মরিচপোড়া (শেষ পর্ব)
মরিচপোড়া (শেষ পর্ব)
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ ময়েজ শেখের বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড। ভূত- তাড়ানি দেখতে জমায়েত হয়েছে প্রায় শ-খানেক লোক। ময়েজ শেখ যে ঘরটায় থাকেন সেই ঘরের বারান্দার চাল ঘেঁষে বিশাল এক নারিকেল গাছ আকাশ ছুঁয়েছে। সেই গাছের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধা মিতুজা। একটু দূরে শীতল পাটির উপর জায়নামাজ বিছিয়ে বসেছেন হেকমত কবিরাজ । তার সামনে টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র-একটা বড় কাঁচের বোতল, সরিষার তেল, ধুতরাপাতা, ঝাঁটা, গামছা, ধূপ ও তিনটা রক্তরঙা লম্বা লম্বা শুকনা মরিচ। ছোট একটা মালসায় ধরানো হয়েছে আগুন। জায়নামাজে বসে বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলেন হেকমত কবিরাজ। উপস্থিত মানুষজনদের উদ্দেশ করে তিনি বললেন- আপনাদের মইধ্যে যারা যারা আয়তুল কুর্সি জানেন তারা মনে মনে আয়তুল কুর্সি পড়েন। এই ভূতটা মনে হইতাছে খুবই খবিশ কিসিমের ভূত। সম্ভবত কন্ধকাটা। আয়তুল কুর্সি পড়লে ভূতের শক্তি আস্তে আস্তে কইমা আসব।
হেকমত কবিরাজ ময়েজ শেখকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
──কাউরে দিয়া কয়েক কলসি পানি আনান শেখ মিয়া। হেকমত জায়নামাজ থেকে উঠে গিয়ে মিতুজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। অন্যদিকে আমি গোবেচারা মংলু হেকমত কবিরাজের কেরামতি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে আশ্রয় নিলাম বারান্দার টিনের চালে।
মিতুজার অবনত মুখের দিকে তাকিয়ে কবিরাজ বলল,
──আমি জানি তুই কে! তুই ক্যান ওরে ধরছস? ও তোর কী ক্ষতি করছে?
আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি
মিতুজা মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল আর বলতে লাগল,
──ছাড় আমাক। আমাক ছাইড়ে দে।
হেকমত ঝাঁটাটি হাতে তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে কিছু দোয়া-দরুদ পড়ে ঝাঁটাটিতে ফুঁ দিয়ে গুনে গুনে সাতটা বাড়ি দিলেন মিতুজার শরীরে। না, কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বেশ কিছু গরম সরিষার তেল ঢুকিয়ে দেয়া হলো মিতুজার নাসিকারন্ধ্র দিয়ে। মিতুজা ঝাঁজের আতিশয্যে শুধু হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো শব্দ করল দু-তিন দফা। প্রতিক্রিয়া এতটুকুই। কবিরাজ উৎফুল্ল হয়ে উঠল কিছু সময়ের জন্য- মনে হইতাছে হ্যাঁচির সঙ্গে ভূতটাও বাহির হইয়া আসব এবার। না এবারও বিফল হলো কবিরাজ। মিতুজার ঘাড় থেকে ভূত বিতাড়িত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। আগের মতোই অবনত মুখ।
হেকমত কবিরাজ এবার মিতুজার দেবর মন্তাজকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন নতুন গামছা দিয়ে মিতুজার মুখমণ্ডল বেঁধে ফেলতে। মন্তাজও সঙ্গে সঙ্গে চাবি দেওয়া পুতুলের মতো গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলল ওর মুখ। কবিরাজ কলসি থেকে এবার পানি ঢালতে লাগলেন মিতুজার চোখে-মুখে। মিতুজা হাঁসফাঁস করতে লাগল কুরবানির ঈদে জবাই করা গরুর মতো। দু-তিন কলস পানি উজাড় হলো ঠিকই কিন্তু লাভ হলো না কিছু। কবিরাজ এবার পড়াপানি মিতুজার শরীরে ছিটিয়ে দিতে দিতে বললেন,
──ভালোয় ভালোয় মাইয়াডারে ছাইড়া যা কইতাছি। নইলে কিন্তু তোর কপালে খুব খারাপ আছে। ক তুই যাবি কি যাবি না? তুই যদি চইল্যা যাছ তইলে তোর নামে ভোগ চরামু। ঘোড়াদহ গ্রামের শেষ মাথায় যে শ্যাওড়াগাছটা আছে সেখানে অমাবশ্যা রাইতে তোর জন্য সোয়া পাঁচ সের চাউল, একশ এক টাকা, আর একটা কালো রঙের মুরগি রাইখা আসমু। তুই এখন ওর শরীর থ্যাইকা নাইমা যা।
আরও পড়ুন গল্প নীলভোর
মিতুজা এই প্রথম ভালো করে কথা বলল,
──না আমি নামব না। আমি ওর শরীরে থাকপো। আমি ওর কোনো ক্ষতি কইরবের আসি নেই। আমি ওর পেটের ভেতর যে বাচ্চা আছে সেটাক বাঁচাবের আইছি।
পেটের ভিতর বাচ্চা! হেকমত কবিরাজ যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। দেখ হেয়ালি করিস না। উল্টাসিধা বইলা আমারে ভুলাইতে পারবি না। মুখের চোয়াল শক্ত করে কথাগুলো বললেন কবিরাজ।
──আমি মিছে কথা কচ্চিনে। সত্যি সত্যি ওর পেটে বাচ্চা। এই কথা বলেই মিতুজা তার পরনের শাড়িটির বুকের আঁচল সরিয়ে দিল।
সমবেত লোকজনের মধ্যে কয়েকজন হৈ হৈ করে উঠল। সত্যিই তো মিতুজার পেটটা ফুলে উঠেছে বেশ খানিকটা। এ কি বলছে মিতুজা। স্বামী থাকে আবু ধাবি অথচ পেটে বাচ্চা!
উপস্থিত অনেকের চোখ এবার গিয়ে পড়ল মন্তাজের উপর। মন্তাজকে বাইরে থেকে যতটা সাদাসিধে গোবেচারা মনে হয় আসলে তো দেখা যাচ্ছে ও একটা বদের হাড্ডি। বড় ভাই বিদেশ-বিভুঁইয়ে অথচ ভাবিকে নিয়ে ফুর্তিতে ব্যস্ত। মানুষের গুঞ্জনগুলো পরিণত হলো শোরগোলে।
হেকমত কবিরাজ ময়েজ শেখকে বললেন,
──ছেলের বৌ তো আপনার পোয়াতি। গর্ভবতী মাইয়ারে এত কষ্ট দেওন যাইব না। এইবার একটা শেষ চিকিৎসা দিমু। যদি ভূত শরীল থেইক্যা নামে তো ভালো, না নামলে বিপদ আছে। এর আগে জানতে হইবো এই বাচ্চার বাপ কেডা।
কবিরাজ পুনরায় মিতুজার কাছে গিয়ে মন্ত্র পড়তে লাগলেন আর বলতে লাগলেন,
──ক এই বাচ্চার বাপ কেডা। যদি না কস তাইলে কিন্তু এই যে বোতলডা দেখতাছোস এইডার মধ্যে ঢুকাইয়া চিরদিনের জন্য মাটির নীচে পুঁইতা রাখমু।
নাহ, মুখ দিয়ে মিতুজার কোনো কথা নেই। কবিরাজ এবার শুকনো মরিচ তিনটি মালসার আগুনে পুড়িয়ে পুনরায় ধরলেন ওর নাকে। পোড়া মরিচের ঝাঁঝে মিতুজার শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। খক খক করে কাশতে লাগল মিতুজা। মুখ দিয়ে কথা বেরোতে লাগল এবার,
──আর অত্যাচার করিস না কবিরাজ! মিতুজার সর্বনাশ করেছে ওই ময়েজ শেখ। মাস তিনেক আগে একদিন রাতের বেলা জোর কইরে ঢুইকে মিতুজাক নষ্ট কইরেছে ওই ময়েজ। ওর ঘাড় মটকাবের জন্যেই আমি ভর কইরেছি মিতুজার শরীলে।
আরও পড়ুন গল্প সুরেন বাবু
উপস্থিত মানুষজন তো একেবারে হতবাক। ভূতের মুখে এ কী কথা! যৌবনকালে ময়েজ শেখ অনেক আকাম-কুকাম করে থাকলেও যৌবনের এমন পড়ন্ত বিকেলেও যে সে এমন আচরণ করবে সেটা সবার চিন্তারও বাইরে। শ-খানেক মানুষের প্রায় শ-দুয়েক চোখ গিয়ে পড়ল ময়েজ শেখের দিকে।
ময়েজ শেখকে দেখাচ্ছে একেবারে ফ্যাকাসে। মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকা ছাড়া তার কী বা করণীয় সে বুঝে উঠতে পারছে না। হেকমত কবিরাজ পুনরায় পোড়া মরিচ ধরলেন মিতুজার নাকে। মিতুজা কাশতে লাগল ভয়ানক ভাবে। কবিরাজ বললেন- তাড়াতাড়ি শরীল থ্যাইকা নাইমা যা, আর যাওনের আগে চিহ্নস্বরূপ ওই যে নিমগাছটা আছে ওইটার একটা ডাল ভাইঙা রাইখ্যা যা।
অন্যদিকে বারান্দার টিনের চালের উপর বসে বসে আমি তামাশা দেখছিলাম আর হা হা হা করে হাসছিলাম। ভাবছিলাম মিতুজার এত ক্ষমতা কোথায় যে নিমগাছের ডাল ভেঙে সে নিজের জীবন রক্ষা করবে। অথচ হেকমত কবিরাজের অত্যাচারও আমি আর সইতে পারছিলাম না। মনে মনে ভাবছিলাম কী করা যায়। ঠিক তখনই লক্ষ করলাম নারিকেল গাছটার মাথায় এক কাঁদি নারিকেল। ওগুলোর মধ্যে আবার দু-তিনটে একেবারে ঝুনা হয়ে আছে। আলতো করে একটু বাতাসের ছোঁয়া লাগতেই বড় আকারের একটি ঝুনা নারিকেল গাছ থেকে সোজা ভূপাতিত হলো হেকমত কবিরাজের মাথায়। হেকমত কবিরাজও সঙ্গে সঙ্গে চিৎপটাং। মানুষজন সব চেঁচিয়ে উঠল। এবার তাহলে সত্যি সত্যি ভূত নেমে গেল মিতুজার শরীর থেকে। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ঘোড়াদহ গ্রামে আমার কাজ এখানেই শেষ। কিন্তু আমাকে এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে অন্য কোনো গ্রামে নতুন কোনো মিতুজার খোঁজে। সেখানে হয়তো অন্য কোনো নিগৃহীতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
আরও পড়ুন মরিচপোড়া-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
মরিচপোড়া (শেষ পর্ব)