আমার শিক্ষাজীবন
আমার শিক্ষাজীবন
তাহমিনা খাতুন
আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করলাম। পূর্বসূরী বড় বোনদের চেয়ে আলাদা নয় আমার গল্প! উচ্চশিক্ষার সুযোগের অভাব। প্রায় বছর খানেক কেটে গেল ঘরে বসেই। আমার তৃতীয় ভাই মরহুম খন্দকার আবুল খায়ের (বড় তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ হওয়ায় আমরা ছোট ভাই-বোনেরা তাঁকে ‘ছোট ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম) যাঁর অবদান আমার জীবনে সবচেয়ে বেশী। শুধু আমার জীবনে নয়, আমার ছোট আরও তিন ভাই, বোনের জীবনেও ছোট ভাইয়ের অবদান অনস্বীকার্য! ছোট ভাই নিজে তখন ঢাকায় সামান্য বেতনে একটি চাকুরীর পাশাপাশি নৈশ কলেজে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছিলেন। ছোট ভাই ছুটিতে বাড়ি এলেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন কি করে সময় কাটছে আমার। জানালাম বই বা সংবাদপত্র পড়ে। ছোট ভাই বললেন,’ আমি ক্লাস সিক্সের বই আর খাতা-কলম পাঠিয়ে দেব। তুই ঘরেই লেখাপড়া করতে থাক। দেখা যাক পরে কি করতে পারি।’
শুরু হল আমার গৃহশিক্ষা! বিপদ হল অংক আর ইংরেজি নিয়ে। ঘরে সাহায্য করার মতো তেমন কেউ ছিল না। পিতৃ-মাতৃহীন আব্বা তাঁর নানী এবং খালার নিকট বাংলা, আরবী, ফার্সী ভাষা শিখেছিলেন। ফলে আব্বার পক্ষেও ইংরেজি বা গণিত বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। কাজেই আমাকে গণিত, ইংরেজি বোঝার জন্য চাচাতো ভাই বা পাড়ার একটু উপরের ক্লাসে পড়ছে-তাদের শরণাপন্ন হতে হত। ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ এক বছরে শেষ করলাম। সে এক আজব পাঠক্রম। নিজের তৈরী সিলেবাসে নিজেই পড়া তৈরি করা, নিজেই পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করে নিজের পরীক্ষা নেওয়া এবং পরবর্তী ক্লাসে নিজেকে উত্তীর্ণ করে নেওয়া! এভাবে সপ্তম শ্রেণিতে নিজেকে উত্তীর্ণ করার পর বেশ বিপদের সন্মুখীন হলাম। কারণ সপ্তম শ্রেণিতে এ্যালজেব্রা বা বীজগণিত পড়তে হয়। তবু দমে যাইনি। পাড়ার আত্মীয়দের মধ্যে যারা একটু উপরের শ্রেণিতে পড়তেন, তাঁদের সাহায্য নিয়ে অথবা ছোট ভাই যখন বাড়ি আসতেন তাঁর সাহায্যে বীঙগণিতও মোটামুটি আয়ত্ত করে ফেললাম।
আরও পড়ুন গল্প একজন অনন্যা
আমার পিঠাপিঠি ছোট ভাই বাসার, পুরো নাম খন্দকার আবুল বাসার। সে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে নিজেদের গ্রাম থেকে মাইল দুয়েক দূরে কাশীনাথপুর হাই স্কুলে ভর্তি হয়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে অবশ্য দুই/তিন মাইল দূরত্বের মধ্যে দুই তিনটা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাসারও ম্যাট্রিক পাশ করেই স্বল্প বেতনের একটি চাকুরী শুরু করে এবং পাশাপাশি লেখাপড়া অব্যাহত রাখে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে।
আমার ছোট বোন তুষার। প্রাথমিক শেষে হাইস্কুলের অভাবে যথারীতি গৃহবন্দী। তবে তুষারের সৌভাগ্য ওকে বেশীদিন লেখাপড়া থেকে দূরে থাকতে হয়নি। আমার দ্বিতীয় বোন আকলিমা খাতুন রাঙার শ্বশুর ডা. কাজী আব্দুল আউয়াল ছিলেন আব্বার আপন খালাতো ভাই। ওনাকে আমরা ডা. চাচা বলতাম। ডা. চাচা ছিলেন অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী মানুষ। ডা. চাচা এবং আরও কয়েকজন বিদ্যোৎসাহী মানুষের চেষ্টায় আমাদের বাড়ি থেকে ৪ মাইল দূরে দুলাই গ্রামে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুলটি ছেলেদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হলেও স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতাদের উদার মনোভাব এবং নারী শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করার কারণে স্কুলটিতে ছাত্রীদেরও ভর্তির সুযোগ দেওয়া শুরু হয়। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২/৩ জন ছাত্রী ভর্তি করা হয়।পঞ্চম শ্রেনী শেষ করে তুষার অবসর সময় পার করছিল। এ সময়ে তুষার একদিন ডাঃ চাচার বাড়ি বেড়াতে গেলে তিনি স্বতোঃপ্রনোদিত হয়ে তুষারকে দুলাই হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি করে দেন।
আরও পড়ুন গল্প লালু
এ প্রসঙ্গে ডা. চাচার কথা না বললে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ডা. চাচা ছিলেন এলএমএফ পাশ করা একজন ডাক্তার। কিন্তু ডাক্তারীতে ওনার হাত যশ ছিল অসামান্য! রোগ নির্ণয়ে ওনার পারদর্শিতা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অনেক হাসপাতালের বিখ্যাত অনেক উচ্চ ডিগ্রীধারী ডাক্তারদেরকেও বিস্মিত করতো। ডা. চাচা ছিলেন একজন মুক্ত মনের মানুষ। প্রচুর পড়াশোনা করতেন। কেবলমাত্র তাঁর পেশা সংক্রান্ত পড়াশোনা নয়, জ্ঞানের বিস্তৃতির জন্য যে ধরনের পড়াশোনা প্রয়োজন ডা. চাচার ছিল সেই পর্যায়ের পড়াশোনা। প্রচুর বইয়ের সংগ্রহ ছিল তাঁর। পেশাদত দায়িত্ব পালনের পরে তাঁকে বহু বিশ্বখ্যাত মনীষী, দার্শনিকের রচনার মধ্যে ডুবে থাকতে দেখা যেতো। একাত্তরে যখন আমাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, একই সময়ে ডা. চাচার বাড়ি-ঘর ও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে পুড়ে ধ্বংস হয়েছিল ডা. চাচার সংগ্রহে থাকা শত শত জ্ঞান সমৃদ্ধ বই-পুস্তক। এ রকম একজন জ্ঞানী মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পারা, অবশ্যই সৌভাগ্যের ব্যাপার! আমার শিক্ষা জীবনে ডা. চাচার সহযোগিতা আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে!
তুষার পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে লেখাপড়া শেষ করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয় এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করে। বর্তমানে নেদারল্যান্ডস সরকারের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এছাড়া সাহিত্য চর্চা ও সংবাদপত্রের কলাম লেখার সাথেও যুক্ত আছে।
আরও পড়ুন সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা
যাই হোক, তুষার দুলাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার ফলে আমারও দুলাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ তৈরি হল। তুষার যখন সপ্তম শ্রেণির শেষের দিকে, আমারও তখন অষ্টম শ্রেণির গৃহশিক্ষা শেষের দিকে। ছোট ভাই আব্বাকে চিঠি লিখে জানালেন,আব্বা যেন পরের বছর দুলাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে আমার ভর্তির ব্যাপারে কথা বলে রাখেন।
আব্বা পরের দিনই ডা. চাচার সাথে দেখা করে দুলাই বয়েজ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে আমার লেখাপড়ার কথা বলার অনুরোধ করলেন। প্রধান শিক্ষক ডা. চাচাকে জানালেন নবম শ্রেণিতে যেহেতু শিক্ষা বোর্ডে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়, সেহেতু নবম শ্রেণিতে ভর্তি করাটা অসুবিধাজনক। এ কারণে তিনি আমাকে অষ্টম শ্রেনিতে ভর্তি করানোর পরামর্শ দিলেন। তবে আমার অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তির যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য একটা পরীক্ষা দিতে হবে। সেদিনটির কথা আমার স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকবে চিরদিন। সেদিন ছিল অক্টোবর মাসের ২০ তারিখ। পরদিন ২১ অক্টোবর আমি আব্বার সাথে ডা. চাচার বাড়িতে গেলাম এবং পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা পাশের পর একটা দীর্ঘ বিরতি শেষে আবার পরীক্ষায় বসতে হল।
দুলাই হাই স্কুলের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক জনাব গোলাম রসুল আমার পরীক্ষা নিলেন এবং পরদিনই আমি দুলাই হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। ক্লাস শুরু করার এক মাস পরেই বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি এবং ভাল ভাবেই পাশ করে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হই। নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে সবে উত্তীর্ণ হয়েছি। ক্লাস শুরু হয়েছে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হল আগ্নিঝরা উত্তাল মার্চ-১৯৭১!
আরও পড়ুন যাপিত জীবনের কথকতা-
দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আমার বাবা
আমার মা
ভাই-বোনদের কথা
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো
যেভাবে আইনজীবী হলাম
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
সংসার ও আইনজীবী জীবন
পাশের বাড়ির আপনজন
আমার নানী
প্রথম শহর দেখা ও প্রথম বিদেশ ভ্রমণ
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
ছেলেবেলার ষড়ঋতু
মধুর স্মৃতি
স্নেহশীল কজন
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
আমার শিক্ষাজীবন