একটি-মিষ্টি-স্বপ্ন
গল্প,  শাহানাজ মিজান,  সাহিত্য

একটি মিষ্টি স্বপ্ন

একটি মিষ্টি স্বপ্ন

শাহানাজ মিজান

বাসার ভেতর বসে থাকতে-থাকতে বিরক্ত লাগছিল। আম্মা বারবার বলছেন, বাহির থেকে একটু ঘুরে আসতে । তবে একা একা বাইরে যেতেও ভাল লাগছেনা। এই করোনাকালীন সময় বুঝিয়ে দিয়েছে, পৃথিবীতে সত্যি সত্যিই কেউ কারো না। আনমনে ল্যাপটপটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, উদ্দেশ্য তিনশোফিট। জায়গাটা বেশ দারুণ। আমি যে বাসায় থাকি ঠিক তার অদূরেই। বাবার সঙ্গে একবার গিয়েছিলাম। ঘরে একা থাকতে বিরক্ত লাগছিল, আবার এখানে এতো মানুষের ভিড় দেখেও বিরক্ত লাগছে।

যা হোক একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসলাম। ইচ্ছে না হলেও ল্যাপটপটা চালু করে কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করলাম। কখন যে কাজের মধ্যে ডুবে গিয়েছি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ চুলে টান লাগায় মেজাজ খারাপ করে পেছনে তাকিয়ে দেখি, তিন চার বছরের একটা মিষ্টি বাচ্চা আমার দিকে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুহূর্তে আমার মন ভালো হয়ে গেল। মৃদুস্বরে তাকে কাছে আসতে আহ্বান করলাম।

সে কাছে এসে বলছে, ‘মামমাম, ওটা আমার।’ ওহ হো, আমি তো এতক্ষণ খেয়ালই করিনি, ওর ছোট্ট রঙিন ঘুড়িটা আমার মাথায় চুলের সঙ্গে আটকে আছে। মাথা থেকে ঘুড়িটা ছাড়িয়ে ওর হাতে দিলাম। কোলে বসিয়ে আদর করছি, ওর বাবা কোথা থেকে যেন দৌড়ে এলেন। মেয়েটি কে বলল,

__আনটিকে থ্যাংকস বলো।

ও আমাকে থ্যাংকস বললো। ওর নাম রায়া। ওর বাবার সঙ্গেও পরিচয় হলো, ভদ্রলোকের নাম তানভীর রানা। তিনি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আছেন। আমার কথা জিগ্যেস করাতে আমিও হেসে উত্তর দিলাম, আমি আনিশা রহমান। প্রফেশনের দিক থেকে আমরা দুজনেই এক। আমিও টিচার। ইমপেরিয়ালে আছি। এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা হল দু’জনের মধ্যে। সময়টা ভীষণ ভালো কাটলো। সন্ধ্যা হয়ে আসল। ভদ্রলোককে বিদায় জানিয়ে আমি ল্যাপটপ ব্যাগে ভরে প্রস্থান করলাম।

আরও পড়ুন গল্প উপলব্ধি

সে রাতে আমার চোখে রায়ার মিষ্টি মুখটা ভেসে উঠল । রায়ার টানে পরদিন আবার গেলাম। আমার চোখ শুধু রায়াকে খুঁজতে লাগলো। পেছন থেকে রানা সাহেব অযাচিত ডাক দিলেন, আমি চমকে উঠে পেছনে তাকালাম।

রায়া আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। কোলে নিয়ে আদর করলাম। এমনি করে প্রায় প্রতিদিন যেতাম। একটি অলীক মায়া তৈরি হয়েছিল।

গল্পে গল্পে অনেক কিছু জানা হল।

রানা সাহেব বললেন,

__রায়াকে জন্ম দিতে গিয়ে ওর মা মারা যায়। সেই থেকে আমিই ওর বাবা-মা। বিধবা এক ফুপু আমাদের সঙ্গে থাকেন। কিছুদিন হলো তিনি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। এখন ভার্সিটিতে ক্লাস হচ্ছে না। আমারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, মেয়েটা নিয়ে সময় কেটে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন ছোট গল্প কথোপকথন

আমাদের পরিচয়ের প্রায় দু’মাস কেটে যাচ্ছে। হঠাৎই ছন্দপতন। আজ ওরা আসেনি। ঠিকানা, ফোন নম্বর আছে। ফোনে শুনলাম, রায়ার জ্বর। শুনেই অস্থির লাগছে। ওদের বাসায় চলে গেলাম। রায়ার মাথায় জলপট্টি দিয়ে সারা গা মুছিয়ে বুকের সাথে আগলে ধরলাম। ও ঘুমিয়ে গেলে, চলে এলাম। সারারাত আমি ঘুমাতে পারি নি। সকাল হতেই আবার বেরিয়ে গেলাম। তিন দিন পর জ্বর নেমে গেল কিন্তু আমার ভেতরে অস্থিরতা যাচ্ছে না। একদিন আমার ভেতরে যেন আমি ছিলাম না। আম্মা আর বাবা এটা খেয়াল করেছেন।

আম্মা বললেন,

__আনিশা, তোমার কি হয়েছে, বলতো? কিছুদিন ধরে লক্ষ্যে করছি, তুমি বেশ অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছো। তুমি বাসা থেকে বের হওয়া পছন্দ করো না, অথচ যখন তখন বাইরে চলে যাচ্ছো। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছোনা।

__বলবো, আজ ঘুরে এসে বলবো।

আজ রানা সাহেবের সাথে সরাসরি কথা বললাম,

__আমি রায়ার মা হতে চাই।

__কি পাগলামি করছেন? এটা কি করে হতে পারে?

__দেখুন, আমি বাচ্চা মেয়ে নই। সবদিক ভেবেই বলছি। আর আমার মনে হয়, আমার মতো আপনিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন।

__অস্বীকার করছি না, কিন্তু আপনার পরিবারের কেউ এটা মানবেনা।

আরও পড়ুন ছোট গল্প পাথরে ফুল

আমি বাড়িতে এসে সবকিছু বললাম। আম্মা চুপচাপ থাকলেও, বাবা, রেগে আগুন।

__তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। তোমাকে স্বাধীনতা দিয়েছি। উচ্চ শিক্ষা দিয়েছি। তার মানে তুমি এমন একটা কাজ করবে আর আমাদের সেটা মেনে নিতে হবে, কক্ষনও না।

ক’দিন পার হলো, আমি রায়ার কাছে যেতে পারছি না না। কান্না-কাটি করছি। আম্মা বাবাকে বোঝাতে গেলেন,

__দেখুন, মেয়ে বড় হয়েছে। ভালো মন্দ বুঝতে পারে।

__তাই বলে একটা বাচ্চা আছে, এ রকম একটা ছেলের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দেব, এটা কী করে হয়?

__একটি অবুঝ দুধের বাচ্চা, তোমার মেয়ে যদি সেটা মেনে নেয়, আর ছেলে হিসেবে আমার মনে হয়েছে রানা খুবই ভালো। তোমার এতো আপত্তি করার দরকার নেই। দেখ, আমাদের কাছে ওর ভালো থাকা, সুখী থাকাটাই জরুরি। তুমি আর আপত্তি করো না।

পরেরদিন রানা রায়াকে নিয়ে আমাদের বাসায় এলো। সঙ্গে ওর ফুপুও এসেছেন। আম্মা একবার রানার সাথে ফোনে কথা বললেও, বাবার সাথে আজকে ওর প্রথম দেখা হল। সালাম বিনিময়ের পর বাবাকে দেখে মনে হল, তিনি রানাকে পছন্দ করেছেন। রায়ার মুখটি এতো মায়াবী যে, কেউ দেখলেই ওকে ভালো না বেসে থাকতে পারবে না। বাবা, রানার কোল থেকে রায়াকে কোলে নিয়ে নানুভাই নানুভাই বলে আদর করতে লাগলেন। আম্মা আর ফুপু হাসিমুখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি আর রানা দু’জন দুজনের দিকে চেয়ে রইলাম।

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

একটি মিষ্টি স্বপ্ন

Facebook Comments Box

শাহনাজ মিজান গল্প ও উপন্যাস লেখেন। প্রকাশিত উপন্যাস: অধরা চাঁদ; গল্পগ্রন্থ: আকাশে চাঁদের পালকি তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!