টেরাকোটা-আর্মি
ইমরুল কায়েস,  ভ্রমণকাহিনি,  সাহিত্য

টেরাকোটা আর্মি

টেরাকোটা আর্মি: মাটির নিচে এক দুর্ধর্ষ বাহিনী

ইমরুল কায়েস

 

উইচ্যাটে সিএপিপিসি (চায়না এশিয়া-প্যাসিফিক প্রেস সেন্টার) নামে একটা গ্রুপ আছে। এটি খুলেছে আয়োজকরা। গ্রুপে সপ্তাহের কার্যক্রম জানিয়ে দেয়া হয়। এই গ্রুপে জানানো হল ২২ জুন একটা ভার্চুয়াল ভিজিট আছে। টেরাকোটা ওয়ারিওর্স মিউজিয়াম ভিজিট। আমি অবশ্য ২০১৯ সালে একবার সরাসরি টেরাকোটা ওয়ারিওর্স মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। সেবার ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল চীনের এই বিস্ময়কর পুরাকীর্তি। টেরাকোটা আর্মি সম্পর্কে আরও বেশি জানা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এবারের ভার্চুয়াল ভিজিটেও যোগ দিলাম। ভার্চুয়াল প্রোগ্রাম থেকে টেরাকোটা আর্মিদের সম্পর্কে ধারণা যতটা পরিস্কার হল আগেরবার সরাসরি দেখেও তা হয়নি। কারণ সরাসরি দেখতে গিয়ে গাইডের অনেক কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনা হয়নি। কিন্তু এবার ভার্চুয়াল প্রোগ্রামে টেরাকোটা আর্মিদের আদ্যোপ্রান্ত সবই মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। ২০১৯ সালের সরাসরি দেখা এবং এবারকার ভার্চুয়াল দেখার মিশেলে টেরাকোটা আর্মিদের বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করব।

অক্টোবর মাস। চীনের প্রাচীন রাজধানী শিয়ানে তখন শীতের আমেজ শুরু হয়েছে। টুরিস্ট বাস থেকে নামতেই ঝিরঝিরে বাতাস এসে গায়ে শীতের পরশ বুলিয়ে যেতে লাগলো। ভেতরে ভেতরে আমরা সবাই কিছুটা উত্তেজিত। আমরা মানে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া গণমাধ্যম প্রতিনিধি দল। প্রধানমন্ত্রীর ডিপিএস (প্রেস) হাসান জাহিদ তুষারের নেতৃত্বে দলে আমি ছাড়াও কালের কণ্ঠের তৎকালীন সম্পাদক লেখক ইমদাদুল হক মিলন, বৈশাখী টিভির আবেদা সুলতানা মুক্তা, বাসসের আনিকা, যমুনা টিভির ভাস্কর ভাদুরীসহ মোট নয়-দশজন। দুই হাজার বছর আগে চীনা সম্রাটদের তৈরি মাটির নিচের টেরাকোটা আর্মিদের দেখার উত্তেজনা।

আরও ভ্রমণকাহিনী পড়ুন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেশে
টেরাকোটা-আর্মি-১
টেরাকোটা আর্মি

মিউজিয়াম চত্বরের ভেতরে ঢুকেই দেখি চারদিকে চোখ জুড়ানো সবুজের সমারোহ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য। বিশাল চত্বর জুড়ে সবুজ গাছগাছালি। গাছগুলো দেখতে অনেকটা ঝাউ আর হিজল গাছের মত। উচ্চতা বেশি নয়, ছোটছোট গাছগুলোর ডালপালা ছড়ানো ছিটানো। সারি সারি গাছের মধ্যদিয়ে পথ। যাওয়ার সময় মনে হল গভীর অরণ্যের মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা। পথটি সোজা না গিয়ে জায়গায় জায়গায় একটু বাঁক খাওয়া। হাঁটতে হাঁটতে যে কারোরই মনে হবে গাছগুলোর সঙ্গে হেলান দিয়ে একটু বসি অথবা অরণ্যের গভীরে হারিয়ে যাই। এমন পরিবেশে একটু লুকোচুরি খেলতে কার না মন চায়? কিন্তু আমাদের সে সুযোগ কোথায়? গাইডের পিছে পিছে হাঁটতে হচ্ছে। চার-পাঁচ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম মিউজিয়ামের সামনে। মিউজিয়ামের প্রবেশ পথে বেশ ভিড়। প্রচুর পর্যটকের সমাগম। প্রতিদিনই টেরাকোটা আর্মিদের বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন দেখার জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ভিড় করে।

টেরাকোটা আর্মি মিউজিয়ামের ভেতরে বিশাল বিশাল তিনটি হলঘর। এটাকে পিট (ধনুকাকৃতির ছাদ ও খালসহ বিশেষ হলঘর) বলে। এরকম মোট তিনটি পিট। আমরা ঢুকলাম এক নাম্বার পিটে। চার পাশ দিয়ে ঝুল বারান্দার মতো করিডোর। করিডোর থেকে মাঝখানের টেরাকোটা আর্মিদের অবলোকন করতে হয়। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম আমরা। মাঝখানের খালে টেরাকোটা আর্মিদের পোড়ামাটির মূর্তির লম্বা লম্বা সারি। পদাতিক বাহিনীর পাশাপাশি আছে ঘোর সওয়ার বাহিনী। সৈন্যদের র‍্যাংক অনুযায়ী বিন্যস্ত করা। তাদের পোশাক এবং টুপিগুলোও র‍্যাংক অনুযায়ী। সামনের সারির মূর্তিগুলো দেখে সহজেই বোঝা যায় তারা সম্রাটের সেনাবাহিনীর কমান্ডার স্থানীয়। করিডোরেও জায়গায় জায়গায় সেনাদের মূর্তি রাখা। মূর্তিগুলোর উচ্চতা ও দেহভঙ্গি তাদের পজিশন নির্ধারণ করে দেয়।

আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী ঘুরে এলাম পর্তুগাল

কমান্ডার ও জেনারেলদের মূর্তিগুলো সাধারণ সৈনিকদের চেয়ে একটু উঁচু এবং বিশাল। একজন কমান্ডারের নেতৃত্বে পুরো পদাতিক বাহিনী সুবিন্যস্তভাবে সাজানো। এই হলঘরে প্রায় ছয় হাজার সৈন্য ও ঘোড়ার মূর্তি রয়েছে। প্রত্যেক সৈন্যের হাতেই কোন না কোন অস্ত্র। সম্মুখ দিকের সেনারা তিনিটি সারিতে বিন্যস্ত। এর পেছনেই সমরাস্ত্র সজ্জিত মূল সেনাবাহিনী এবং ৩৮টি ঘোড়াচালিত রথের বহর। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সৈন্যদের একটি করে সারি মূল সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা দেয়াল হিসেবে স্থাপন করা। এক নাম্বার পিটের আয়তন ১৪ হাজার বর্গমিটার। লম্বায় ২১০ মিটার, চওড়ায় ৬২ মিটার এবং উচ্চতায় চার থেকে ছয় মিটার।

সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ও খনন কাজ চলায় সেবার দুই ও তিন নাম্বার পিটে যাওয়া হয়নি। এবার ভার্চুয়াল ভিজিট প্রোগ্রাম থেকে দুই ও তিন নাম্বার সম্পর্কে জানা গেল। দুই নম্বার পিটটি ইংরেজি এল অক্ষরের মতো। এর খনন কাজ এখনও শেষ হয়নি, চলছে। মাত্র দশভাগের এক ভাগ শেষ হয়েছে। আয়তন ৬ হাজার বর্গমিটার। এটি পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণে যথাক্রমে ৯৪ মিটার ও ৮৪ মিটার লম্বা। প্রথমটি থেকে এটি ২০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এই পিটটি চারটি ইউনিটে বিভক্ত। প্রথম ইউনিটে রয়েছে সারিবদ্ধ তীরন্দাজ বাহিনী। এখানে তিন হাজার ৩২ জন তীরন্দাজের মূর্তি পাওয়া গেছে।

অর্ধেক তীরন্দাজ তীর ছোঁড়ার পজিশনে দাঁড়িয়ে। বাকীরা হাঁটু গাড়া অবস্থায়। অর্থাৎ তারা তীর লোড করার অবস্থায় রয়েছে। এর অর্থ হল দাঁড়ানোদের তীর ছোঁড়া শেষ হলেই বাকীরা উঠে তীর ছুঁড়বে। অর্থাৎ তীরন্দাজদের অবস্থা দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে তারা বিরামহীনভাবে তীর ছুঁড়তে সক্ষম। দ্বিতীয় ইউনিটে যুদ্ধবাজ রথ এবং তৃতীয় ইউনিটে পদাতিক, অশ্বারোহী ও রথের সংমিশ্রণে বিন্যাস করা। চতুর্থ ইউনিটে সেনারা অস্ত্র হাতে কোনাকুনিভাবে দাঁড়ানো। চারটি ইউনিট মিলে একটি বিধ্বংসী যুদ্ধ বিন্যাস তৈরি করা হয়েছে। এ থেকে প্রাচীন ছিং সম্রাটদের সেনা বিন্যাসের একটি ধারণা পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন বিল গাজনার ইতিহাস

তিন নাম্বার পিটপি ইংরেজি ইউ আকৃতির। এটিও চারটি ইউনিটে বিভক্ত। এর আয়তন ৫ হাজার বর্গমিটার। পিটের একটা ইউনিটে অস্ত্রধারী সেনাদের অবস্থান। তবে ভার্চুয়াল প্রোগ্রামের লেকচারার জানালেন এসব অস্ত্রগুলো যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত হত না। এগুলো অনেকটাই সেরেমোনিয়াল। এ থেকে বোঝা যায় বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে এই সৈন্যরা সম্রাটকে অভিবাদন জানাতেন। এখানকার সেনাদের বেশিরভাগেরই মাথা নাই। পরবর্তীকালে এসব মাথা চুরি হয়ে গেছে বলে জানালেন চেকচারার।

টেরাকোটা-আর্মি-২
টেরাকোটা আর্মি

আরেকটা ইউনিটে পশুপাখির হাড়গোর পাওয়া গেছে। এগুলো সে সময়ের গৃহস্থালী কাজে ব্যবহৃত পোষা পশুপাখির হাড়গোড়। পশুপাখির মধ্যে রয়েছে ঘোড়া, হাঁস, সারস পাখি ইত্যাদি। বোঝা যায় ছিং সম্রাটরা হাঁস ও সারস পাখি খেতে খুব ভালবাসতেন। অবশ্য এখনও হাঁস চীনাদের মাঝে একটি জনপ্রিয় খাবারের আইটেম। অন্য ইউনিটে চারটি ঘোড়ার মূর্তি। সবশেষ ইউনিটে একটি বড় চেয়ার রাখা। এই পিটে কোন জেনারেলের মূর্তি নাই। লেকচারার জানান, প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা এ থেকে ধারণা করেন বড় চেয়ারটি আর কারো নয় বরং স্বয়ং সম্রাটের আসন। তিনিই এখান থেকে কমান্ড করতেন।

সেনাদের মূর্তিগুলোর মধ্যে রকমফের আছে। কিছু হালকা অস্ত্রে, কিছু ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। সেনাদের হাতে নানা ধরনের প্রাচীন অস্ত্র। যেমন-ব্রোঞ্জের তৈরি তলোয়ার, লোহার তৈরি তীর-ধনুক, বর্শা ও ছোরা ইত্যাদি। এসব অস্ত্র বিশেষভাবে তৈরি যাতে মরিচা না পড়ে। এ কারণে দুই হাজার বছর পরও এসব অস্ত্রে মরিচা ধরেনি। এখনও ঝকমক করছে যা সত্যিই একটা বিস্ময়। মূর্তিগুলোর একটির চেহারার সাথে আরেকটির মিল নেই, সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের মুখাবয়বের অভিব্যক্তিও ভিন্ন। সম্ভবত পদমর্যাদা অনুযায়ী এগুলোর অভিব্যক্তি দেয়া। হয়তো ছিং সম্রাটের সেনাবাহিনীর সদস্যদের চেহারার সঙ্গে মিল রেখেই মূর্তিগুলোর মুখাবয়ব ও শারীরিক গঠন দেয়া হয়। তাদের চুলের ধরনেও রয়েছে ভিন্নতা। কারণ প্রাচীনকালে চুলের বিন্যাস সামাজিক পদমর্যাদার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হত।

আরও পড়ুন আমাদের আত্রাই নদী

মূর্তিগুলো বিশ্লেষণ করে দুই রকমের চুলের ধরন পাওয়া যায়। প্রথম শ্রেণীর মূর্তিগুলোর চুল খোঁপা করে মাথার ডান পাশে বেঁধে রাখার মতো করে গচ্ছিত। দ্বিতীয় শ্রেনীর চুল অনেকটা দড়ির মতো পেঁচিয়ে তারপর খোঁপা করে মাথার ঠিক উপরের দিকে বাঁধা এবং কাপড়ের আদলে আবৃত করে রাখা। কোন কোন মূর্তিতে চুল বাঁধার জন্য কাঁটা, রাবার ব্যান্ড এবং ফিতার ব্যবহার লক্ষণীয়। সেনা মূর্তিগুলোর গড় উচ্চতা ১৭৫ থেকে ২০০ সেন্টিমিটার। তুলনামূলকভাবে জেনারেলদের উচ্চতা বেশি। সামরিক বাহিনীতে মর্যাদা অনুযায়ী মূর্তিগুলোর পোশাক-আশাক এবং সাজসজ্জায় পার্থক্য বিদ্যমান। লোহার বর্ম পরা জেনারেলদের গায়ে দুই স্তরের পোশাক। লোহার বর্ম শত্রুর আক্রমণ থেকে জেনারেলদের রক্ষা করতো। বিশেষ করে তাদের ঘাড়, গলা ও মাথা। তাদের পায়ে চারকোণা আকৃতির এবং সামনের দিকে একটু উঁচু জুতা।

অন্যান্য সশস্ত্র যোদ্ধাদের পোশাক বেশ ভারী ও গলবদ্ধ। সামনে-পেছনে বর্ম দিয়ে আবৃত যা তাদের বুক, পিঠ ও কাঁধের সুরক্ষায় ব্যবহার করা হত। তবে অশ্বারোহী বাহিনীর পোশাক পরিচ্ছদ আলাদা। তাদের মাথায় পিলবক্স টুপি, গলায় স্কার্ফ এবং বুক ও পিঠ হালকা বর্ম দ্বারা আচ্ছাদিত। সৈন্যদের সুশৃঙ্খল বিন্যস্তকরণ দেখে সহজেই অনুমান করা যায় প্রাচীনকালে চায়নার ছিং সম্রাটদের সেনাবাহিনী কেমন ছিল। বাস্তবের এই বিমূর্ত মূর্তিগুলোর মতোই একদা প্রতাপশালী চীনা সম্রাটরা সেনা সমাবেশ ঘটাতো। যুদ্ধের ময়দানে বিপক্ষ সৈন্যদের রক্তের ফল্গুধারা বইয়ে দিত। মনে হয় হাজার হাজার বছর ধরে সেনারা এভাবে দাঁড়িয়ে আছে শুধুমাত্র একটি নির্দেশের অপেক্ষায়। সম্রাট নির্দেশ দিলে এখনই যুদ্ধ শুরু করবে তারা। সবুজ প্রকৃতি আবারো রঞ্জিত হবে লাল রক্তে।

আরো পড়ুন চরদুলাই গ্রাম পরিচিতি

চীনের পোড়ামাটির তৈরি টেরাকোটা আর্মিদের একটি ইতিহাস বা মিথ রয়েছে। এটি কতটুকু সত্য বা মিথ্যা তা বলা মুশকিল। মাটির নিচে প্রাচীন সভ্যতার এই অনন্য নির্দশনটি তৈরি হয়েছে দুই হাজার বছর আগে ছিং সম্রাটদের আমলে। খ্রিস্টপূর্বাব্দকালে চীনের ছিং সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট ছিং শি হুয়াং মাত্র তের বছর বয়সে ছিং রাজ্যের রাজা হন। শিয়ান ছিল তাঁর রাজধানী। সিংহাসনে আরোহনের পরপরই ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোযোগী হন তিনি। ক্ষমতারোহনের ২৫ বছর পর ২৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট ছিং শি আশপাশের ছয়টি রাজ্য এবং সংযুক্ত এলাকা জয় করতে সমর্থ হন। এভাবে ঐক্যবদ্ধ চীনের প্রথম সম্রাট হন তিনি।

কিছুদিনের ভেতরেই সম্রাটের মধ্যে একটি অদ্ভুত ভাবনার উদয় হয়। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে তাঁর নিরাপত্তা কিভাবে রক্ষিত হবে। এই ভাবনার আলোকে জীবিত থাকতেই নিজের কবর তৈরি এবং একে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য মানুষের আদলে পোড়ামাটির একটি বাহিনী তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। অনতিবিলম্বে কাজ শুরু করেন সম্রাট। সাত লাখের বেশি লোককে এই কাজে নিযুক্ত করা হয়। বিপুল সংখ্যক মৃৎশিল্পীর বহু বছরের চেষ্টায় মাটির নিচে নির্মিত হয় ৮ হাজার সৈনিকের একটি সেনাবাহিনী। এই বাহিনীকেই টেরাকোটা ওয়ারিওর্স বলে। বর্তমান সিচুয়ান প্রদেশের মৃৎশিল্পীদের এই কাজে লাগানো হয়। ২১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট ছিং শি’র মৃত্যুর পর তাঁকে এখানে সমাহিত করা হয়।

সময়ের আবর্তে কেটে যায় দুই হাজার বছরের বেশি সময়। ধীরে ধীরে মাটির নিচে চাপা পড়ে যায় প্রাচীন এই পুরাকীর্তি। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে শিয়ানের লিনটাং অঞ্চলের একদল কৃষক কৃষিকাজের জন্য মাটির নিচ থেকে পানি তোলার জন্য একটি কূপ খনন করতে শুরু করেন। কিছুটা খনন করতেই সেখানে মাটির তৈরি হাত-পা এবং ব্রোঞ্জের তৈরি তীরের ফলা বেরিয়ে আসে। খবর পেয়ে ছুটে আসেন চীনের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকজন। জায়গাটির কিছু অংশ খনন করে এই বিশাল সেনাবাহিনীর খোঁজ পান তারা। প্রত্নতাত্ত্বিকরা গবেষণা করে বের করেন চীনের প্রথম সম্রাট ছিং শি হুয়াংই এই বিশাল বাহিনীর নির্মাতা। পরবর্তী সময়ে খননকার্য চালিয়ে সম্রাট ছিং শি হুয়াংয়ের সমাধিসহ একেবারে মানুষের মতো দেখতে হাজার হাজার পোড়ামটির সৈন্য এবং ঘোড়ার মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। সমাধিটি এখনও অবিকৃত অবস্থায় আছে।

আরও পড়ুন দুলাইয়ের জমিদার আজিম চৌধুরী

১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো মাটির নিচের এই টেরাকোটা আর্মি এলাকাটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে। সমাধিসহ পুরো এলাকার আয়তন প্রায় ৫৬ বর্গকিলোমিটার। বিশ্বের শীর্ষ ২৫ টি মিউজিয়ামের মধ্যে এর অবস্থান। চীন ও এশিয়ায় প্রথম স্থান (২০১৮)। ১৯৭৯ সালে উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত একশ মিলিয়ন বা দশ কোটির বেশি পর্যটক এই মিউজিয়াম পরিদর্শন করেছেন। গড়ে প্রতিবছর দুই মিলিয়নের বেশি পর্যটকের পদচারনায় মুখর হয় এই মিউজিয়ামটি। বিভিন্ন সময়ে টেরাকোটা মিউজিয়াম পরিদর্শন করেছেন বিশ্বের ২২৪ টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান।

পুরাকীর্তি কত সুন্দর করে রাখা যায়, পর্যটনের কেন্দ্রে পরিণত করা যায় তা টেরাকোটা আর্মি মিউজিয়াম না দেখলে বুঝতে পারতাম না। একটা পুরাকীর্তি এলাকাকে বিশাল একটা পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ আসছে। তারা দেখছে আর প্রাচীন চীন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করছে। বিনিময়ে সমৃদ্ধ হচ্ছে চীনের আর্থিক ভান্ডার। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক সামন্ত রাজা বিশেষকরে জমিদাররা নানা জায়গায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছে। আছে তাদের প্রাসাদ, সমাধিক্ষেত্র। কিন্তু নেই কেবল সেগুলোর যত্নআত্মি। সংরক্ষণের অভাবে সেগুলোর অনেক ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার নিজ এলাকা পাবনার সুজানগরে এরকম তাঁতিবন্দের বিজয় বাবু ও দুলাইয়ের আজিম চৌধুরীর দুটি জমিদার বাড়ি ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। এগুলো সংরক্ষণ করা যায়নি। মনে আফসোস জাগে, আহা এগুলো যদি সংরক্ষণ করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেত তাহলে কতই না ভাল হত।

আরও পড়ুন চীনের ডায়েরি-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৮ম পর্ব
৯ম পর্ব
১০ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

টেরাকোটা আর্মি

Facebook Comments Box

সাংবাদিক ও লেখক ইমরুল কায়েসের পুরো নাম আবু হেনা ইমরুল কায়েস। মিডিয়া ও লেখালেখিতে ইমরুল কায়েস নামেই পরিচিত। প্রকাশনা: আনলাকি থারটিন অত:পর প্যারিস, রোহিঙ্গা গণহত্যা: কাঠগড়ায় সুচি, চায়না দর্শন, বিখ্যাতদের অজানা কথা; অনুবাদ গ্রন্থ: দ্য রুলস অফ লাইফ, দ্য লজ অফ হিউম্যান নেচার, দ্যা আইজ অফ ডার্কনেস। তিনি ১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত তাঁতীবন্দ ইউনিয়নের পারঘোড়াদহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!