আলতা-বানু-৪র্থ-পর্ব
গল্প,  শাহানাজ মিজান,  সাহিত্য

আলতা বানু (৪র্থ পর্ব)

আলতা বানু (৪র্থ পর্ব)

শাহানাজ মিজান

ভোর থেকে উনার প্রচন্ড জ্বর, বড়ো বুবু উনার কাছে রইলেন; আমি রান্না করছি। ও বাড়ির কোবাদের মা এসে খবর দিল খোকন আর তার বউ ব‍্যাগ পেটরা নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে। পাড়ার লোকজনদের ডেকে তাদের কাছে বলেছে পোয়াতি বউটার উপর আমরা অত‍্যাচার করেছি। কখনও যদি তাদের আলাদা সংসার হয় তো ফিরে আসবে, নয়তো আসবে না। আমি শুধু শুনলাম, কিছু বললাম না।

সাতদিন জ্বরে ভুগে উনি একটু সুস্থ হলেন কিন্তু শরীরটা বেশ দুর্বল। খোকন আর বউ বাড়িতে ফিরে এলে উনি খোকনকে ডেকে বললেন,
— আজ থেকে তোমরা আলাদা খাবে।
খোকন মাথা নিচু করে রইল ঠিকই, তবে তার মুখ দেখে মনে হলো সে খুশিই হয়েছে।

খোকনের ঘরে চার ছেলেমেয়ে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ছেলে আর বউয়ের সাথে তেমন একটা কথাবার্তা হয় না। খোকনের বড়ো ছেলের বয়স প্রায় পনের বছর হলো। ওরা আমাদের কাছেই বেশি থাকে। মনের কষ্ট উথলে ওঠে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে একেকবার বলি, এত আদর যত্ন করে জীবনের সবটুকু দিয়ে যাকে মানুষ করলাম, তাকে দিয়েই কী লাভ হয়েছে আর এদের এত ভালোবেসেই বা কী লাভ হবে।
মৃদু হেসে বড়ো বুবু বলেন,
— কী আর করবি বল। জানিস তো আসলের চেয়ে ফসলের প্রতি মায়া বেশি হয়। তাছাড়া কপালের লেখা তো কেউ মুছে দিতে পারে না…
কথা বলতে বলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

আরও পড়ুন গল্প বেলীফুলের ঘ্রাণ

উনার আজ জ্বর আসে, কাল জ্বর আসে, এই করতে করতে দিন দিন বেশি অসুস্থ হতে থাকলেন। বড়ো বুবুর বাপের বাড়ি ও আমার বাপের বাড়ির আত্মীয়স্বজনেরা খবর পেয়ে এসে উনাকে চোখের দেখা দেখে যায়। খোকনকে সমস্ত সম্পত্তি লেখে দেওয়াতে, তারাও আমাদের উপরে বিশেষ খুশি নয়। আমার আব্বাও মারা যাওয়ার আগে উনার উপর বেশ নাখোশ ছিলেন।

আমাদের খোজখবর নেওয়া আর পাশে থাকার মতো ছিল শুধু খোকনের বড়ো ছেলে শরীফুল আর পুরোনো কাজের লোক কোবাদ আলীর পরিবার। খোকন যখন পুরোনো লোকেদের কাজ থেকে বিদায় করে দিল, তখন কোবাদ আলীর মা উনার কাছে কান্নাকাটি করে বলল,
— আমরা বহু বছর ধরে এ বাড়িতে কাজ করে খাই। এখন হঠাৎই কাজ চলে গেল, আমরা বাঁচব কী করে?
উনি তখন কোবাদ আলীকে দুটো গরু কিনে দিয়েছিলেন।
এখন কোবাদ আলীর আর্থিক অবস্থা মোটামুটি চলে যায়। ছেলে আর সে মিলে মাঠে কাজ করে। তবুও সেই উপকারের কৃতজ্ঞতা ওরা সব সময় স্বীকার করে। কোবাদ আলীর সাত আট বছর বয়সী নাতি রায়হানকে দিয়ে প্রতিদিন এক লিটার করে দুধ পাঠিয়ে দেয় উনার জন্য। কিন্তু টাকা নেয় না। এমনকি হাজারো কাজে থাকলেও, ঝড়-বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে উনার শরীর খারাপ হলেই ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে রায়হানের বাপ।

ঘরে অসুস্থ বাপ যন্ত্রণায় ছটফট করে অথচ খোকন এদিকে ফিরেও তাকায় না। খরচ দেওয়া তো দূরের কথা, এতগুলো গরুর দুধ, পুকুরের মাছ এসব আমরা চোখেও দেখি না। ডাক্তারের খরচ যোগাতে আমাদের দুজনের সমস্ত গহনা বিক্রি করে দিলাম।

আরও পড়ুন গল্প ঊর্মিমালা

বড়ো ডাক্তারের খবর পেয়ে উনাকে নিয়ে শরীফুলের সাথে আমরা ঢাকায় চলে গেলাম। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন,
— উনার ব্লাড ক‍্যান্সার হয়েছে। একেবারে শেষে এসে ধরা পড়ল, এখন আর কিছুই করার নেই। উনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না।
কথাটা শুনে আমরা আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গেলাম। বড়ো বুবু হাল ছাড়লেন না। তার নামের দু’বিঘা জমি বিক্রি করে দিলেন; মাদ্রাজ নিয়ে উনার চিকিৎসা করানোর জন্য। সব মানুষকেই একদিন মরতে হবে জানি, তাই বলে চোখের সামনে এভাবে প্রিয়জনের মৃত্যু দেখতে কে চায়। মরে যাবে বলে বিনা চিকিৎসায় তাকে মরতে দিতে পারি না।

মাদ্রাজ থেকে চিকিৎসা করেও কোনো লাভ হলো না। উনার ওষুধপত্র, আমাদের খাওয়া দাওয়া, চলার জন‍্য আমার নামের দু’বিঘা জমিও বিক্রি করে দিতে হলো। জানি তো উনি আর বাঁচবেন না, তবুও মনে মনে আশা বেঁধে রাখি, যদি আর ক’টা দিন বাঁচেন।

মাঝেমাঝে উনার বমির সাথে রক্ত আসত। আমরা তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার করে ফেলতাম। মাঝেমাঝে খোকন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখত আর কুসুম নাকে কাপড় দিয়ে দরজার ওপাশে দাঁড়াত।
অনেক মানুষের সাথে উনার ভালো সম্পর্ক ছিল। যারা উনার অসুস্থতার খবর পায় তারাই দেখতে আসে। অথচ উনি মনে মনে যাকে কাছে পেতে চান সে আর কাছে আসে না। উনি তেমন একটা কথা বলতে পারতেন না, আলতো আলতো ভাষায় বা ইশারায় যা বলতেন সেটা আমরা বুঝতে পারতাম। আবার আমরা যেটা বলতাম সেটা বুঝতেন। সময় সময় ভীষণ অস্থির হয়ে যেতেন। আমাদের দিকে করুণ চোখে চেয়ে থাকতেন। আমাদের দুজনের দুটো হাত নিয়ে উনার বুকের উপর শক্ত করে ধরে রাখতেন।
একদিন খোকন দেখতে এল, কাছে বসে জিজ্ঞেস করল,
— আব্বা তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে করে? কিছু আনব?
উনি চোখ বন্ধ করে রইলেন, সাড়া দিলেন না। উনার বন্ধ দু’চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।

আরও পড়ুন গল্প একজন কিশোরীর প্রেম

রমজান মাসের পনের তারিখ। সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে একটু চোখ বন্ধ করেছি। দেখলাম উনি বিভোরে ঘুমোচ্ছেন। সকালে সে ঘুম আর ভাঙেনি, চিরনিদ্রার দেশে পাড়ি জমালেন উনি। আমি চিৎকার করে কাঁদলাম, বড়ো বুবু উনার পাশেই বসে রইলেন পাথরের মতো।

ইদুল ফিতরের চাঁদ দেখা গেছে। মসজিদে বলা হলো কাল ইদ। এশার নামাজের পরে বড়ো বুবুর গায়ে কাঁপুনি দিয়ে প্রচন্ড জ্বর এল। সারারাত মাথায় পানি ঢালার পরে ফজরের ওয়াক্তে জ্বর নেমে গেল। ঢকঢক করে বড়ো এক গ্লাস পানি খেলেন, বললেন নামাজ পড়বে। দুজন একসাথে নামাজ পড়ে আবার শুয়ে পড়লাম। বড়ো বুবু ছোটো বাচ্চাদের মতো আমার বুকের ভেতরে মাথা গুজে আমাকে শক্ত করে ধরে রইলেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেখলাম আবার জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
— বুবু, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?
আমাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,
— জানিস আলতা, সেই চৌদ্দ বছর বয়সে উনার হাত ধরে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলাম। তারপর থেকে আজ পযর্ন্ত কোনোদিন তাকে ছাড়া ইদ করিনি, সেমাই মুখে তুলিনি। গোসল করে নতুন শাড়ি পরে বসে থেকেছি, উনি ইদের নামাজ শেষে বাড়িতে ফিরলে তবে একসাথে সেমাই খেয়েছি।
আমি ভাবলাম, জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। বড়ো বুবুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
— বুবু আমি তো সবই জানি। তুমি একটু ঘুমোতে চেষ্টা করো, একটু ঘুমোলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন গল্প এখানে স্নিগ্ধ সকাল

বড়ো বুবু সবসময় যেমন মৃদু হাসতেন। তেমনি হেসেই আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
— কি যে বলিস আলতা, আমার এখন ঘুমোনোর সময় নাই। তুই আমাকে গোসল করিয়ে নতুন শাড়ি পরিয়ে দে, এক্ষুনি উনি চলে আসবেন, একসাথে বসে সেমাই খাব।
— বুবু এত কথা বলো না। মাথা ব‍্যথা করবে। এস আমরা কালেমা পড়ি।
আমরা কালেমা পড়ছি, বড়ো বুবু আমার বুকের ভেতরে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে গেলেন। সকালে সূর্য উঠল, আমার ঘুম ভাঙল কিন্তু বড়ো বুবুর ঘুম আর ভাঙল না। আমার বুকের ভেতর থেকেই আমাকে ফাঁকি দিয়ে কখন চলে গেল আমি বুঝতেও পারলাম না।

কত বছর হলো আমার গর্ভধারিণী মাও পৃথিবী থেকে চলে গেছে, এমন তো লাগেনি আমার। আজ এমন লাগছে কেন, কেন বুকের ভেতরে এত যন্ত্রণা করছে। তবুও কাঁদতে পারলাম না আমি, শুধু অনুভব করলাম বুকের ভেতরে বিশাল এক শূন্যতা।
সদ‍্য ফোঁটা গোলাপি গোলাপের মতো সুন্দর মুখখানা, শেষবারের মতো দু’চোখ ভরে দেখে নিলাম। নিজ হাতে বুবুকে গোসল করিয়ে, নতুন কাপড় পরিয়ে, আমার চির মমতার ছায়াকে, চির জনমের জন‍্য উনার কাছে পাঠিয়ে দিলাম।

আরও পড়ুন আলতা বানু-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

আলতা বানু (৪র্থ পর্ব)

Facebook Comments Box

শাহনাজ মিজান গল্প ও উপন্যাস লেখেন। প্রকাশিত উপন্যাস: অধরা চাঁদ; গল্পগ্রন্থ: আকাশে চাঁদের পালকি তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!