পথভোলা এক পথিক (২য় পর্ব)
পথভোলা এক পথিক (২য় পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
তখন আমি সবেমাত্র সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছি। থাকি মোহাম্মদপুর, বড় বোনের বাসায়। মোহাম্মদপুর হতে ফার্মগেট, তারপর সরকারী বিজ্ঞান কলেজ। দশটা-পাঁচটা কলেজ। পাবলিক বাসে আসা-যাওয়া। উপায় নেই। বিয়ে না করা পর্যন্ত আলাদা বাসস্থানে যাওয়া যাবে না, বড় বোনের নির্দেশ। দুলাভাই এজিবি অফিসে অডিটর পদে চাকরিরত। দুটো বাচ্চা। বোনের সাথে চুক্তি ছিলো মাস শেষে তাদের সংসারে কিছু অর্থ দেবো। বোন বলে কথা। প্রথমে রাজি হয়নি। অনেক পীড়াপীড়িতে রাজি হয়েছিল। ছোট দুটো ভাই-বোন এখন ছাত্র। বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। চাকরি বেশি দিন নেই। সংসারের কথা চিন্তা করে বিয়ের পথে এখনো হাটা হয়নি। দুলা ভাই তার এক অডিটর চাকরিজীবি মহিলার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিতে চায়। শুধু বলেছি সময় হলেই তোমাদের বলবো। এ বছরটা যাক। লিটনের মাস্টার্স শেষ হলে মেয়ে খুঁজিও। এরপর সবাই চুপচাপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বোন সেটাই চায়। পরের বাড়ির গৃহিণী হলে কি হবে, ভাই-বোনদের হাঁড়ির খবর রাখতে চায়। এটা মনে হয় বাঙালি মেয়েদের চরিত্রের আলাদা বৈশিষ্ট্য।
মাসটা ছিলো শ্রাবণ। সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে রাস্তার আশেপাশে সামান্য পানি জমে কাদা হয়েছে। গাড়ি হতে যখন নেমেছি সঙ্গে সঙ্গে তিন-চার জন স্কুল পোশাক পরিহিতা তরুণী বাসে উঠে গিয়ে তাদের মধ্যে একজন পা ফসকে পরে যাচ্ছিল। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। জলদি মেয়েটাকে ধরে ফেলি কিন্তু সেই মুহুর্তেই গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। না ধরলে মেয়েটি দুটো পা চাকার নিচে পিসে যেত। তাৎক্ষণিক মেয়েটি আমার বুকের ওপর মাথা রেখে সজোরে চেপে ধরে আছে। ওর শরীরের সকল শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে। কিছুই টের পাইনি কি হতে চলেছে। মিনিট খানেক পর হুস ফিরে পেলাম। হঠাৎ আমার সারা শরীর বিদ্যুৎ খেলে যায়, আর সাথে সাথে শরীর কেঁপে ওঠে।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
জীবনে এই প্রথম একজন যুবতী ষোড়শী কন্যা আমাকে সারা গায়ের শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে। অস্বীকার করবো না। শরীরে অন্য রকম শিহরণ জেগে উঠেছিল। বোধ ফিরতেই নিজেকে মুক্ত করে, মেয়েটিকে সামনে দাঁড় করাতে আতঙ্কে আর চোখ খুলছে না। ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। বুঝে উঠতে পারছি না ওর গায়ে হাত দিয়ে কিছু বলবো কি-না। পাশ হতে কে যেন চিৎকার করে বলে উঠলো-এই মেয়ে চোখ খোল। বড় বাঁচা বেঁচে গেছো। কথা শুনে চোখ খুলেই, চোখের দিকে তাকিয়ে আবার ভয়ে-লজ্জায় মুখ নিচু করে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। দেখলাম মেয়েটির মায়া ভরা চেহারায় দৃষ্টি নন্দিত চোখের চাহনি। জলদি মেয়েটাকে ফুটপাতের ওপর নিয়ে দাঁড় করালাম। কে যেন মেয়েটির ব্যাগ এনে আমার হাতে দিল। জনগণের মধ্যে কেউ কেউ বাসের ড্রাইভার আবার মেয়েটি বকাবকি করছে। আমি বললাম,
__দেখুন এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র।
__তা হয়ত বুঝলাম, আপনি ওখানে না থাকলে কি হতো ভেবেছেন? মেয়ে মানুষ একটা কিছু হয়ে গেলে আজীবন তাকে কে টানতো?
এখনি টানাটানি প্রশ্ন চলে আসছে! তার কথার মানে দাঁড়ায় মেয়ে বলে তাকে কেউ ঘরে নিবে না। অনেকে আবার বিভিন্ন ধরনের মন্তব্যে সহানুভূতি প্রদর্শন করে কেটে পড়ছে। মেয়েটি তখনো ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় থাকে এবং কিসে পড়ে সব জেনে নিলাম। সে আগামী বছর এপ্রিলে এসএসসি পরীক্ষা দিবে। আজ ক্লাস হবে না, তাই বাসায় ফিরে যাচ্ছে। মেয়েটির মুখের দিকে আবার তাকালাম। মিষ্টি চেহারা। মায়াভরা দুটো চোখ। দেখে মায়া হল। তার ব্যাগ হতে পানির বোতল বের করে হাতে দিয়ে বললাম,
__পানি খেয়ে নাও।
হাতের ঘড়িতে দশটা বাজার এখনো বিশ মিনিট বাকী। কলেজে যেতে দশ মিনিট সময় লাগবে। মেয়েটি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। নাম জানতে চাইলাম। কাঁপা কণ্ঠে বললো,
__শ্যামলী।
বলেই কৃতজ্ঞতায় মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। চেয়ে দেখলাম নিচের ঠোঁটের ডান দিকে কাটা দাগ। সহজেই চোখে পড়ে। ঠোঁট দুটো একটু খুলে মৃদ হেসে দিল। এর ফাঁকে ওর ঝকঝকে দু’পাটি সুন্দর দাঁতগুলো ঝলক মেরে বের হয়ে নিমিষে মিলে গেল।
আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা
আ-হা- রে “কোন কাননের ফুল, কোন গগণের তারা।” আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। আবার পড়াই বাংলা সাহিত্য। বরি বাবু আপনার দৃষ্টিপাত প্রসংশা করতেই হয়। আপনার চোখে এমন এক ফুল-তারা চোখে পড়েছিল তাই লেখেছিলেন-“তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা।”
ইতোমধ্যে বাস এসে স্টপজে দাঁড়াল। বললাম কখনো কোন ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করবে না। সাথে আর কিছু উপদেশমূলক বাণী ঝাড়লাম। শিক্ষক মানুষ তো, এ বয়সের সবাইকে ছাত্র-ছাত্রী মনে হয়। মুখের দিকে তাকিয়ে সম্বিত সুঁচক ঘাড়টা ডান দিকে ষাট ডিগ্রি ব্যাঁকা করল। তারপর ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে গাড়িতে গিয়ে একটা আসনে বসে পড়ল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কলেজ পথে রওনা দিলাম। মনে হলো জীবনে মনে রাখার মত ঘটনা। স্বাস্থ্য ভাল বলে বয়স অনুযায়ী একটু বড় বলে মনে হলো। শুধু তাই নয় হাতে-পায়ে লম্বা। ভ্যাগিস মেয়েটি আমার চেয়ে বার-তের বছরের ছোট তো হবেই, না হলে এতক্ষণে প্রেম মনের ভেতরে ঢেউ খেলা শুরু করে দিত। তবে ঘটনাটি দীর্ঘ দিন স্মৃতিকোঠায় বাস করবে।
আবার ভাবছি বয়স যাই হোক এমন ঘটনায় মানুষ তো প্রেমে পড়ে। তবে আমার দিক হতে এরূপ আশার আলো একেবারেই ক্ষীণ। এটাই শেষ দেখা। পথের ঘটনা পথেই থাক, স্মৃতিটুকু মনে থাক। নানান ধরনের আজগুবি চিন্তা মগজে ঠাঁই নিয়েছে। আবার মনের ভেতরে কেমন যেন শিহরণ অনুভব করছি। এটা কি যৌবনের একটা ধর্ম? ভাবতে ভাবতে কলেজ ক্যাম্পাশে ঢুকে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। ঢুকতেই দশটার ঘণ্টা বেজে সংকেত দিলো। এখনই ক্লাসে যেতে হবে। দেরি না করে হাজিরা খাতা হাতে করে ১ম বর্ষে ক্লাস নিতে ক্লাস রুমে ঢুকলাম। কিন্তু মনোযোগ সহকারে পাঠ্যদান না দিতে পেরে নিজেকে অপরাধী বোধ করছিলাম। সারাটা দিন এক অজানা দুর্চিন্তায় কাটিয়ে বাসায় ফিরি।
আরও পড়ুন গল্প চোখে দেখা নীল কণ্ঠ
বেশ তিন-চার দিন কেটে গেল। সব কিছু ভুলে গেছি। বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে চাকরি মানে শিক্ষকতা করে যাচ্ছি। সে দিন বৃহস্পতিবার। পাঁচটার একটু আগেই বের হয়েছি। সাধারণত হেঁটেই বাস স্টপেজে এসে পড়ি। আজও তাই। ওভার ব্রিজের পূর্ব দিকে নামতে হয় পশ্চিম পাশ হতে বাসে উঠি। আজকে যথারীতি ব্রিজ পাড় হওয়ার জন্য ব্রিজের মাথায় পোঁছাইতে সামনে এসে হাজির সেই মেয়েটি। সাথে সমবয়সী একটি মেয়ে। গায়ে সাধারণ পোশাক। তবে মার্জিত। আজ আরও উজ্জ্বল এবং উচ্ছ্বাস বলে মনে হল। চোখে-মুখে কেমন যেন আনন্দের ঢেউ। শেষ বিকেলের সূর্যের রক্তিম রশ্মি মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। কাছে আসতেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,
__আমি শ্যামলী। ঐ যে ক’দিন আগে….
__হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। ভাল আছো তো? আজ ক্লাস ছিল না?
__জিঁ-না। শুধু আপনার সাথে দেখা করার জন্য সেই তিনটা হতে অপেক্ষা করছি। আর ভাবছি দেখা হবে কি-না। বাসায় বকা খেয়েছি।
__কেন?
পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি আগ বাড়িয়ে বেশ মুরুব্বীর মত বলে উঠলো,
__বাহ! বকা খাবে না, সবাই ওকে চুমু খাবে?
বলেই জিব বের করে মাফ চাইল।
__আপনিই বলুন। যে মানুষটি জান দিয়ে ওকে প্রাণ বাঁচালো, তার পরিচয়-ঠিকানা নিতে ভুল করে বাড়ি ফিরল।
__দেখুন, ওর মত অবস্থা হলে সবার একই দশা হত।
আমার কথা শুনে মেয়েটি মুখের ভেতরে যতগুলো সাদা দাঁত ছিল পুঁটি মাছের মত ঝিলিক মেরে উঠলো, আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকানো মত হাসি দিয়ে উঠল। শ্যামলী এ বার মুখ খুললো,
__ও আমার বড় বোন। মাত্র দেড় বছরের বড়। একই ক্লাসে পড়ি। তবে অন্য স্কুলে। আজ শুধু আপনার খোঁজে সাথে এসেছে। খুব চিন্তায় ছিলাম। যদি দেখা না পাই। পথের মানুষ তো পথেই হারিয়ে যায়। ভাগ্যিস পেয়ে গেলাম।
আরও পড়ুন গল্প পরাজিত নাবিক
শ্যামলীর কথা শুনে থ হয়ে গেলাম। এই শ্যামলী কি সেই শ্যামলী? মুখে দার্শনিক ভাষা। কত আন্তরিক আর বিশ্বাস নিয়ে কথা বলছে। পথের মানুষকে ভাগ্যগুণে পেয়ে গেছে। এটা তার আনন্দ। দেখেই মনে হল।
__আপনার পরিচয় তো বলুন?
শ্যামলীর বড় বোনের প্রশ্ন। এর ফাঁকে বললো তার নাম মিতালী।
__এখানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে আছি। বাংলা পড়াই।
শ্যামলী তার আয়ত দুটো চোখ বড় করে বিস্ময়ের সাথে বললে উঠলো,
__আপনি প্রফেসর?
__না, প্রভাষক।
__জানেন,আমার দাদী আপনার জন্য মঙ্গল কামনা করে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। আর আমাদের বাড়িতে যেতে দাওয়াত দিয়েছেন। দাদীমার দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন।
আসলেই তো মেয়েরা চৌদ্দ-পনের বছরে পা রাখলে বুদ্ধিমতী বনে যায়। এদের কথা-বার্তায় তাই মনে হলো।
__যাব, তবে একটা শর্তে।
দুজনেই এক সঙ্গে কোরাশ সুরে বলে উঠলো,
__কি শর্তে?
দুজনের এসএসসি পরীক্ষার পর। কারণ জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে। তাহলে আজ যাওয়া যাক।
মনে হলো শ্যামলী আরো কিছুটা সময় থাকতে ইচ্ছুক। কিন্তু মিতালীর ইচ্ছে চলে যাওয়ার। হয়ত মনের ভেতর কিছুটা ঈর্ষার কারণ হতে পারে। বিদায় নিয়ে ব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছি আর শ্যামলীর কথা ভাবছি। সিঁড়ির শেষ মাথায় উঠে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি শ্যামলী বিষন্নতা ভরা মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ পড়তেই মুখখানা আবার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। হাত নেড়ে বিদায় জানাল। আমিও ডান হাত উঠিয়ে বিদায় জানালাম। আবার তাৎক্ষণিক ভাবছি, এটা কি হল? এটা কি ঠিক করলাম? একটা অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে তো প্রশয় দেয়া হচ্ছে না?
আরও পড়ুন পথভোলা এক পথিক-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
পথভোলা এক পথিক (২য় পর্ব)



