ঘুরে এলাম পর্তুগাল (শেষ পর্ব)
ঘুরে এলাম পর্তুগাল (শেষ পর্ব)
তাহমিনা খাতুন
রাজী রাতেই আমাদের নিয়ে গেল আটলান্টিকের পাড়ে, যেখান থেকে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা তাঁর সমুদ্র যাত্রা শুরু করেছিলেন।ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৭-১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইউরোপ মহাদেশ থেকে এশিয়া মহাদেশে পৌঁছার জল পথ আবিষ্কার করেন। এ কাহিনী ইতিহাস পাঠে আগ্রহী পাঠক মাত্রেরই কম-বেশী জানা। এই জলপথ আবিষ্কার আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে ভারত মহাসাগরের জলপথকে যুক্ত করে। ভাস্কো-ডা-গামা কর্তৃক এই জলপথ আবিষ্কার পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিশাল ঘটনা! এই আবিষ্কার সমুদ্রপথে বহুজাতিক সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদের পথ খুলে দেয়। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে পর্তুগীজদের আফ্রিকা থেকে শুরু করে এশিয়া পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য সৃষ্টিতে সাহায্য করে
লিসবনের যে স্থান থেকে আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে গামা তাঁর সমুদ্র যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেখানে তার পাশেই জেরোনিয়াম মোনাস্ট্রি নামে একটি গির্জা। এই গির্জার ভিতরেই ভাস্কো-দা-গামার সমাধি। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো-দা-গামা ভারতের কালিকট বন্দরে পৌঁছান এবং কালিকটের রাজাকে কিছু উপঢৌকন দিয়ে ব্যবসা করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু রাজাকে দেয়া উপহার সামগ্রীর মধ্যে সোনা, রুপা, মনি-মানিক্য না থাকায় রাজা বিরক্ত হয়ে ভাস্কো-দা-গামার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পাঁচ বছর পর গামা ১৫০০ জাহাজ এবং ৮০০ সশস্ত্র জনবলের এক বাহিনীসহ কালিকটে ফিরে আসেন এবং বর্বরোচিত ভাবে কালিকটের রাজাকে পরাস্ত করেন।
১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের সম্রাট ৩য় জন তাঁকে ভারতের (যে সমস্ত এলাকা পর্তুগীজদের দখলে ছিল) গভর্নর পদে নিয়োগ দেন। সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস সব উপনিবেশেই কম-বেশী একই রকম! ভাস্কো-দা-গামা ভারতবর্ষে পৌঁছার ফলে ভারত বর্ষ তথা বাংলায় এক দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তক্ষয়ী যুগের সূচনা করে। পর্তুগীজ এবং আরাকান মগদের দ্বারা গঠিত জলদুস্য কর্তৃক বারবার স্থানীয় জনপদে হামলা এবং লুঠতরাজ বাংলার জনজীবনে ব্যাপক অশান্ত পরিবেশ তৈরী করে। এদের নির্মূল করতে ভারত বর্ষের বিভিন্ন সুলতান এবং পরবর্তীতে মোগল সম্রাটদেরও বেশ বেগ পেতে হয়েছিল!
আরও পড়ুন ভ্রমণ কাহিনী নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেশে
ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, নতুন জলপথ আবিষ্কার করে নতুন ভূখন্ড আবিষ্কার এবং তার দখল নেওয়ার অর্থই হল নতুন অধিকৃত ভূখন্ডের অধিবাসীদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালানো। ভাস্কো-দা-গামার ভারতের জলপথ আবিষ্কার অথবা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার একই বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতার ইতিহাস! ভাস্কো-ডা-গামা কর্তৃক জলপথ আবিষ্কারের ফলে পর্তুগীজরা ১৫২৮-১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থান করে এবং চট্টগ্রামকে সম্ভবতঃ পর্তুগালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় শহর পোর্তোর সাথে মিল রেখে পোর্তো-গ্রান্ডে বাংলা নামে অভিহিত করতো! এটি ছিল বাংলার ঐতিহাসিক অঞ্চল যেখানে ইউরোপীয়রা ১ম উপনিবেশ স্থাপন করে। বর্তমান চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজার এক সময়ে ছিল পর্তুগীজদের গুরুত্বপূর্ণ ফিরিঙ্গি বন্দর! ভাস্কো-দা-গামা তৎকালীন চট্টগ্রাম ভ্রমণ করেছিলেন বলে জানা যায়। ভারতবর্ষে দীর্ঘস্থায়ী ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার খলনায়ক ভাস্কো-দা-গামা পর্তুগালে একজন বীর এবং বীরের মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে!
ভাস্কো-দা-গামার সমাধিস্থল দেখা শেষ করে আমরা গেলাম বেলেম টাওয়ার দেখতে। পর্তুগীজ ‘torre-de-belem’ বা বেলেম টাওয়ারকে সেইন্ট ভিনসেন্ট টাওয়ারও বলা হয়। ৯৮.৪ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট চার তলা টাওয়ার! পর্তুগীজ রেনেসাঁর যুগে (১৫০০-১৭০০ খ্রি.) নির্মিত। ওই সময়েই পর্তুগীজ নাবিকেরা নতুন নতুন জলপথ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে সমুদ্র যাত্রা শুরু করেছিলেন। লিসবনের ‘বেলেম টাওয়ার’ মূলতঃ ছিল একটি দূর্গ। এটি ছিল পর্তুগীজ নাবিকদের জাহাজ নিয়ে ভ্রমণ শুরু করার এবং ভ্রমণ শেষে ফেরার একটি আনুষ্ঠানিক স্থান! ‘বেলেম টাওয়ারের’ চূড়ায় ওঠার জন্য লিফটেরও ব্যবস্থা আছে।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
সিনত্রা প্যালেস বা টাউন প্যালেস লিসবনের একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। এটি বিশ্বখ্যাত প্রাচীন রাজপ্রাসাদ গুলির অন্যতম। মধ্যযুগে ৪৮০ মিটার উচ্চতার এক পাহাড়ে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মধ্যযুগে এ প্রাসাদ নির্মাণে আফ্রিকার মুসলিম মুরীয় শাসকসহ অনেকের অবদান রয়েছে। পায়ে হেঁটে অনেকটা পথ অতিক্রম করে ৪৮০ মিটার প্রাসাদের চূড়ায় ওঠা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। এজন্য বাসের ব্যবস্থা আছে। কিছু বাড়তি পয়সার বিনিময়ে বাস প্রাসাদের কাছাকাছি স্থানে নামিয়ে দেয়। এরপরও প্রাসাদের অভ্যন্তরে পৌঁছার জন্য বক্রাকার রাস্তা ধরে যেভাবে উপরে উঠতে হয়, তাতে রীতিমত হিমশিম খাওয়ার অবস্থা! ভাবলে অবাক হতে হয়, সে সময় রাজা-বাদশারা কিভাবে পাহাড়ের এত উপরে বসবাস করতেন! তবে কষ্ট করে একবার উঠতে পারলে কষ্ট সার্থক মনে হয়! কক্ষগুলো তেমন বড় নয়, তবে দেয়াল এবং ছাদের অভ্যন্তরের নকশা অসাধারণ শৈল্পিক! রাজাদের ব্যবহৃত বিছানা, আসবাবপত্র, বহু প্রাচীন তৈজসপত্র ইত্যাদির দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে!
বোকা-দো-ইনফার্নো বা মাউথ অব হেল (নরকের মুখ) লিসবনের সমুদ্র তীরবর্তী কাশকায়েশ নামক এলাকায় অবস্থিত। পর্যটকদের নিকট এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এক দর্শনীয় স্থান। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আটলান্টিকের ঢেউয়ের আঘাতে কঠিন শীলা ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে এমন এক গহ্বর তৈরি হয়েছে, মনে হয় ডুবন্ত এক গুহা, যেখানে সমুদ্রের ঢেউ এবং বাতাসের সম্মিলনে এমন এক ভীতিকর অবস্থা তৈরি করেছে, যা আসলেই অবিশ্বাস্য! আমাদের গাড়িচালক মি. নুনোর কাছে জানা গেল বোকা-দো-ইনফার্নো বা নরকের মুখ স্থানটিকে অবলম্বন করে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে হেনরী শর্ট নামে একজন ব্রিটিশ চলচ্চিত্রকার ১৩ সেকেন্ডের একটি সংক্ষিপ্ত নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।
আরও পড়ুন গল্প সময়ের পাঁচফোড়ন
পর্তুগালের তাগুস ইউরোপের দীর্ঘতম নদী। এই নদীর উপরে ২২৭৭ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট চমৎকার ঝুলন্ত সেতুটি ইউরোপের দীর্ঘতম ব্রীজ! এর নামটিও বেশ অদ্ভুত! ২৫ এপ্রিল ব্রীজ! ম. নুনো আমাদেরক এই সেতুর উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এর ইতিহাস জানালেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের তৎকালীন একনায়ক প্রধানমন্ত্রী এন্টোনিও দ্য অলিভিয়েরা সালাজারের-যিনি ৩৬ বছর যাবত পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন- নিজের নামে সেতুটির উদ্বোধন করেন। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ২৫ এপ্রিল এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সালাজারের পতন হলে সেতুটির নামকরণ হয় ২৫ এপ্রিল ব্রীজ। সেতুটির অপর প্রান্তে স্থাপন করা হয়েছে Sanctuary of the Christ the King নামে এক স্মৃতিস্তম্ভ! ২য় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে পর্তুগাল রেহাই পাওয়ার কারণে এই পবিত্র স্মৃতি স্তম্ভটি স্থাপন করা হয়। এটি ২৬৯ ফুট উচ্চ এবং ৯২ ফুট প্রশস্ত।
লিসবন ভ্রমণ করতে গিয়ে এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আটলান্টিক মহাসাগরের বালুকাবেলায় হাঁটতে না পারলে ভ্রমণটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে! কাজেই আটলান্টিকের তীরে যাওয়া হল। এর সাদা বালুকাময় সৈকত অপূর্ব। অসংখ্য গাংচিল হুটোপুটি করছে। অনেকটাই শান্ত সমুদ্র! লোকজন সার্ফিং করছে!
সমুদ্র বা পাহাড়ের ধারে গেলেই বোধ হয় নিজেদের ক্ষুদ্রতা সম্মন্ধে একটা উপলব্ধি আসে! আর আটলান্টিক তো দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসাগর!
পর্তুগাল কেবল তার আশ্চর্যজনক সৌন্দর্যের জন্যই নয়, এর মৌলিকতার জন্যও ইউরোপের অন্য অনেক দেশ থেকেই ভিন্ন! এই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে ভরা দেশটি দেখার সুযোগ পেয়ে যারপরনাই আনন্দে আপ্লুত হলাম-সন্দেহ নাই।
আরও পড়ুন ঘুরে এলাম পর্তুগাল-
১ম পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
ঘুরে এলাম পর্তুগাল (শেষ পর্ব)