ঊর্মিমালা-২য়-পর্ব
গল্প,  শাহানাজ মিজান,  সাহিত্য

ঊর্মিমালা (২য় পর্ব)

ঊর্মিমালা (২য় পর্ব)

শাহানাজ মিজান

 

কোনোরূপ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই, আমার প্রতিবেশীদের মধ্যে দু-চারজন মুরুব্বি আর ওদের পক্ষের অল্প সংখ্যাক আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে আমাদের বিয়ে হলো।
শিকদার সাহেব বললেন, বিয়ে উপলক্ষ্যে বড় অনুষ্ঠান হবে, আমাদের মাস্টার্স পড়া শেষ হলে। এত দিন যেন আমরা ভালোভাবে লেখাপড়া করি।
আমার ভাঙা ঘরের পাট শোলার বেড়ার সাথে নতুন হলুদ শাড়ী, পেটিকোট, ব্লাউজ ছড়ানো। সকালে সূর্য ওঠার আগেই, ঊর্মির পিঠে ছড়িয়ে থাকা ভেজা চুল, তড়িঘড়ি করে করে আমার জন্য নাস্তা বানানো, বাড়িতে নতুনত্বের আলাদা একটা গন্ধ বাতাসে ভাসছে কিন্তু কোনোকিছুই আমার মনে কোন রকম দাগ কাটছে না। বরং, আমার সামনে ঊর্মিকে এমন ভাবে ঘুরতে দেখে, আমার রাগের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আমার মনে যাই থাক, মায়ের মুখের হাসি রক্ষা করতে, খুব কষ্টে রাগ সংবরন করছি। বার বার শুধু মনে হচ্ছে, শিকদার সাহেব আমার গলায় এমন একটা কাঁটা না বিধিয়ে দিয়ে, এমনিতেই সাহায্য করতে পারতেন। যেমনটা তিনি করে থাকেন। গ্রামের সবার বিপদেই তিনি সাহায্য করেন, তাহলে আমার বেলায় এমন কেন করলেন?

মায়ের অপারেশন করা হয়েছে। এখন প্রায় পুরোপুরি সুস্থই বলা যায়। সংসারের প্রয়োজনীয় কোনো কাজ বা কথা ঊর্মি বলে, আমি শুনি। কিংবা আমার প্রয়োজনের কথা ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে মাকে বলি। তাছাড়া স্বামী স্ত্রী হিসেবে কত ধরনের, কত কথা থাকে, সে সব কোনো কথা ওর সাথে বলা হয় না।
পরীক্ষার ফলাফলও বের হয়েছে। আমি চার পয়েন্ট পেয়েও জানিয়ে দিলাম, ঢাকার কোনো ভালো কলেজ বা ভার্সিটিতে পড়বো। আসল উদ্দেশ্য হলো, এখানে আমার মন বিষিয়ে উঠেছে। আমি এই চিরচেনা পরিবেশ থেকে, সবার চোখের আড়ালে থাকতে চাই। আর ঊর্মি জিপি ফাইভ পয়েন্ট পাওয়ার পরও বললো, আমাদের পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে পড়বে। এতে করে বাড়িতে থেকেই ক্লাস করতে পারবে, আর মাকেও দেখাশোনা করতে পারবে।

আরও পড়ুন গল্প একজন অনন্যা

আমি এখন ঢাকা তিতুমীর কলেজের ছাত্র। ঢাকার লাল নীল আলোর ঝলকানিতে নিজেকেই বদলে ফেলেছি। নিজের মনে নিজেই ভেবে আশ্চর্য হই- পৃথিবীতে টাকার কত শক্তি, টাকা সবকিছু বদলে দেয়, টাক, হায়রে টাকা! আমার চেহারা চালচলন আর সকাল সন্ধ্যায় বাহারী পোশাকের বদলে, কলেজের সবাই জানে আমি ধনীর ঘরের দুলাল। এখন আমি নিজেই নিজেকে চিনতে পারি না।
দিনে দিনে, ছেলে বন্ধুদের থেকে সুন্দরী মেয়ে বন্ধুর সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকলো। চিন্তা-ভাবনাহীন জীবন আমার। আজ চায়নীজ রেস্টুরেন্টে যাই তো কাল কোনো ফাইভস্টার হোটেলে।
হৈ হৈ রৈ রৈ করতে করতে দিন, মাস, বছর চলে যাচ্ছে। বছর শেষে একবার বাড়িতে গিয়েছিলাম। দেখলাম আমার বাড়িরও আমূল পরিবর্তন। প্রথমে দেখে তো চিনতেই পারিনি। আমার ভাঙা ঘরের জায়গায়, বড় বড় চার কামরার ইট পাথরের বিল্ডিং। মায়ের ঘরের সাথে বাথরুম ছাড়াও দুটো আলাদা বাথরুম, বড় রান্নাঘর, ড্রয়িং রুম, রিডিং রুম, আসবাবপত্রে ঠাসা এবং সাজানো গোছানো। ভেতরে গেলে মনে হবে, শহরের কোনো বাড়িতে আছি।
দেখলাম, দারিদ্র্য ক্লিষ্টতায় ভেঙে যাওয়া শরীরের আমার মা, তারও শরীর স্বাস্থ্য বেশ ভালো হয়ে গেছে। মায়ের বয়স যেন দশ বছর কমে গেছে। পরের বাড়িতে কাজ করা আমার মায়ের জন্য, আলাদা কাজের মানুষ। আমার মা, চামড়ার স্যান্ডল পায়ে, ছাদের উপর বসে, শীতের রোদ পোহায়।
মনে মনে ভাবলাম, এমন জীবনই তো মা চেয়েছিলো। মায়ের সাথে ঊর্মির সখ্যতা বেশ মজবুত। সবকিছু দেখে খুব ভালো লাগলেও ঊর্মির জন্য কোনো আলাদা অনূভুতি আমার মনের কোথাও দেখতে পেলাম না।
ঢাকা শহরের আবহাওয়া প্রতিনিয়ত বদলায়। সেই সাথে আমার মনটাও এতোটাই বদলে গেছে যে, তৃষ্ণার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলো। দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসি। তৃষ্ণাকে না দেখলে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু মাঝে মাঝে ওর সাজগোজ, পোশাকের ধরন, বিশেষ ভালো লাগে না। তবুও মেনে নেই যে, শহরের আধুনিক মেয়ে, এমন তো একটু হবেই।
আমরা ঠিক করে নিলাম, আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষে আমরা বিয়ে করবো।
আর মাত্র তিন মাস পরে ফাইনাল পরীক্ষা।

আরও পড়ুন গল্প লালু

সেদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে, তৃষ্ণাকে অন্য একটি ছেলের সাথে রিকশায় যেভাবে ঘুরতে দেখলাম, তাতে মাথার মধ্যে অন্য চিন্তা এলো। মাঝে মাঝে অনেকেই বলেছে, মেয়েটা ভালো নয়। আমি যেন তার সাথে বন্ধুত্ব না রাখি। কারো কথায় কান দিইনি কিন্তু আজ নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কি করে? মাথাটাও কেমন ব্যাথা করছিলো, রুমে এসে শুয়ে পড়লাম।

ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, আমার রুমমেট এবাদ আলীর ডাকে ঘুম ভাঙলো। ছেলেটা ভীষণ ভালো। আমার দুই ইয়ার জুনিয়র। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে থাকার জায়গা ছিলো না, তাই আমি আমার রুমে ওকে থাকতে দিয়েছি। মাঝে মাঝে ও রান্না করে। ওর হাতের রান্নাও দারুণ। পাতলা ডাল, সাথে আলুভর্তা আর ডিম ভাজি, ভীষণ ভালো লাগে।
খাওয়ার পরে এবাদ আলী তৃপ্তির ঢেকুর তুলে হাসিমুখে বলে
──ভাই, দেখছেন কি মজার খাবার! এমন খাবার পৃথিবীর কোন রাজা-বাদশাও খায়নি।
আমিও ওর সাথে হাসি। ছেলেটার চোখে মুখে দারিদ্র্যতার ছাপ, তবু ওর হাসিটা খুব সুন্দর।

আসলে দারিদ্রতার বোঝা যার ঘাড়ে থাকে, সে ইচ্ছে করলেই মাথা উচু করে কারো সাথে কথা বলতে পারে না। এ কথা আমার চেয়ে ভালো কে বুঝবে।
এবাদ আলী, আমার সবকিছুই বোঝে, কিন্তু কিছু বলে না। লেখাপড়া আর টিউশনিতে সারাদিন রাত কেটে যায়। আবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, কোন কিছুতেই কোনো ক্লান্তি নেই। প্রতিদিন বাবা-মা-ভাইবোনের সাথে কথা বলে, চোখের পানি মোছে। তখন আমারও মনটা খারাপ হয়ে যায়। আমি তো নিজেকে মিথ্যের খোলসে আবৃত করে রেখেছি। আমার চোখের পানি কেউ দেখতে পায় না।

আরও পড়ুন গল্প নীলভোর

এবাদ আলী বই পড়ছিলো। বই থেকে মুখ তুলে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
──কি হয়েছে ভাই, আপনি এই সময় রুমে, ঘুমিয়ে গেছেন, শরীর খারাপ লাগছে?
──নাহ , তেমন কিছু নয়, এমনি ভালো লাগছে না।
──ভাই একটা কথা বলি, যদি কিছু মনে না করেন?
──হ্যাঁ, বলো।
──ভাই, আর কিছুদিন পরেই আপনার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। এইভাবে হৈ-হুল্লোড় না করে একটু পড়াশোনা করেন। বেশি যদি খারাপ লাগে, বাড়িতে গিয়ে একবার মায়ের সাথে দেখা করে আসেন। ভালো লাগবে, পড়াশোনায় মন বসবে।
──হুম, তাই ভাবছি। এবাদ আলী, তুমি তোমার মাকে খুব ভালোবাসো, তাইনা?
মৃদু হেসে এবাদ আলী বললো,
──কি যে বলেন ভাই, পৃথিবীতে এমন কোনো সন্তান আছে, যে তার মাকে ভালোবাসে না?
আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম,
──আচ্ছা এবাদ আলী, এই যে তুমি দিনরাত লেখাপড়া করো, আবার এতোগুলো টিউশনি করো, এতো টাকা দিয়ে তুমি কি করো? তোমাকে কখনো বাইরে যেতে দেখি না।
এবাদ আলী মুখে হাসি নিয়েই টিউশনে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। রাত দশটা থেকে আরো একটা টিউশন আছে। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,
──ভাই, বাইরের চাকচিক্যময় পৃথিবী আমাদের মতো ছেলেদের জন্য নয়। তারুণ্যের উন্মাদনায় মত্ত থাকা আমাদের সাজে না। ভাই, পেটে ভাত জোটে না। আপনি তো জানেন ভাই, আমি গরীব ঘরের ছেলে। আমার বাবা একজন রিকশা চালক, এখন তার অনেক বয়স হয়ে গেছে। আমি সংসারের বড় ছেলে, আমার অনেক দায়িত্ব। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে বড় হয়েছি। আমার ছোট দুটো ভাইবোন আছে। আমরা ভাইবোনেরা লেখাপড়ায় খুব ভালো, তবুও আমি দেশের বড় কোনো ভার্সিটিতে চান্স পেলাম না। আফসোস করি না ভাই, সবই ভাগ্য।

আরও পড়ুন গল্প পক্ষিরাজের ডানা

টিউশনীর টাকা বাড়িতে পাঠাই। পড়াশোনার পাশাপাশি আমার চিন্তা থাকে, মাসের প্রথমে যেন আমার ভাই-বোনেরা সময় মতো ওদের স্কুল-কলেজের বেতন দিতে পারে। বেতন দিতে না পারার জন্য কোন শিক্ষকের টেবিলের কাছে মাথা নীচু করে দাড়িয়ে থাকতে না হয় যেন। বাবা একদিন রিকশা চালাতে না পারলে যেন তাদের না খেয়ে থাকতে না হয়। তাই ঘরের এক বছরের খাবারের জন্য ধান কিনে দিই। আমার মা যেন আর, তার পড়নের ছেড়া কাপড়টা সেলাই করে না পরে। তাই মায়ের এক বছর পরার জন্য তিনটে শাড়ি কিনে দিই। আমার বাবা, মা জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। অনেক কষ্ট করে আমাকে মানুষ করছেন।
আর বাকি টাকা দিয়ে আমি এখানে ডালভাত খেয়ে চলি, তা তো দেখেনই। আপনি বড়লোকের ছেলে, এসব হয়তো আপনি বুঝবেন না।
ওর কথা শুনতে শুনতে একটু অন্যমনা হয়ে গেলাম। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,
──দারিদ্রতা অনেক বড় অভিশাপ, অনেক বড় অসহায়ত্ব, তাই না এবাদ আলী?
──আমার কাছে তা মনে হয় না ভাই। দারিদ্রতা অসহায়ত্ব কিন্তু অভিশাপ নয়। দারিদ্র্যতা না থাকলে মানুষ হয়তো মনুষ্যত্বের সঠিক শিক্ষা বুঝতো না।
মূহুর্তে রেগে গিয়ে বললাম,
──মনুষ্যত্ব! পৃথিবীতে এখনো মনুষ্যত্ব বলে কিছু আছে বলে তুমি মনে করো? তোমার বাবা মা দারিদ্রতার চাকায় পিষ্ট হতে হতে, একদিন অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর তখনই কোনো ধনী লোক, তার সুযোগ নিবে। তোমার বাবা মায়ের চিকিৎসা করানোর শর্তে, তাদের ল্যাংড়া, অন্ধ মেয়েকে তোমার সাথে বিয়ে দিবে। তোমার বাবা-মা, কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে সেই শর্তে রাজি হবে। আর মেয়েটা তোমার সাথে ভালো মানুষির নাটক করবে, তোমাকে দয়া করবে, করুণা করবে।

আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা

এবাদ আলী একটু আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তারপর বলল,
──ভাই, আপনি একজন ধনীলোকের সন্তান হয়ে এসব কথা কেন বলছেন, আমি জানি না। তবে, সময় আর পরিস্থিতি জীবনের অনেক বড় শিক্ষা দিয়ে যায়। যদি কখনো জীবনে এমন পরিস্থিতি বা সময় আসে, তবে আমি তা করবো এবং হাসি মুখেই করবো। কেননা, বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না। তারা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, কষ্ট করে বড় করেছেন। আমাকে নিয়ে যেমন তাদের আশা আছে, স্বপ্ন আছে, তেমনি আমার জীবনের প্রতি তাদের একটা দাবীও আছে। আর আমি সন্তান হয়ে যদি নিজের জীবন দিয়ে, সেই দাবী পূরণ করতে না পারি, তাহলে আমি কেমন সন্তান?
আর ধনীর ঘরের অন্ধ ল্যাংড়া মেয়ের কথা বলছেন, ভাই? কপালে যদি এমন কিছুই লেখা থাকে, তাহলে তাই করবো। পৃথিবীতে কারো জন্মের জন্য তো কেউ নিজে দায়ী নয়। আল্লাহ তাঁর খুশী মতো যাকে যেমন ইচ্ছে, তেমন রূপ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
──কিন্তু এবাদ আলী, তোমার মনে হয় না, পৃথিবীতে একবার জন্ম আর একবারই মৃত্যু? এই ছোট্ট জীবনে সুন্দর কিছু পাওয়ার অধিকার, তোমার আমার সবারই আছে।
──জ্বী ভাই, আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে সেই সবার মধ্যে ঐ ল্যাংড়া, অন্ধ, বধির, তারাও তো মানুষ। তাদের কি মন বলে কিছু নেই, কিংবা স্বপ্ন স্বাধ? তারা কি কাউকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসতে পারে না? রাস্তা ঘাটে চলতে ফিরতে কতো রকম মানুষ দেখা যায়। তাদেরকে পায়ে মাড়িয়ে, অন্য মানুষ রাস্তা পাড় হয়। যাওয়ার সময় পাঁচ দশ টাকা সামনে ফেলে দিয়ে যায়। কিন্তু ভাই, খোঁজ নিয়ে দেখেন, তাদেরও ঘর আছে, সংসার আছে, সন্তান আছে। তারাও কারো আপনজন, কারো প্রিয়জন।

আরও পড়ুন গল্প রাজামারা

জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেব তো একেক জনের কাছে, একেক রকম, কম আর বেশি। জীবন কারো কাছে ছোট, কারো কাছে আবার অনেক বড়। এক মিনিট সময় গুনতেও ষাট সেকেন্ড পযর্ন্ত গুনে যেতে হয়, আবার এক ঘন্টা সময় পূর্ণ হতে ষাট মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। তাহলে মানুষের জীবনে, জন্ম থেকে মৃত্যু পযর্ন্ত এভাবে, কত সেকেন্ড, কত মিনিট, কত ঘণ্টা করতে করতে, দিন মাস বছর চলে যে যায়, তার হিসেব কয়জনে রাখে?
তবুও বলবেন, জীবনটা ছোট?
ভাই, মানুষ চোখ দিয়ে দেখতে পায় ঠিকই কিন্তু সৌন্দর্য উপলব্ধি করে হৃদয় দিয়ে। বাগানে যত্ন করে ফোটানো দামী ফুলকে ফুল বলবেন, আর পথের ধারে অযত্নে ফোটা ফুলকে ফুল বলে অস্বীকার করবেন কি করে?
──তবে কি তুমি বলতে চাও, কোনো পার্থক্য নেই?
──পার্থক্য আছে ভাই, এই যে আপনি আর আমি যেমন, ঠিক তেমন।
──মানে?
──মানে, যে কোনো বিষয় একেক জন একেক ভাবে দেখে, পার্থক্য করাটা তো যার যার মনস্ত্বাত্তিক ব্যপার। চোখের সামনেই দেখেন, আপনি আর আমি দুজনেই মানুষ অথচ দুজনের চিন্তা-ভাবনা, জীবন যাপন এবং জীবনের হিসেব, দুজনের কাছে দু’রকম। জীবনের হিসেব, আপনার কাছে ছোট আর আমার কাছে বড়।

আরও পড়ুন অশরীরী আত্মা

আমি ওর কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করছি। ওর কথাগুলো কেমন যেন বুকের ভেতরে তীর মেরে যাচ্ছে। ও একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
──ভাই, এই পৃথিবীতে অহংকারী হতে ধনী বা গরীব লাগে না। ধনী ঘরের সব মেয়েরাই যেমন অহংকারী হয় না, তেমন গরীব ঘরের সব মেয়েরাই সংসারী হয়, সত্যিকারের ভালোবাসতে জানে, এমন ধারনা করাটাও ঠিক নয়। এই জীবনে কম কিছু তো দেখলাম না। আমাদের বাড়ির পাশেই তো এক ধনীর দুলালীকে দেখলাম, গরীবের ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করে, তার সাথে সুখে সংসার করছে। আবার এক গরীবের মেয়েকেও দেখলাম, ধনীর ঘরে বিয়ে হয়ে, রাতারাতি হঠাৎ টাকার মুখ দেখে অহংকার করতে।
আসলে কি ভাই, অহংকার সবার ভেতরেই আছে, কম আর বেশি। তবে আত্মসম্মানবোধ আলাদা জিনিস, যা মানুষকে উন্নত মর্যাদার অধিকারী করে কিন্তু অহংকার মানুষকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়, ধ্বংস করে দেয়।
──হয়তো তোমার কথা ঠিক কিন্তু কারো দয়া বা করুনা নিয়ে বাঁচার নাম তুমি কি দিবে?
── (হেসে ফেললো) ভাই বেঁচে থাকার নামই তো জীবন, সে যেভাবেই বাঁচি। তবে হ্যা, সেই বাঁচার মধ্যে শান্তি আর অশান্তি হলো বড় কথা। (একটু থেমে) ভাই জানেন, আমার বাবা একবার খুব অসুস্থ হয়েছিল। তাকে সুস্থ করে তোলার কোনো ক্ষমতা আমাদের ছিলো না। এমনকি ঘরে খাবারও ছিলো না। প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ কেউ রান্না করে খাবার দিয়ে যেত। আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে গ্রামের মানুষ এক হয়ে টাকা উঠিয়ে আমাদের পাশে দাড়িয়েছিল, আমার বাবার চিকিৎসা করিয়েছিল।
আমার জায়গায় নিজেকে একবার ভেবে দেখুন ভাই। সেদিন আমরা খুব খুশি হয়ে তাদের মানবতা আর ভালোবাসার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলাম, আজীবন করবো। গ্রামের মানুষের মধ্যে এখনো মানবতা, ভালোবাসা আছে। তাদের সেই মানবতা আর ভালোবাসাকে যদি অহংকারের বশে সেদিন অগ্রাহ্য করতাম ফিরিয়ে দিতাম, তাহলে তাদের চরম অপমান করা হতো, অসম্মান করা হতো, সেটা কি ঠিক হতো, বলেন?

আরও পড়ুন গল্প চোখে দেখা নীল কণ্ঠ

অনেক দিন পরপর বাড়িতে যাই। গ্রামে গেলে কতো মানুষ হাসি মুখে কথা বলে, কুশলাদি জিজ্ঞেস করে, তাদের এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পেয়ে মনে বড় শান্তি লাগে ভাই। এদের এই ভালোবাসাকে দয়া বা করুণা হিসেবে না দেখে, ভালোবাসা হিসেবে দেখি। আমার মা বাবা বলেন-ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিতে নেই, ভালোবাসা গ্রহণ করতে হয়। তাছাড়া আমি গরীব, একথা স্বীকার করতে দোষ কোথায়?
আপনার মতো আমিও পাবনা জেলার এক গ্রামের ছেলে। গ্রামে একটা প্রবাদ আছে “ছাল নাই কুত্তার, নাম তার বাঘা”
যা আমার নাই তা নিয়ে অহংকার করে লাভ কি? পৃথিবীতে ধনী গরীব তো আল্লাহ নিজেই বানাইছেন।
ভাই, কোনো কারনে হয়তো আপনার মনটা খারাপ, তাই এসব উল্টোপাল্টা কথা ভাবছেন। অনেক কথা বললাম, কিছু মনে করবেন না। ছোট ভাই হয়ে আর একটা কথা বলি। অবশ্য আপনি বড়লোকের ছেলে, আপনার সবই মানায়, তবুও সব মানুষকেই একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকা উচিৎ। আপনি যে তৃষ্ণা নামের মেয়েটিকে ভালোবাসেন, আমার কাছে মনে হয়, সেটা সত্যিকারের ভালোবাসা নয়। হতে পারে সেটা ভালো লাগা কিংবা মোহ। তাছাড়া ঐ ধরনের মেয়েরা, সত্যিকারের ভালোবাসা কাকে বলে তা জানে না।
ভাই, আপনার চোখে বাহ্যিক সৌন্দর্যের ঠুলি পরানো আছে। একবার চোখ বন্ধ করে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। সত্যিকারের ভালোবাসা আর পৃথিবীর আসল সৌন্দর্য দেখতে পাবেন।
(ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ) আমার সময় হয়ে গেছে ভাই, যেতে হবে। যদি পারেন, নামাজ পড়েন। জীবন থাকলে সমস্যা থাকবেই। আল্লাহ সবকিছুর মালিক, তিনি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবেন।

আরও পড়ুন ঊর্মিমালা-
১ম পর্ব
শেষ পর্ব

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

ঊর্মিমালা (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

শাহনাজ মিজান গল্প ও উপন্যাস লেখেন। প্রকাশিত উপন্যাস: অধরা চাঁদ; গল্পগ্রন্থ: আকাশে চাঁদের পালকি তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!