ঊর্মিমালা (শেষ পর্ব)
ঊর্মিমালা (শেষ পর্ব)
শাহানাজ মিজান
এবাদ আলী চলে যাওয়ার পর, কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মনে হলো, অনেক দিন বললে ভুল হয়, কয়েক বছর হলো নামাজ পড়িনি। ভালো করে অজু করে এশার নামাজে দাড়ালাম। নামাজরত অবস্থায় আপনা আপনিই চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছে। জায়নামাজে বসে অনেকক্ষণ ধরে দোয়া পড়লাম। কেন জানি না জায়নামাজ থেকে আজ উঠতে ইচ্ছে করছে না।
শুধু ঊর্মির কথা মনে হচ্ছে। ধনী বাবার আদরের দুলালী, আমার মতো চাল চুলোহীন একটা ছেলের সাথে তার বাবা বিয়ে দিয়ে দিলো। সে আমাকে এবং আমার অবস্থানকে চুপচাপ মেনে নিয়ে আমার সংসার করে যাচ্ছে। আমার মাকে দেখাশোনা করার জন্য, বিয়ের পরে আজ প্রায় চার বছরেরও বেশি সময়, সে একটা দিনও বাবার বাড়িতে গিয়ে রাতে থাকেনি।
আজ পযর্ন্ত তাকে ছুয়ে দেখা তো দূরের কথা, তার সাথে ভালো ভাবে কথাও বলিনি। অথচ নির্লজ্জের মতো, প্রতিমাসে টাকার অংক বাড়িয়ে দিয়ে দিয়ে ম্যাসেজ লিখেছি। সে সেই অংকের টাকাই পাঠিয়ে দিয়েছে আর প্রতিদিন ফোনে একটাই কথা বলেছে- আমি যেন কোনো বিষয়ে কোনো চিন্তা না করি, ঠিক মতো লেখাপড়া, খাওয়া দাওয়া করি, শরীরের যত্ন নিই।
নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিলাম। ‘পরের ধনে পোদ্দারী’ যাকে বলে, আমি তাই করেছি। অথচ যাকে দিয়ে আলাদা এই পৃথিবী চিনলাম, লেখাপড়া করার সুযোগ হলো। আমার মায়ের চিকিৎসা হলো, নতুন ঘর হলো, যার টাকায় এই ঢাকা শহরে ফুটানি করছি, নিজেকে বড়লোকের ছেলের পরিচয় দিয়েছি, তার টাকা হাতে পাওয়ার পর তাকেই অবহেলা করেছি! একটাবারও জানতে চাইনি-ঊর্মি তুমি কেমন আছো, কি করছো, খেয়েছ কিনা?
এ আমি কি করেছি! একটা মানুষের উপরে এতটা অন্যায় করেছি। কি করে, কোন মুখে তার কাছে ক্ষমা চাইবো আমি!
আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ
পরীক্ষা শেষ করেই বাড়িতে এলাম। পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু ঊর্মির সাথে এখনো তেমন ভাবে কথা বলা হয়নি। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছি, বলতে পারছি না। নিজের ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধ হচ্ছে। ঊর্মিও হয়তো বুঝতে পারছে, সারাক্ষণ হাসিমুখে এটা ওটা করছে। সেও মুখে কিছু বলছে না। অবশ্য বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কিছু বলেও না।
এতোগুলো বছরে, আজ ঊর্মিকে ভালো ভাবে দেখলাম-ভীষণ সুন্দর লাগছে। সারাক্ষণ শুধু ওর দিকেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। যেদিকেই তাকাচ্ছি, সেদিক থেকেই ভালো লাগার এক দমকা হাওয়া এসে মনটাকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিচ্ছে।
এতো সুন্দর করে সাজানো গোছানো আমার বাড়ি, আমার সংসার!
নাহ, এটা ঊর্মির সংসার।
পুকুরের পাড়ে বসে এতোসব ভাবছি। মা এসে বললো, আজ রাতে ঊর্মির বাবার বাড়িতে যেতে হবে। শ্বশুর সাহেব নিজে এসে দাওয়াত করে গেছেন। তখন আমি বাড়িতে ছিলাম না, বাজারে গিয়েছিলাম। আমি মুখে কিছু বললাম না, মনে মনে বেশ খুশি হলাম। বিয়ের পর আমার শশুর বাড়িতে যাওয়া হয়নি।
বিশাল বাড়িতে এলাহী কান্ড। বাড়ির একমাত্র জামাইয়ের জন্য সব আয়োজন। যা আমার চৌদ্দ পুরুষ চোখেও দেখেনি, আমি তাই পাচ্ছি। শ্বশুর বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে, আমার শ্বশুর সাহেব হাতে চাদঁ পাওয়ার মতো খুশি হলেন। ঊর্মির ভাইয়েরা, এক এক করে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন, হাসিমুখে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। শাশুড়ি আম্মা, আমার মাকে হাসিমুখে আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
ভাবীরা পরম আদর যত্নে আমাকে খাওয়ালেন। পরিবারের সবাই এক টেবিলে বসে খাচ্ছি। সেই মূহুর্তে আমার মনে হচ্ছিলো, যেন আমি স্বর্গের মধ্যে বসে আছি।
আরও পড়ুন গল্প সোনালী
খাওয়া দাওয়া শেষ করে, শ্বশুর সাহেব, তার নিজের ঘরে আমাকে ডাকলেন। আমি তাকে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। শ্বশুর সাহেব আমার হাত ধরে বললেন,
──বাবা মুরাদ, তোমার সাথে তো এতোদিন কথা বলা হয়নি, তা বাবা পরীক্ষা কেমন হলো?
──জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ, ভালো হয়েছে।
──আলহামদুলিল্লাহ, ঊর্মির পরীক্ষাও ভালো হয়েছে শুনলাম। যাই হোক, তোমাদের ভালোতেই আমার সুখ।
──(কি ভেবে হেসে উঠে, একটু থেমে আবার বললেন) জানো বাবা মুরাদ, আমার বিয়ের পর আল্লাহর কাছে শুধু চাইতাম, আমার যেন একটা কন্যা সন্তান হয়। আর সে যেন দেখতে তোমার শাশুড়ির মতো হয়। কিন্তু পরপর আমি তিনটি পুত্র সন্তানের বাবা হলাম। কন্যা সন্তানের আশা আমার থেকেই গেল। বেশ কিছু বছর পর শুনি আমি আবার বাবা হবো। ব্যবসা-বাণিজ্য যেখানেই হাত দেই, সেখানেই ফুলে ফেপে ওঠে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে লাগলাম আর মনে মনে নিশ্চিত হলাম, যে আমার ঘরে লক্ষ্মীর পর্দাপণ হতে যাচ্ছে।
যথা সময়ে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। আমার মন পরীক্ষা করার জন্যেই হয়তো, আল্লাহ তার একটু শারীরিক সমস্যা দিয়েছেন পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু সেই সমস্যা আমার মনে এতটুকু দাগ কাটতে পারলো না। বরং আমার মনে তার প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা, দ্বিগুণ হয়ে গেল। আল্লাহ যে আমাকে কন্যা সন্তান দান করেছেন, এতেই আমি খুশি। সে যেমনই হোক না কেন।
আমার মেয়ে, আমার প্রাণ ভ্রমর। আমি তাকে ইসলামের আদর্শে, আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। একটু হলেও হয়তো পেরেছি। সে একটু কথা কম বলে, কিন্তু তার সঠিক জ্ঞান-বুদ্ধি এবং ধৈর্যের অভাব নেই।
তোমাদের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর, আমার ঊর্মির জন্য এক ধনীর ঘরের ছেলের সাথে বিয়ের প্রস্তাব এলো। ছেলে বড় চাকরি করে, দেখতে শুনতেও খুব ভালো। কিন্তু আমার মনে একটাই চিন্তা ছিলো, যতো বড় ধনী ঘরই হোক না কেন, তারা হয়তো আমার সম্পত্তির জন্য, আমার মেয়েকে তাদের ঘরে নিতে চাইছে। কোনো জিনিসের অভাব আমার মেয়ে কখনো বোঝেনি, কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসা সে পাবে তো!
আরও পড়ুন গল্প স্বপ্ন গোধূলি
এসব নিয়ে যখন ভাবছিলাম, তখন আমার ঊর্মি কোনো সংকোচ না করেই, তোমার কথা আমাকে বললো যে সে তোমাকে ভালোবাসে।
(কথাটা শুনে আমি একটা ধাক্কা খেলাম। ঊর্মির বাবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছি)
──বিশ্বাস করো বাবা মুরাদ, তুমি কে, তোমার কি আছে না আছে এসব কথা একবারের জন্যেও ভাবিনি আমি। আমার মেয়েকে কোনো প্রশ্নও করিনি। কেননা আমার ঊর্মি মুখ ফুটে কোনোদিন, কোনোকিছু কারো কাছে, এমন কি আমার কাছেও চায়নি। জীবনের প্রথম সে শুধু তোমাকে চেয়েছে।
(উনার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। আমার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে বললেন)
──দেখ বাবা, তোমার মায়ের চিকিৎসার খরচ আমি এমনিতেই দিতে পারতাম কিন্তু দিলাম না। কারণ ধনী হোক গরীব হোক, সবাইকে সমাজ নিয়ে চলতে হয়, সমাজ তার কটু কথার তীর সবার দিকেই ছোঁড়ে। তাই তোমার মায়ের চিকিৎসা করানোর নামে তোমাদের বিয়ে দিলাম, সেটা সমাজের লোক দেখানো। আমার ঊর্মি যে তোমাকে ভালোবাসে, তার ভালোবাসার কথা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।
বাবা মুরাদ, আমার মেয়েটাকে আমি আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। কিন্তু সে তার প্রাণের চেয়ে তোমাকে বেশি ভালোবাসে।
কিন্তু বাবা, ভালোবাসা তো এক তরফা হয় না। তুমি তাকে ভালোবাসো কিনা আমি জানি না। তবে তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার পর আমার মেয়েটাকে দেখে খুব সুখী এবং খুশী মনে হয়েছে। একটা মেয়ের বাবার কাছে, মেয়ের হাসি মুখের চেয়ে বড় সুখ আর কি হতে পারে, বলো?
আমার মেয়েটা খুব চাপা স্বভাবের, ওর কোন কিছুতে তীব্র কষ্ট হলেও মুখ ফুটে সেটা বলে না। ছোট থেকেই এমন, ওর মুখ দেখে বুঝে নিতে হয়।
একটা মেয়েকে বিয়ের আগে তার বাবা, আর বিয়ের পরে তার স্বামী চারদিক থেকে আগলে রাখে। ভালোবাসার প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখে।
আরও পড়ুন গল্প হাইব্রিড
বাবা মুরাদ, তোমার কাছে অনুরোধ রইলো, তুমি তাকে কখনো কষ্ট দিও না। যদি কখনো তোমার এমন মনে হয় যে, তোমার উপর আমার মেয়েকে চাপিয়ে দিয়েছি বা তুমি তাকে ভালোবাস না, তবে সে কথা আমাকে বলো। আমি আমার মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসবো। বিয়ে দেয়ার সময় কোনো প্রশ্ন করিনি, এখনো কোনো প্রশ্ন বা অভিযোগ করবো না। কারণ আমার ঊর্মি যেমন অল্প কথা বলে, তেমন অল্প কথায় সব বুঝতেও পারে।
শ্বশুর সাহেবের কথা শুনে আমিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালাম। আজ বুঝতে পারছি যে, ঊর্মির সাথে বিয়ের কথা শোনামাত্রই আমার মা কেন তৎক্ষণাৎ রাজি হয়েছিল। অথচ আমি মাকেও ভুল বুঝেছি, লোভী ভেবেছি। আল্লাহ এই পৃথিবীতে এতো ভালোবাসা, এতো মায়া মমতা আমার জন্যে রেখেছেন আর আমি তা বুঝতে পারিনি! আমার মনের অজান্তেই তার বুকে ঝাপিয়ে পড়লাম। তিনিও আমাকে শক্ত করে ধরলেন। সেই ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। আজ উনাকে বাবা বলে ডাকলাম। বললাম,
──বাবা, আমিও ঊর্মিমালাকে খুব ভালোবাসি।
আজ কোনো মোহে, লোভে কিংবা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে কথাটা আমার মুখ থেকে বের হয়নি। আবার ঊর্মির বাবাকে শান্তনা দেয়ার জন্যও কথাটা বলিনি বা মিথ্যে বলিনি। সত্যিই আজ আমি শুধু ঊর্মিকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।
──ঊর্মি আমাকে ভালোবেসে পৃথিবীর সমস্ত সুখ বির্সজন দিয়েছে। এতোগুলো দিন-রাত-বছর আমার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থেকেছে। কতো রাতের অন্ধকার সাক্ষী, প্রতি রাতে আমার জন্য নীরবে নীভৃতে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছে। অথচ সকালের নতুন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মুখে হাসি ফুটিয়ে সবাইকে দেখিয়েছে যে, সে কতটা সুখে আছে। আমার দেয়া সমস্ত অবহেলাকে, সেই হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছে। আমার কাছে তার ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার ছিলো না। অথচ আমি তাকে কিছুই দিইনি। তবুও আমার প্রতি সে কখনো কোনো অধিকার ফলায়নি কিংবা কোনো অভিযোগ অভিমান ও করেনি। এতো বড় মনের মানুষ যে, তাকে ভালো না বেসে কি পারা যায়?
আরও পড়ুন গল্প সময়ের পাঁচফোড়ন
আমার মুখের এই কথাটি শুনে, তিনি জোরে করে আনন্দের নিঃশ্বাস নিলেন। আমার কপালে চুমু দিয়ে আবারও বুকে জড়িয়ে ধরলেন। নিজের চোখের পানি মুছলেন, আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিলেন।
তারপর হাসিমুখে আবার বললেন,
──জানো বাবা, আমি একবার সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম, ভীষণ ভালো লেগেছিল। সমুদ্রের যে ঢেউ মহাবেগে ছুটে এসে পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পরে তার নাম ঊর্মিমালা। সেই নয়নাভিরাম নৈসর্গিক দৃশ্য আমার হৃদয় পটে এঁকেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, আমার কন্যা সন্তান হলে, তার নাম রাখবো ঊর্মিমালা। তাই যখন আমার মেয়ে হলো তখন তার নাম রাখলাম ঊর্মিমালা। বড় যোগ্য আর সার্থক সে নাম তার। কারণ আমার ঊর্মিমালার মনটাও সমুদ্রের মতোই উদার, গভীর আর ধৈর্য্যশীল।
ওদের বাড়ি থেকে ফিরতে, একটু রাত হয়ে গেল। মা তার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
ঊর্মিও সব গোছগাছ করে, লাইট অফ করে দিয়ে এসে, বিছানায় বসলো। প্রতিবারের মতো আজও মাঝখানে কোল বালিশটা দিয়ে পেছন ঘুরে শুয়ে পড়লো। বুঝতে পারলাম তার অভিমান। কোল বালিশটা ফেলে দিয়ে পেছন থেকেই ওকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। ঊর্মি সামনে ঘুরে একবার আমার দিকে তাকালো। সেও উত্তাল সমুদ্রের ঊর্মিমালার মতো, আমার প্রশস্ত বুকে আছড়ে পড়লো। মুখে কেউ কিছুই বলছি না। আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে শুধু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি সে কান্না থামাতেও বলছি না। ওর চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে আমার বুক, ভিজে যাচ্ছি আমি। আর আমাদের ভালোবাসার সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছি আমরা।
আরও পড়ুন ঊর্মিমালা-
১ম পর্ব
২য় পর্
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
ঊর্মিমালা (শেষ পর্ব)