রোদেলা দুপুর কাঁদে (৩য় পর্ব)
রোদেলা দুপুর কাঁদে (৩য় পর্ব)
সেদিন লাইব্রেরীতে বসে নোট করছিলো অনিমা। হঠাৎ অনিক এসে পাশে বসলো। অবিন্যস্ত চুল, উসকোখুসকো চেহারা, পারিপাট্যহীন পোশাক, কেমন যেন অচেনা লাগছে তাকে। চোখে মুখে অযাচিত অস্থিরতা। তার দিকে তাকিয়ে অনিক বললো,
“তুমি কি আমাকে একটু সময় দিতে পারো অনিমা?’
তার কণ্ঠে মিনতি ঝরে পড়ছে। বই খাতা বন্ধ করলো অনিমা।
‘বলো’।
“এখানে নয় অনিমা, চলো গাছের ছায়ায় বসি।’
অনিমার বাম হাতটা ধরল অনিক। এমন অস্থির অগোছালো অনিককে আগে কখনো দেখেনি সে। ওকে এমন দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিলো তার। অনিমা উঠে দাঁড়ালো। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“চলো’।
অপেক্ষাকৃত একটু নির্জন জায়গায় বসলো তারা। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর অনিক বললো,
“তুমি আমার চিঠি পাওনি অনি?’
এই প্রথম ‘অনি’ বলে সম্বোধন করলো অনিক । অনিমা মাথা নিচু করে আছে। নিরুত্তর। অনিক আবার বললো,
“আমি জানি চিঠি পেয়েছো তুমি। নিজের সাথে যুদ্ধ করেছো একদিন একরাত। রুম থেকেও বেড় হওনি তুমি। কিন্তু কেন অনি? কিসের দ্বন্দ্ব তোমার? আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। জানো আমিও তোমাকে ভালোবাসি। তবে কেন এ লুকোচুরি? কিসের বাধা?’
একনাগাড়ে অধীর কণ্ঠে অনেকগুলো প্রশ্ন করলো অনিক।
আরও পড়ুন গল্প সোনালী
অনিমা খুব শান্তকণ্ঠে উত্তর দিলো,
‘বাধা আছে অনিক’।
“কিসের বাধা’?
আকুল জিজ্ঞাসা অনিকের।
‘আমার নিজের কাছেই নিজের বাধা। সেই বাধাকে আমি অতিক্রম করতে পারিনি। আমার অতীত আমাকে পিছু টেনে রাখে। এ আমার অরোধ্য অক্ষমতা। আমাকে ক্ষমা করো অনিক’।
মাথা নত করে আছে অনিমা। তার চোখে জল ।
‘আমিতো তোমার অতীত জানতে চাইনি অনি’।
‘কিন্তু আমি তো লুকাতে পারবো না অনিক। ভালোবাসায় কোন ফাঁক থাকতে নেই। মিথ্যার মালিন্য ভালোবাসাকে কলুষিত করে। আমি তা চাইনে। আবার আমার সেই পঙ্কিল অতীত শুনে যদি আমার ভালোবাসা আমাকে ছেড়ে চলে যায়, সে ভার আমি সইতে পারবো না। তার চেয়ে এই ভালো অনিক। তোমার ভালোবাসা আমি বুকে তুলে নিয়েছি, এ আমার পরম প্রাপ্তি। সারাজীবন এই ভালবাসাই আলো ছড়িয়ে আমাকে পথ দেখাবে।’
টপটপ করে অনিমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
‘আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না অনি। ঠিক আছে, তোমার না বলা কথা বলো তুমি। আমি সব শুনতে চাই। বলো, অনি’।
গভীর প্রতাশায় চেয়ে আছে অনিক।
আরও পড়ুন গল্প ওরা তেরোজন
সেদিন বিকেলে তার কষ্ট-দগ্ধ অতীতকে অনিকের কাছে মেলে ধরেছিলো অনিমা। একটুও ফাঁক ছিলো না কোথাও। সব শুনে অনিক বলেছিলো,
‘তোমার মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আমি। এই সব মহান মায়ের জন্যই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তুমি গর্বিতা মায়ের সন্তান। তোমার ত্যাগী বাবার প্রতিও মাথা নোয়াচ্ছি। কি অসাধারণ ত্যাগ! তোমার মায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আর তোমার জন্য সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি। তোমার সৌভাগ্য এমন পিতা-মাতার ঘরে তুমি জন্মেছো। আর তোমার বিয়েটা ছিলো দুর্ঘটনা। আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার সেই ক্ষতস্থানের জমাট রক্তকে মুছে দেবো আমি। তুমি আমাকে সুযোগ দাও অনি’।
অনিমার দুটো হাত জড়িয়ে ধরলো অনিক। চোখে গভীর মিনতি। ওর হাত শক্ত করে ধরে অনিমা বললো,
‘আজ আমার বুকের গুরুভার সরিয়ে দিলে অনিক। আমি আজ ভারমুক্ত হলাম।’
তার পরের বছর খানেক ছিলো তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। অনার্সের রেজাল্টেও হেরফের হল না। অনিমা প্রথম, অনিক দ্বিতীয়। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান অনিক অনিমার কথা বলেছে তাদের। মা একদিন বাসায় নিয়ে যেতে বলায় অনার্স রেজাল্টের পরেই অনিমাকে বাসায় নিয়ে গেলো অনিক। অনিন্দ সুন্দরী অনিমাকে দেখেই পছন্দ করলো বাবা-মা। ফেরবার সময় অনিকের মা আদর করে বললেন,
‘মা আগামী শুক্রবার ছুটির দিনে সকাল করে চলে এসো তুমি। অনিক তোমাকে নিয়ে আসবে। সারাদিন আমাদের সাথে থাকবে। খুশিতে ঝলমল করে উঠেছিলো অনিমার মন। কিন্তু বিধাতা অলক্ষে বসে হেসেছিলেন সেদিন। তাঁর পঞ্জিকার পাতায় ছিলো অশনি সংকেত।
আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা
শুক্রবারে এগারোটার দিকে এসে অনিমাকে নিয়ে গিয়েছিলো অনিক। সারাদিন ছিলো তাদের বাসায়। অনিকের মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছিলেন অনিমার আদ্যোপান্ত পরিচয়। কিছুই লুকায় নাই অনিমা। সব কিছুই খোলামেলা বলেছিলো মায়ের কাছে, যেমন বলেছিল অনিককে। বুদ্ধিমতি মহিলা কিছুই বুঝতে দেননি তাকে। একেবারে হাসিখুশি স্বাভাবিক ছিলেন সারাদিন। অনিমা বুঝেছিলো পরের দিন। ড্রাইভারকে নিয়ে বিকেলে তিনি সোজা চলে এসেছিলেন অনিমার হলে। গেস্ট রুমে বসেই অনিমাকে বলেছিলেন তিনি,
‘দ্যাখো মা, বিষয়টা বেশি দূর যাতে না গড়ায় সে জন্যেই আমি নিজে এসেছি। তুমি তো জানো অনিক আমাদের একমাত্র সন্তান। ওকে নিয়ে আমাদের একটা স্বপ্ন আছে। তোমার সব কথাই আমি অনিকের বাবাকে বলেছি। আমাদের একটা সোসাইটি আছে, স্ট্যাটাস আছে। আমরা চাই না তুমি অনিকের সাথে মেলামেশা করো। আমরা অনিককে বুঝিয়ে বলবো। আশাকরি তোমাকে ম্যাসেজটা দিতে পেরেছি আমি।’
অনিমা শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলো। অনেক কষ্টে অশ্রু সংবরণ করেছিলো সে। সে রাত ঘুমুতে পারেনি অনিমা। অনিকের মায়ের কথাগুলো তীরের মতো বিধছিলো বুকের মধ্যে। লজ্জায় অপমানে একবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো সে। কিন্তু বাবার জন্য পারেনি। বারবার বাবার ক্লান্ত মুখটা ভেসে উঠছিলো। মনকে শক্ত করেছিলো সে ইস্পাতের মতো।
কিন্তু ছেলেকে বোঝাতে পারেনি অনিকের বাবা-মা। পরদিনই ছুটে এসছিলো অনিক। হাত ধরে ক্ষমা চেয়েছিলো, কোর্টে বিয়ে করার প্রস্তব দিয়েছিলো, রাজি হয়নি অনিমা। ফিরিয়ে দিয়েছিলো অনিককে। তারপর অনেকবার অনিক এসেছে, তার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছে, দেখা করেনি অনিমা। ক্লাস করা ছেড়ে দিয়েছিলো অনিক। কখনো কখনো উদ্ভ্রান্তের মতো চলে আসতো ভার্সিটিতে। মাঝেমধ্যে মাতাল থাকতো, কিন্তু প্রতিবারই তাকে এড়িয়ে গেছে অনিমা। এর জন্য বন্ধু বান্ধবরা তাকে দুষেছে, কটু কথা বলেছে। অনিমা সকলের কথা সব নীরবে সয়েছে, সে কারো বিরুদ্ধে কোন অনুযোগ করেনি।
আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা
অত্যন্ত ব্রিলিয়্যান্ট ছাত্র অনিকের হঠাৎ ক্লাস বন্ধ করে দেয়া এবং অস্বাভাবিক আচরণ করাকে নিয়ে অনেক বন্ধুর মত শিক্ষকও অবাক হয়েছেন। মাস্টার্স পরীক্ষার আগে আগে একদিন বিভাগীয় প্রধান ক্লাসে অনিকের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। কেউ কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ বলতে না পারলেও সে যে মাঝেমধ্যে ভার্সিটি এলাকায় আসে সেটা জানালো অনেকে। তখন স্যার বললেন, “অনিক আসলে আমার রুমে নিয়ে এসো। হঠাৎ এতো ভালো ছেলেটার কি হল জানা দরকার।’
সত্যিই একদিন বন্ধুরা অনিককে প্রায় ধরে বেঁধে স্যারের রুমে নিয়ে গেলো। অনিককে দেখে বিস্মিত হলেন স্যার। সবসময় কেতাদুরস্ত পরিপাটি ছেলেটার একি অবস্থা ? একেবারে বিপর্যস্ত মানুষের মত। অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। মুখে খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি, এলোমেলো চুল, চোখের নিচে কালি পড়া, এ যেন অন্য এক অনিক। সস্নেহে পাশে বসালেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে অনিক ? ক্লাশে আসো না কেন?’
‘পড়তে ভালো লাগে না স্যার’।
নিঃস্পৃহ উত্তর অনিকের।
‘দ্যাখো অনিক, তোমাকে আর অনিমাকে নিয়ে আমাদের …।
কথা শেষ হবার আগেই উঠে দাঁড়ালো অনিক। একটু অস্থিরতা ওর মধ্যে। স্যারের পিছু ডাক অগ্রাহ্য করে বেড়িয়ে গেলো সে। বন্ধুরাও ফেরাতে পারলো না তাকে। সোজা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো অনিক। সেদিনই একটা বাসের সাথে বড় ধরনের এক্সিডেন্ট হল তার গাড়ির। প্রাণে বেঁচে গেলেও ডান হাত আর পা ভেঙ্গে যায় তার, স্পাইনাল কডের তিনটা ডিস্ক ডিসপ্লেস্ড, একটা ‘সিরিয়াসলি এনজিওর্ড। ঢাকায় বেশ কয়েক মাস চিকিৎসার পর সিঙ্গাপুর নেয়া হয় অনিককে। সেখানেও অনেক দিন থাকতে হয় তাকে। ফেরার পর ডাক্তারের পরামর্শে ৬ মাস পূর্ণ বেড রেস্ট। তারপর আবার ‘চেক আপ’। এভাবেই ৬ মাস পরপর চেক আপ’ এর জন্য ৩ বছর তাকে যাওয়া আসা করতে হবে সিঙ্গাপুরে।
আরও পড়ুন গল্প নীরুর মা
অনিমার কাছে যখন অনিকের এই দুর্ঘটনার সংবাদ পৌঁছালো, ভেতরটা হুহু করে কেঁদে উঠলো তার। এর জন্য নিজেকেই দোষী করছিলো সে। অনিক তো পরিবারের অমতেই তাকে বিয়ে করে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলো, সেই-ই রাজি হয়নি। তার অনড়তাই কি অনিকের এই অবস্থার জন্য দায়ী?
কোন ভাবেই নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছিলো না সে। বারবার অসুস্থ অনিকের পাশে ছুটে যেতে চাইছিলো মন। ইচ্ছে করছিলো অনিকের হাতটা ধরে সান্ত্বনা দিতে আর আদর করতে, কিন্তু পারেনি সে। প্রতিবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অনিকের মায়ের অহংকারী মুখ, তাঁর অপমানের তীব্রতা। কত রাত অনিকের জন্য নির্ঘুম কেঁদে কাটিয়েছে সে। ওর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়াও করেছে।
আরও পড়ুন রোদেলা দুপুর কাঁদে-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
রোদেলা দুপুর কাঁদে (৩য় পর্ব)