আশা করি। আগেই ভাড়ার কথা বলে নেই। বিদ্যুৎ-পানিসহ সাড়ে তিন হাজার টাকা। কোনো অগ্রীম দিতে হবে না। বাসায় উঠে ভাড়া দিলেই চলবে।

জামী ভাবতেই পারেনি এত সহজে এত অল্প ভাড়ায় এমন একটা নিরিবিলি রুম পেয়ে যাবে। তবে তার মনে একটা সন্দেহের দাঁনাবেঁধে উঠল। বাসাটা কেমন যেন শুনসান নীরব। একটা ছেলেকে দেখা মিলল, তারপর এই মহিলা। তবে মহিলার আচরণে কোনো খারাপ ইঙ্গিত নেই। সোজাসাপ্টা কথা।
— রাজি। আগামী মাসের প্রথম দিন উঠতে চাই। আজ কি অগ্রীম বাবদ কিছু টাকা দিতে পারি?
— দরকার হবে না।
— তাহলে এবার আসতে পারি।

সপ্তাহ খানেক হলো মোহাম্মদ জামী তার পছন্দের ভাড়া বাসায় উঠেছে। মিষ্টি ভাইকে অবগতি করেছে। এবারও তার রসিকতা।
— ছোটো ভাইয়া, বাসায় কোনো যুবতীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে?
জামীও কম যায় না।
— এখন পর্যন্ত সাক্ষাৎ হয়নি।

অসুবিধার মধ্যে খাওয়া দাওয়া। গলিতে বেশ ক’টা খাবারের হোটেল আছে তবে উন্নতমানের নয়। মধ্যম পর্যায়ের হোটেল। এ ক’দিনে সকালের নাস্তা হতে শুরু করে রাতের খাবার খেয়ে দেখেছে সপ্তাহে কত খরচ পড়ে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সংগতিপূর্ণ কি না। তিনটি টিউশনিতে গড়ে বারো হাজার টাকা আয়। কিন্তু হোটেলে খেতে গেলে স্বাস্থ্যের বারোটা বেজে যাবে। বেশ ক’দিন কেটে গেল। সেই যে বাসায় উঠার সময় মহিলার সাথে দেখা এবং কথা হয়েছিল, এরপর হতে আজ অব্দি আর সাক্ষাৎ হয়নি। জামীও আগ্রহ দেখায়নি। মাঝেমধ্যে সেই ছেলেটির সাথে গেটের সম্মুখে দেখা হয়। কোনো বিশেষণ চোখে পড়েনি জামীর। এমনকি কোনো সৌজন্যমূলক সালাম বিনিময় হয়নি। এ বাসায় এই দু’জন প্রাণী ব্যতিত অন্যকোনো প্রাণী আছে কি না এখনো চোখে পড়েনি। তবে কালো বর্ণের একটা বিড়ালের সাথে দেখা হয়েছে। দোতলায় ভাড়াটিয়া আছেন; এটা জামীর রুম হতে দেখা যায়। কিন্তু নীচতলা কেমন যেন নিস্তব্ধতা এবং রহস্যময়ে আবৃত।

আরও পড়ুন চোখের আলোয় দেখেছিলেম-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

চোখের আলোয় দেখেছিলেম (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল একজন কবি ও কথাসাহিত্যিক। তিনি নিয়মিত 'আমাদের সুজানগর' ওয়েব ম্যাগাজিনে লেখালেখি করেন। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে, এক কিশোরীর প্রেম, ভোরের কৃষ্ণকলি; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা; কবিতাগ্রন্থ: জোছনায় রেখে যায় আলো। তিনি ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের বোনকোলা গ্রামে তাঁর নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস একই উপজেলার হাটখালি ইউনিয়নের নুরুদ্দিনপুর গ্রামে।

error: Content is protected !!