অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (৬ষ্ঠ পর্ব)
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (৬ষ্ঠ পর্ব)
~ মোহাম্মদ আব্দুল মতিন
প্রকাশনা:
১। বিশ্ব রহস্যে নিউটন ও আইনষ্টাইন (মালিক লাইব্রেরি, ১৯৪২)
প্রফেসর ড. আলী আসগর লিখেছেন, “বিশ্ব রহস্যে নিউটন ও আইনষ্টাইন” বইটির বিষয় নির্বাচন ও লেখার প্রসাদ-গুণ ভীষণভাবে আমাকে আকর্ষণ করেছিল। ঐ বইটির ভিতর দিয়ে আমি যেন পরিচয় লাভ করেছিলাম নিউটন ও আইনষ্টাইনের এবং একই সাথে বইয়ের লেখকেরও। কে জানে হয়তো সেই বইটিই পরোক্ষভাবে আমাকে আকৃষ্ট করেছিল পদার্থবিদ্যার দিকে। লেখক আব্দুল জব্বারই আমার পাঠক সত্ত্বাকে জাগ্রত করেছিলেন বিজ্ঞানের বিষয়ে।”
আরও পড়ুন সরদার জয়েনউদদীনের গল্পগ্রন্থ নয়ান ঢুলী রিভিউ
২। বিশ্ব রহস্য সন্ধানে (মালিক লাইব্রেরি, ১৯৫১)
এ রহস্যের আরম্ভ যে কোথায় তার খোঁজ পাওয়া মুস্কিল। আকাশের উজ্জ্বল পদার্থসমূহ কি, তাদের সাথে আমাদের এই পৃথিবীর কোন সম্বন্ধ আছে কি না, এই রহস্য জানবার জন্য চেষ্টা মানুষ অনেক দিন ধরে করে আসছে। পুরাকালে সমস্ত সভ্য জাতির ভিতরেই জোতির্বিদ্যার চর্চা ছিল জানতে পারা যায়। ভারত, চীন, আরব, মিশরীয়, গ্রিস প্রভৃতি কয়েকটি প্রাচীন জাতির ইতিহাসেই জোতির্বিদ্যার চর্চা দেখতে পাওয়া যায় এবং এদের মধ্যে নানান রকমের সাদৃশ্য আবার নানান রকমের বৈসাদৃশ্যও দেখতে পাওয়া যায়।
ভারতীয় জোতির্বিদ্যাগ্রন্থে (বেদের রচনা কাল সম্ভবত, খৃ. পূ. ২৫০০ অব্দের কাছাকাছি) ঋগ্বেদে সপ্তর্ষিমণ্ডল, কালপুরুষের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। অথর্ববেদে সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের দৈত্য রাহুর উল্লেখ আছে। তাছাড়া, ৩০ দিনের লুব্ধক ও একটি ত্রয়োদশ মাসের কথাও মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া যায়। মনে হয় পাঁচ বৎসরে সে সময় একটি পূর্ণকাল কাল ধরা হতো এবং পঞ্চম বৎসর ৩০দিনে ১৩ মাসে শেষ হতো। এতে প্রত্যেক বৎসর গড়ে ৩৬৬ দিন হয়।
আরও পড়ুন চকখড়ি উপন্যাস রিভিউ
প্রাচীন মিশরীয় জ্যোতির্বিদগণ সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে জানা যায়। খৃ. পূ. ৬০ অব্দে গ্রিক জোতির্বিদ ডায়ডোরাস মিশরে যান এবং তিনি বলেন মিশরীয় জোতির্বিদগণ ধূমকেতু প্রত্যাবর্তনের সময় জানতেন। তিনি আরো বলেন মিশরীয়গণ প্রত্যেক বৎসরকে ৩০ দিনের বারো মাসে ভাগ করতেন এবং তার সঙ্গে বছরে ৫ দিন যোগ দিতেন।
খৃ. পূ. ষষ্ঠ অব্দে বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাস বলেন সূর্য্যপথ ও বিষুব বৃত্ত এক নয়, বরং গতিশীল সেটাও জানতেন বলে জানা যায়। পরে ফিলোলাস বলেন যে পৃথিবীও একটি গ্রহ এবং এরও গতি আছে। কোপার্নিকাস বলেন, পৃথিবী সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরছে।
এরপর আসেন প্রাচীন যুগের গুরুদেব, এ্যারিস্টটল। এঁর Metereologica এবং De Coel নামে দু’খানা বইতে জোতির্বিদ্যা সম্বন্ধে আলোচনা পাওয়া যায়। এ্যারিস্টটলের মত কেপলারও বিশ্বাস করতেন যে গ্রহসমূহের কক্ষপথ বৃত্তাকার। টাইকো ব্রাহের পর্যবেক্ষণ তালিকায় মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার দেখেন।
এরপর আসেন টলেমী। ইংরেজিতে প্রায় সব বইতেই টলেমীর পরের দেড় হাজার বছরকে অন্ধকার যুগ বলা হয়। এরা বলতে চান, টলেমীর পরে জোতির্বিদ্যায় আর কোন উন্নতি হয় নাই । তাঁর পরে কোপার্নিকাসই একমাত্র উল্লেখযোগ্য জোতির্বিদ। অর্থাৎ মুসলিম যুগটাকে তাঁরা একেবারে উপেক্ষা করে যান। কিন্তু সব ইউরোপীয় লেখকগণ যখনই বিশেষভাবে মধ্যযুগের আলোচনা করেন, তখন এই সমস্ত মুসলিম জোতির্বিদদের আলোচনা তাঁরা না করে পারেন না।
আরও পড়ুন গল্পগ্রন্থ ‘মায়াকুসুম’ রিভিউ
মুসলিম যুগের পরই তিনি আলোচনা করেছেন যথাক্রমে কোপার্নিকাস, টাইকো ব্রাহে, গ্যালিলিও এবং জন কেপলার। তারপরই স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় আসেন নিউটন ও আইনস্টাইন।
৩। মুসলিম যুগে জ্যোতির্বিদ্যা (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, ১৯৫২)
পাশ্চাত্য সভ্যতায় একটা ব্যাপার বার বার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে, বিশেষ করে জোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে, গ্রিক সভ্যতার পরে প্রায় দুই হাজার বৎসর পর্যন্ত কোন উন্নতি হয় নাই। এই সময়টাকে অন্ধকার যুগ বলা হয়ে থাকে। মুসলিম যুগ এই অন্ধকার যুগের অন্তর্ভুক্ত। টলেমির ভূ-কেন্দ্রিক মতবাদের পরের বৎসর পরে কোপারনিকাস তর সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ নিয়ে হাজির হন। গ্রিক ভূ-কেন্দ্রিক জোতির্বিদ্যা থেকে একলাতেই কোপারনিকাস সৌরকেন্দ্রিক জোতির্বিদ্যায় এসে পৌঁছান নাই। প্রকৃতপক্ষে এই সময়ের মধ্যে মুসলিম জোতির্বিদগণ গ্রিক জোতির্বিদ্যা থেকে আধুনিক জোতির্বিদ্যার সেতুবন্ধন রচনা করেন। তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই আধুনিক জোতির্বিদ্যা প্রতিষ্ঠিত।
দশম শতাব্দীতে আলবেরুনী সর্বপ্রথম বলেন যে, পৃথিবী গতিশীল, এবং তার দুই প্রকার গতি আছে। এর একটি গতি হলো, পৃথিবীর অক্ষের চারিদিকে আবর্তন গতি। বৃত্তীয় গতি মতবাদে সন্দেহ প্রকাশ করেন একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম জোতির্বিদ আল-জারকারী এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নাসিরউদ্দিন আল-তুসী। গ্রহসমূহের গতিপথ যে বৃত্তীয় নয়, শুধু তাই নয়, কী পথ যে উপবৃত্তীয় এ মতবাদও প্রচার করেন আল-জারকারী। এর ছয়শ বৎসর পরে গণিতের সাহায্যে কেপলার এ তথ্য প্রতিষ্ঠিত করেন।
আরও পড়ুন আমাদের সুজানগর সংকলন রিভিউ
এমন অনেক কিছু মুসলিম জোতির্বিদগণ আবিষ্কার করেন, যেগুলি আধুনিক জোতির্বিদ্যার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সাহায্য করেছে। মুসলিম জোতির্বিদগণ প্রচুর পর্যবেক্ষণ করেন এবং সেগুলো তালিকাবদ্ধ করেন। কোপারনিকাস মুসলিম জোতির্বিদগণের, বিশেষ করে ছাবেত-ইবনে-কোরার পর্যবেক্ষণ তালিকার উপর ভিত্তি করেই কোপারনিকাস তাঁর সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।
তৎকালে টলেমী ছিলেন জোতির্বিদ্যার গুরু। তাঁকে অভ্রান্ত মনে করা হত। সূর্যের অনুভূ নির্ণয়ে আল বাত্তানী ও টলেমীর গণনায় ১৬ ৪৭ এর পার্থক্য দেখা যায়। কিন্তু টলেমীর কোন ভুল হতে পারে না এই বিশ্বাসে আল-বাত্তানী নিজের নির্ভুল গণনাকে ভুল বলে স্বীকার করে নেন। আবুল ওয়াফা টলেমীর গণনাতে অনেক ভুল বের করেন, বিন্তু এসব ক্ষেত্রেও টলেমীকে অভ্রান্ত বলে মেনে নেওয়া হত। আল খারেজমি, ইবনে ইউসুফ, আব্দুর রহমান সুফি, উলুগ বেগ এবং আরো অনেকেই তারা পর্যবেক্ষণ করেন এবং তারার তালিকা প্রণয়ন করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত উলুগ বেগের তারার তালিকাই একমত্র তারার তালিকা ছিল।
মুসলিম যুগে জোতির্বিদ্যা অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন তো ছিলই না বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কঠোর সমাধান দ্বারা এমন সব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হয় যেগুলি আধুনিক জোতির্বিদ্যার ভিত্তিরূপে পরিগণিত হতে পারে। এ ছাড়াও মুসলিম জোতির্বিদগণ গ্রিক জোতির্বিদ্যার গ্রন্থসমূহের অনুবাদ করে যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন, সে জন্যই জোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁরা অমর হয়ে থাকবেন।
আরও পড়ুন অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৭ম পর্ব
৮ম পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার (৬ষ্ঠ পর্ব)