আমার মা
আমার মা
তাহমিনা খাতুন
আমার মায়ের তুলনা একমাত্র আমার মা নিজেই। নিজের মা বলে বলছি না। প্রত্যেকের মা প্রত্যেকের কাছে প্রিয়। কিন্তু কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট ছিল আমার মায়ের। মাকে নিরক্ষরই বলা যায়। কিন্ত নিজের সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে মা ছিলেন সদা সতর্ক প্রহরী! সময় মত পড়তে বসলাম কিনা, ঠিক মতো স্কুলে গেলাম কিনা, পরীক্ষার ফলাফল কেমন করছি-প্রতিটি ব্যাপারে মায়ের ছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। এছাড়া দেশ বিদেশের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে মায়ের ছিল অপরিসীম আগ্রহ। আমার ছোট বেলায় আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় গৃহিণীদের দেখেছি ঘরকন্না ছাড়া তাঁদের মধ্যে দেশের বা বহির্বিশ্বের ঘটনা জানার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। আমার মা যেটুকু রিডিং পড়তে পারতেন সেটুকু দিয়েই সংবাদ-পত্র পাঠ করতেন এবং নিয়মিত রেডিওর খবর শোনা ছিল মায়ের অভ্যাস।
আমাদের নিজেদের রেডিও ছিল না। ছোট কাকার বাড়িতে (আব্বার আপন চাচাতো ভাই) এবং (বড় মেজভাই) আমার আপন ফুফাতো ভাই এর বাড়িতে রেডিও ছিল, গিয়ে খবর শোনা ছিল মায়ের প্রিয় অভ্যাস।সংবাদপত্র বা রেডিওর খবরগুলি বিষয়ে মা ছেলে-মেয়েদের সাথে আলোচনা করে তাদের মানসিক উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতেন। এমনকি আজকের এই সময়েও যখন তথ্য প্রযুক্তি উৎকর্ষের চরমে, অনেক উচ্চ শিক্ষিত মায়েদের মধ্যেও সন্তানদের সাথে দেশ-বিদেশের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে আলাপচারিতার কোন আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না। ফলে সন্তানের সাথে পিতা-মাতার আত্মিক বন্ধনের অভাবটা খুব সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়।
আরও পড়ুন গল্প লালু
আমার মায়ের জীবনটা শুরু হয়েছিল চরম দুঃখের মধ্য দিয়ে। আমার নানা বেশ ভালই জমি-জমার মালিক ছিলেন। আমার নানার জমি-জমার উপর নজর পড়েছিল নানার একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের। আমার মায়ের বয়স যখন মাত্র এক বছর, সে সময় আমার নানা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমার নানাকে চিকিৎসা করানোর কথা বলে সেই বিশ্বাসঘাতক আত্মীয় তাঁকে সাব রেজিস্ট্রী অফিসে নিয়ে প্রায় বিশ বিঘা জমি নিজের নামে রেজিস্ট্রী করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর চিকিৎসার কোন ব্যবস্থাই করেননি। আপন মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার এই নিষ্ঠুর আঘাত নানা সহ্য করতে পারেন নাই। আমার মায়ের বয়স যখন মাত্র বার বা তের মাস তখন আমার নানা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।
আমার অসহায় নানী শিশু কন্যাকে বহু কষ্টে বড় করেন। ওই সময় যখন ছেলেদের লেখা পড়া করানোই দুরুহ ছিল, তখন আমার নানীর পক্ষে মেয়েকে লেখাপড়া করানোর সুযোগ ছিল না। আমার মা লিখতে পারতেন না তবে আব্বার কাছ থেকে বাংলা রিডিং পড়তে শিখেছিলেন। নিজে লেখা-পড়ার সুযোগ পাননি বলেই হয়তো ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়ার দিকে আমার মায়ের ছিল তীক্ষ্ণ, সজাগ দৃষ্টি। শুধু লেখা পড়া নয়, ছেলে-মেয়েরা সন্ধ্যার সাথে সাথে ঘরে ফিরেছে কিনা, পড়তে বসেছে কিনা, পরীক্ষার রেজাল্ট কেমন করছে-এক কথায় অতন্দ্র প্রহরীর মত সন্তানদের ঘিরে থাকা। আমার আব্বার বরং সন্তানদের প্রতি ছিল কিছুটা অন্ধ স্নেহ। সব সময় সন্তানদের নিজের কাছে জড়িয়ে রাখতে চাইতেন। উচ্চ শিক্ষার জন্যও ছেলে মেয়েরা দূরে যাক-আব্বা এটা চাইতেন না।
আরও পড়ুন গল্প ওরা তেরোজন
আজ কালের উচ্চ শিক্ষিত অনেক মাকেও দেখি সন্তানদের ভবিষ্যত মঙ্গলের ব্যাপারে উদাসীন। ছেলে মেয়ে কোথায় যায়, লেখা-পড়া করে কিনা, কার সাথে মেলা মেশা করে তার খবর না রেখে নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন! ফলশ্রতিতে তাদের সন্তান অসৎ সঙ্গে মিশে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড জড়িয়ে পড়ছে অথবা নেশাগ্রস্থ হয়ে নিজেদের ভবিষ্যতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে!
অপরিসীম ধৈর্য্যশীল ছিলেন আমার মা। মাকে কোন দিন কারও সাথে রেগে কথা বলতে দেখি নি। এমন কি আমাদের মায়ের নিরীহ স্বভাবের কারণে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন মাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন এবং ভালোবাসতেন।
জন্মের পর থেকে দুঃখকে সাথী করেই বড় হয়েছিলেন বলে অন্য কারও দুঃখ মা সইতে পারতেন না। আমার খুব মনে আছে একবার আমার বয়স তখন হয়তো সাত বা আট বছর হবে। আমার চেয়ে বয়সে বছর দুয়েকের বড় হবে-বুদ্ধি প্রতিবন্ধী একটি মেয়ে আমাদের পাড়ায় এসেছিল। নিজের নাম ‘জাহানারা’ ছাড়া আর নিজের বাবা, মা অথবা ঠিকানা কোন কিছুই বলতে পারতো না। গ্রামের সব ঘরই ছিল তার ঘর, সব বাবা, মা ভাই বোনই ছিল তার বাবা মা ভাই বোন। সব বাড়ির গৃহস্থালী কাজে সাহায্যের জন্য জাহানারা থাকত সদা প্রস্তুত। খাবার অথবা পোষাকের কোন অভাব ছিল না মেয়েটির। যখন যার বাড়িতে কাজ করতো, সেখানেই খাবার পেত। সারাদিন কোন না কোন বাড়িতে কাজে ব্যস্ত থাকতো। কিছু অদ্ভুত স্বভাব ছিল জাহানারার।
আরও পড়ুন গল্প চোখে দেখা নীলকণ্ঠ
সে যখনই অবসর পেত লম্বা ধরনের একটা লাঠি মুখে পুড়ে ক্রমাগত সামনে পিছনে ঝুঁকে ঝুঁকে সামনের জায়গাটাকে গর্ত করে ফেলত। আর একটা স্বভাব ছিল, যেমন কেউ একটা জামা দিলে নতুন বা পুরনো যাই হোক না কেন-পরনের আগের কাপড়টা ফেলে দিয়ে পরবর্তীতে পাওয়া কাপড়টা পড়ে নিত। এ কারণে রাস্তায় জাহানারার ফেলে দেওয়া নতুন বা পুরনো কাপড় সব সময়ই চোখে পড়ত। গ্রামের সবাই আদর করত মেয়েটিকে। অনেকদিন যাবতই মেয়েটিকে আমাদের ও আশ-পাশের গ্রামে দেখা যেত। রাতের বেলা যে কোন বাড়ির বারান্দায় ঘুমাতো। আরো একটা অস্বাভাবিক আচরণ ছিল জাহানারার। প্রচণ্ড গরমে একদিকে যেমন অনেকগুলো কাঁথা কম্বল গায়ে জড়িয়ে ঘুমাতো আবার তীব্র শীতে কোন গরম কাপড় ছাড়াই ঘুরে বেড়াতো।
জাহানারার হঠাৎ করেই কয়েকদিন দেখা নাই। মাঝে মাঝেই মেয়েটি এমন উধাও হয়ে যেত। কয়েকদিন পরে আবার হাজির হত। একদিন কাঁদতে কাঁদতে হাজির জাহানারা। ডান হাতটা পোড়া এবং বেশ ভাল মতই পুড়েছে। কিভাবে পুড়েছে জানতে চাইলে জানালো কোন বাড়িতে ধান সিদ্ধ করতে গিয়ে হাতটা পুড়িয়েছে। কোন বাড়ি সেটা বলতে পারল না। যাদের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে হাতটা পুড়িয়েছে, তারা ওর চিকিৎসার কোন ব্যবস্থাই করেনি। আমার মা জাহানারার হাতটা যত্ন করে ধুইয়ে মলম লাগিয়ে দিতেন এবং প্রতিদিনই মেয়েটিকে নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দেওয়া এবং যত্ন নেওয়ার কাজটি মা নিজ হাতেই করতেন।
আমরা ছিলাম এগার ভাইবোন। তবে বড় তিন ভাইয়ের জন্মের পর আমাদের বড় বোন হেনার জন্ম হয় এবং তিনি পাঁচ বছর বয়সে মারা যান। এতগুলি ছেলে মেয়েকে জন্ম দিয়ে তাদেরকে লালন-পালন করা,অসুস্হ হলে সেবা শুশ্রুষা করা, ছেলেমেয়ে কৃষি শ্রমিকসহ ১৫/১৬ জন লোকের একটি বড় সংসার পরিচালনা করেও আত্মীয় স্বজনদের আপ্যায়ন করতে মায়ের কোন ক্লান্তি ছিল না! আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী কতটা ধৈর্যশীল হলে একজন মানুষ মোটামুটি টানাটানির সংসারে এসব কষ্ট সহজে মানিয়ে নিতে পারে-ভাবলে অবাক হতে হয়!
আরও পড়ুন যাপিত জীবনের কথকতা-
দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আমার বাবা
ভাই-বোনদের কথা
আমার শিক্ষাজীবন
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো
যেভাবে আইনজীবী হলাম
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
সংসার ও আইনজীবী জীবন
পাশের বাড়ির আপনজন
আমার নানী
প্রথম শহর দেখা ও প্রথম বিদেশ ভ্রমণ
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
ছেলেবেলার ষড়ঋতু
মধুর স্মৃতি
স্নেহশীল কজন
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
আমার মা