মরিচপোড়া-২য়-পর্ব; amadersujanagar.com
গল্প,  সাইফুর রহমান,  সাহিত্য

মরিচপোড়া (২য় পর্ব)

মরিচপোড়া (২য় পর্ব)

সাইফুর রহমান

 

সন্ধ্যার পরপরই তোমার মা বসলেন ইলিশ মাছ ভাজতে। মাছের সে কী সুগন্ধ। মনে হয় আধমাইল দূর থেকেও সেই মাছের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। মাছ তো নয় যেন ননির চাপ কেটে ভাজা হচ্ছে কড়াইয়ে। ইলিশ মাছের গন্ধে ভুরভুর করতে লাগল চারপাশ। সমস্ত বাড়ি ক্রমশ হয়ে উঠল ইলিশময়। তোমার মা নিজেকে আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারলেন না। এক টুকরো, দু টুকরো করে এক সময় সম্পূর্ণ মাছটিই খেয়ে ফেললেন। কাঁসার বড় থালাটিতে পড়ে রইল শুধু ল্যাজ আর ছোট ছোট দু-এক টুকরো মাছ।

হঠাৎ তোমার মায়ের খেয়াল হলো, সর্বনাশ হয়ে গেছে। কোন ফাঁকে তিনি মাছগুলো সব খেয়ে নিয়েছেন বুঝতেও পারেননি। এখন কী উপায়। সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ল আমার। তোমার মায়ের এমন বিপদে আমি না এসে পারি? কিছু সময় পর তোমার দাদি রসুইঘরে এসে তো একেবারে আগুন। মাছের টুকরোগুলো সব গেল কোথায়? তিনি অগ্নিমূর্তি হয়ে বললেন- সোয়া কেজি ওজনের মাছের আর সব কোথায় বৌমা! তোমার মা ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। ভূত দেখার মতো ভয়ার্ত চোখে শাশুড়িকে বললেন- ‘আমি তখন সবেমাত্র কড়াইয়ে মাছ ছেড়েছি। হেঁসেলের জানালার ওপাশ থেকে কে যেন খোনা গলায় বলল-আমায় একটা মাছ দিবি? খাব। আমি তো ভয়ে একেবারে কাঠ। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এক টুকরো মাছ ছুড়ে দিলাম জানালার গরাদ দিয়ে। ওপাশ থেকে খাওয়ার চপচপ আওয়াজ শোনা গেল স্পষ্ট।

তারপর আবার বলল- দিবি আরেক টুকরো। যদি নাঁ দিস তবে তোঁর বংশ নির্বংশ করে ছাড়ব। এভাবে বেশ কয়েক টুকরো মাছ দেবার পর হঠাৎ মনে হলো এর তো একটা বিহিত করা দরকার। তা না হলে যক্ষীবুড়িটা হয়তো সিন্দাবাদের ভূতের মতো অচিরেই চেপে বসবে এই সংসারে। একবার মনে হলো ডাকি আপনাকে কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম যক্ষীবুড়িটা যদি ওর লম্বা হাত দিয়ে আমার ঘাড় মটকে দেয়। ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি আঁটলাম মনে মনে। মাছ ভাজার খুনতিটার যে দিকটা তীক্ষ্ণ সে দিকটা ঢুকিয়ে দিলাম তোলা উনুনের জ্বলন্ত আগুনের ভেতর। ওটা ততক্ষণে তেতে লালবর্ণ ধারণ করেছে। অন্যদিকে যক্ষীবুড়িটাও জানালার ওপাশ থেকে মাছের জন্য আবার তাগাদা দিচ্ছে।

আরও পড়ুন গল্প একজন অনন্যা

আমি বললাম- বড় করে হা করো এবার। তোমার মুখে আমিই মাছ তুলে দিচ্ছি। যখনই যক্ষীবুড়িটা হা করেছে অমনি আগুনে লাল হওয়া খুনতিটা ঢুকিয়ে দিলাম ওর মুখে। যক্ষীবুড়িটা বিকট এক চিৎকার করে ছুটে পালাল।’ তোমার মায়ের মুখে এসব শুনে তোমার দাদি তো হতবাক। কী বলছে সালেহা এসব! হইচই হট্টগোল শুনে বাড়ির সকলেই ততক্ষণে রসুইঘরে এসে হাজির। তোমার মায়ের কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সবাই ছুটল জানালার ওপাশের জঙ্গলে। সেখানে সত্যি সত্যি দেখা গেল একটা দাঁড়কাক মরে পড়ে আছে ঝোপঝাড়ের মধ্যে। তারপর সকলে মিলে তোমার মায়ের সাহস ও বুদ্ধির সে কী প্রশংসা! ধন্য ধন্য রব চারদিকে।

মিতুজার সঙ্গে এভাবে হাস্য-পরিহাসে কথা বলতে বলতে হঠাৎ হালকা বাতাসে শাড়ির আঁচলটা ঈষৎ সরে যেতেই আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওর মধ্যপ্রদেশ বেশ খানিকটা স্ফীত হয়ে উঠেছে। ইতোপূর্বেও আমি ওর পদক্ষেপ ও চলাফেরা লক্ষ করেছি খুব সতর্কতার সঙ্গে। আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম- নিজের এত বড় সর্বনাশ কী করে করলে মিতুজা? তোমার শরীরের ভেতরে তো মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে আরেকটি শরীর।

মিতুজা আঁচলটি ঠিক করতে করতে বলল- এজন্যই তো তোমার শরণাপন্ন হয়েছি মংলু। তুমিই পারো আমার এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। আমি বললাম- কেন? তুমি জানো না বুঝি তোমার এত বড় ক্ষতিটা কে করল? মিতুজা নিচু স্বরে বলল- জানব না কেন। কিন্তু এই গৈ-গেরামে আমার জানার কি মূল্য আছে বলো। আমার কি সে কথা মুখ ফুইটে বলার উপায় আছে! তাহলি তো গেরামের লোক আমাক অসতী ভাববি। আমিই তখন হবনে কলঙ্কিনী। পথ আমি নিজেই খুঁজে নেব মংলু, তুমি শুধু আমার পাশে থাইকো। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম-তোমাদের মতো নিগৃহীতাদের পাশে থাকাই তো আমার বড় কাজ। চিন্তা করো না আমি আছি তোমার পাশে।

আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা

কয়েক দিনের মধ্যেই মিতুজার আচরণ ও কথাবার্তায় অসংলগ্নতা দেখা গেল। প্রতিদিনই মূর্ছা যাচ্ছে দু-একবার। মুখে অদ্ভুত সব কথাবার্তা। যে মিতুজা সাত চড়েও রা কাড়ে না সেই মিতুজার মুখ দিয়ে ছুটছে অশ্রাব্য সব গালাগাল । অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকার সময় কেউ তার সেবা-শুশ্রূষা করতে চাইলে মিতুজা তার বাপ-মা তুলে গালাগাল শুরু করে। প্রতিবেশীরা আড়ালে-আবডালে ফিসফাস করতে লাগল- মিতুজাকে আসলে ভূতে ধরেছে। ভূতসংক্রান্ত সংবাদগুলো সাধারণত কৈ মাছের মতো কানে হাঁটে দু-একদিনের মধ্যে সমস্ত গ্রামে চাউর হয়ে গেল মিতুজার ভূতগ্রস্ত হওয়ার সংবাদ।

শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেই ভাবতে লাগলেন কী করা যায় মিতুজাকে নিয়ে। গ্রামের প্রবীণতমজন আক্কাস মোল্লা শ্বশুর ময়েজ শেখকে পরামর্শ দিলেন অতিসত্বর মিতুজাকে ওঝা-বদ্যি দেখাতে। ঘোড়াদহ গ্রামে প্রসিদ্ধ কোনো ভূত-তাড়ানিয়া নেই। একজনের কাছে খবর পাওয়া গেল হেকমত কবিরাজ নামে পাশের গ্রাম পাকুন্দিয়ায় ভালো একজন ভূত-তাড়ানিয়া আছে। আরো জানা গেল যত বড় বজ্জাত ভূত-প্রেতই হোক না কেন হেকমত কবিরাজের কাছে তা ডালভাত। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় দুর্বল কিসিমের ভূত হেকমত কবিরাজকে দেখেই নাকি পলায় ঊর্ধ্বশ্বাসে। রোগীর চিকিৎসাপত্রও করতে হয় না তেমন।

ময়েজ শেখ ছুটলেন হেকমত কবিরাজের সন্ধানে। হেকমত কবিরাজ পাকুন্দিয়া গ্রামে প্রায় বছর দশেক ধরে বসবাস করলেও তার আদি নিবাস নেত্রকোনার তাহিরপুরে। এখানে তার ব্যবসার পসার ভালোই। ময়েজ শেখকে দেখেই হেকমত বললেন-রোগী কি মাইয়া না পোলা? ময়েজ শেখ কাচুমাচু হয়ে বলল- হুজুর ভূতে ধইরেছে আমার বড় ছাওয়ালের বৌক। লোটাভর্তি পানি মুখে পুরে কুলকুচি করতে করতে কবিরাজ বলল- বৌয়ের বয়স কত?
──এই ধরেন ষোলো-সতেরো।
──কয়দিন হইছে?
──এই তো চাইর-পাঁচ দিন।
──মাইয়ার আচার-আচরণ কেমন?
ময়েজ শেখ খুলে বললেন সব।
──হুম, বুঝলাম। না দেইখা বুঝতে পারতেছি না কোন কিসিমের ভূত। চোরাচুন্নি, দেও, কানাভুলা নাকি গেঁয়ো ভূত। এগুলার একটা হইলে অবশ্য তেমন সমস্যা নাই। কিন্তু নিশিভূত কিংবা কন্ধকাটা হইলে শরীলের ঘাম ঝরাইতে হইবো অনেক।

আরও পড়ুন গল্প রাজামারা

ময়েজ শেখ বিপন্ন কণ্ঠে বলল,
──হুজুর, অনেক সুখ্যাতি শুইনে আপনের কাছে আইসলেম। যেভাবেই হোক আমার এই উপকারখান আপনার করতিই হবি।
হেকমত কবিরাজ বলল- তাইলে শোনেন আমি ভূত-ছাড়ানির এইসব কাজ-কারবার শিখছি কামরূপ-কামাক্ষা থ্যাইক্যা। আমায় বয়স ছিল তখন কম। অনেক কুফরি কালাম শিখছিলাম। সেগুলা একসময় প্রয়োগ করতাম। আমার পায়জামার দুই পকেটে দুইটা ভূত থাকত। এক পকেটে একটা নিশিভূত অন্য পকেটে কন্ধকাটা। কন্ধকাটা মানে বুঝতে পারছেন তো? ময়েজ শেখ মাথা নাড়ে না বুঝবের পারি নেই।
──আরে কন্ধকাটা মানে হইলো যার ঘাড়ের মাথা কাটা পড়ছে সেই কিসিমের ভূত। আমার পোষা ভূত দুইটা দিয়া অন্য ভূতদের দৌড়ানি দিতাম। এখন বয়স হইছে; সেই সব কুফরি কালাম আর ব্যবহার করি না। নামাজ-কালাম ধরছি বহু বছর আগে। ভূতগুলা আমার এতটাই ভক্ত ছিল যে, আমি আদেশ করলে জয়ইন্তা পাহাড় থাইক্যা আমার জন্য কমলা ছিঁড়া নিয়ে আসত। তাজা পাতা দেইখা সকলেই স্বীকার করত মাত্রই গাছ থাইক্যা তোলা কমলা। আবার কখনো হিমালয় পর্বত কিংবা অন্য দেশ থাইক্যা কাঁচা এলাচি আইনা দিত। এখন সোজা পথেই ভূত তাড়াই। আইজ তো সন্ধ্যা হইয়া গেছে। নাম-ঠিকানা রাইখা যান। কাল সকালে হাজির হইয়া ভূতের গুষ্ঠি উদ্ধার কইরা আসমু। টেনশনের কারণ নাই। ও ভালো কথা, কিছু জিনিসপত্র কিনন লাগব, এক হাজার এক টাকা নজরানা রাইখা যান। বাদবাকি এক হাজার ভূত খেদানোর পর দিবেন।

আরও পড়ুন মরিচপোড়া-
১ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

মরিচপোড়া (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

সাইফুর রহমান মূলত একজন গল্পকার। মানবজীবনের বৈপরীত্য ও মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখিতা তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। প্রকাশিত নিবন্ধনগ্রন্থ: জানা বিষয় অজানা কথা, যুক্তি তর্ক ও গল্প, ভিঞ্চির কালো জুতো, করোনায় শেক্সপিয়র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য; গল্পগ্রন্থ: শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যান ও অন্যান্য গল্প, পক্ষিরাজের ডানা, মরিচপোড়া। তিনি ১৯৭৭ সালের ১২ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!