কবিতা,  গল্প,  রাতুল হাসান জয় (গল্প),  সাহিত্য

জীবনের উপহাস (শেষ পর্ব)

জীবনের উপহাস (শেষ পর্ব)

রাতুল হাসান জয় 

 

আজ কেন যেন এতদিন পর চিঠিটা পড়ে ভেতরে ভেতরে এক রকম মরে যাচ্ছি। বুকের ভেতরটা ভিজে উঠছে একদম। আমার হাত কাঁপছে। হাতে থাকা চিঠিটার ওপর কখন যে চোখ বেয়ে কিছু হাহাকার গড়িয়ে পড়ে ভিজে গেছে চিঠিটা, টেরই পাইনি। চাকরির বাজারের এই দূর্মূল্যের দিনে একটা বেসরকারি চাকরি জুটেছিল। কোম্পানির দূর্নীতির ফলে লসের খাতায় নাম লিখিয়ে কোম্পানি ছাটাই করে আমার কতো অনেক চাকুরের। এরপর সহজে চাকরি জোটে না। সরকারি চাকরি তো অমাবস্যার চাঁদ। বাধ্য হয়েই টিউশনি করাচ্ছি একটা, মেয়েটার নাম আয়েশা। সামনেই ইন্টার পরিক্ষা তার…

আর্শির মাস্টারদা আজ হঠাৎই চিঠির উত্তর লিখতে বসেছিলো। লিখেছিলো তার গোপন অনুভূতি। সকালের আলো ফুটতেই পুড়িয়ে দিয়েছে সে পত্র। কিছু অনুভূতি গোপন রাখতে হয়। কিছু অনুভূতি কাউকেই জানাতে হয়না।

মন খারাপ যদি জ্বরের মতো থার্মোমিটার দিয়ে মাপা যেত। তাহলে এখন থার্মোমিটার এর সর্বোচ্চ সংখ্যায় থাকতো। হয়তো তার চেয়েও বেশি। লোড না নিতে পেরে থার্মোমিটার ব্লাস্ট হয়ে যেত। কবি হলে এই মুহুর্তে একটা দারুণ কবিতা রচনা করা যেত। মানুষ তার আনন্দ গুছিয়ে লিখতে না পারলেও কষ্ট গুছিয়ে লিখতে পারে। আমার মনে হয় প্রতিটা ভঙ্গুর মানুষই নিজের ভিতরে গোপনে কবিসত্তা লালন করেন। সবারই নিজস্ব অনুভূতির দেয়াল আছে। যেখানে শব্দ সাজায় নিজের মতো করে। আমার মাথায় ও এই মুহুর্তে কিছু লাইন ঘুরছে লাটিম এর মতো ভনভন করে।

বাঁদুর ডানায় রাত্রি হলো গাঢ়ো
স্মৃতির চাদর ঢাকছে গা’য়ে আরো,
কাঁঠাল বনে চন্দ্রের উঁকিঝুঁকি
মন জিগালো, জোছনা পেয়ে সুখী?
শুকনো পাতায় জোনাক ফুলের আলো
রূপবতী! চন্দ্র রাতের -কালো।
মনের অসুখ মনের চোখে জল
জোছনা কেন বৃষ্টি মতোন?
চাইছে কবি অন্ধকার অতল।

নতুন চাকরি এখনো হয়নি, আর্শির চিঠি পাওয়ার পর আর আয়েশাকে পড়াতে যাইনি। গতকাল রাতেও আয়েশার বাবা ফোন করেছিলেন। রিসিভ করি নি। আমার মনে হচ্ছে উনি আর ফোন করবেন না। উনি একজন নতুন শিক্ষক খুঁজবেন। সেই শিক্ষক সুন্দর করে বলবে আশু বুঝতে পারছো?
মৃদু ঘাড় নেড়ে সে বলবে জ্বী স্যার। তারপর কপট রাগে বলবে আমার নাম আয়েশা, ‘আশু’ বলবেন না আপনি। স্যার তখন কি বলবে? তোমার খাতায় লেখা দেখলাম বড় করে ‘আশু’ তাই ভাবছিলাম নাম ছোট করেছো!

গত তিন দিন ধরে মা হাসপাতালে ভর্তি। ফারহান আছে সাথে। আমায় জড়িয়ে ধরে ও খুব কেঁদেছে সন্ধ্যায়। এসএসসি পরীক্ষার্থী সে। ডাক্তারদের হাতের লেখা না বুঝলেও চোখমুখের ভাষা সে বুঝতে পারছে। ডাক্তার’রা খারাপ কিছুর আশঙ্কা করছে। প্রথমদিনের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার শাসিয়েই বলছেন। এতদিন ডাক্তার দেখাননি কেন? এখন আর অপারেশন করেও কিছু করা যাবেনা।

মা কখনোই বলেন নি উনার খারাপ লাগছে। মাঝে মাঝে বলতো মাথা ধরেছে। একটু শুয়ে থাকতো চুপচাপ। তারপর আবার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতো। আজ বুঝতে পারছি কতটা যন্ত্রণা লুকিয়ে ছেলেদের জন্য হাসিমুখে সবকিছু করতেন উনি। দারিদ্রতা কি মায়েদের মুখ বেঁধে দেয়? মাথায় আরো দুই লাইন খাবি খাচ্ছে মাছের মতো।

দরিদ্রতা বেঁধে দেয় মায়েদের মুখ
সংসারে সুখ দেয় ভিতরে পুষে অসুখ।

ফোন বাজছে। স্ক্রিনে একটা অপরিচিত নাম্বার। আমি জানি হাসপাতাল থেকে ফোন করেছে। মা আর দুনিয়ায় নেই। মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এই ব্যাপারটা আমি প্রথম বুঝতে পারি বাবার মৃত্যুর সময়। তখনও এমনই মনে হয়েছিলো আমার। কেন মনে হয়েছিলো জানি না।

মা চলে গেছেন। সাড়ে তিনহাত এক ভয়াবহ সুন্দর ঘরে মা’কে রেখে এসেছি। আমাদের জীবনটা এখন কেমন হবে? রাত করে ঘরে ফিরলে মা ভাত নিয়ে অপেক্ষা করবেন না। জ্বরে গা পুড়ে গেলেও কপালে হাত দিয়ে দেখবেন না। ছোট ভাইটার দুষ্টামিতে ধমকাবেন না। বাসায় ফিরলে জিজ্ঞেস করবেন না চাকরির কিছু হলো? মা’কে ভয়াবহ সুন্দর ঘরে রেখে আসার কিছুক্ষণ আগেই জয়েনিং লেটার আসছে। একটা নামি-দামী বেসরকারি কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম এক মাস আগে। চাকরিটা আরো কিছুদিন আগে হলে মা’কে ভালো একটা হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারতাম। আল্লাহ কি প্রিয় জিনিস এর বদলেই কিছু দেন? তাছাড়া দেন না?

প্রকৃত অর্থে মানুষ নিজের জন্য বাঁচে না। কারো না কারো জন্যই বাঁচে। কোন স্বপ্নের জন্যই বাঁচে। আমার স্বপ্নেরা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। ফারহান, তার জন্যই সুন্দর করে বাঁচতে হবে। আর্শির কি বিয়ে হয়ে গেছে? সে কি এখন বিদেশে আছে? তার স্বামী নিশ্চয়ই ভালো মানুষ। বৃষ্টিতে কদম পানি ছিটায় চোখেমুখে। বিদেশে কি কদম ফুল পাওয়া যায়?

মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। সবকিছু হারিয়ে ভিতরে কবিসত্তা ঢেউ খেলছে রাগী পদ্মার ঢেউয়ের মতো।

অপেক্ষার অবসান দেয়নি সেই চিঠি
উস্কে দিয়েছে চাপাপড়া আগুন,
আমি তো চাইনি বারোমাসি চৈত্রে জ্বলা জীবন
কাঁচের জারে বন্দি থাকুক ফাগুন।
‘মাস্টারদা’ ডাক হারাবে, মানুষটা ও
মমতার হাত হারাবে এমন করে,
জীবনের উপহাসে হাসবে সময়
গড়ার আগেই ঘর হবেনা বিনা মেঘের ঝড়ে।
চাইনি এমন বারোমাসি চৈত্রে জ্বলা জীবন
কাঁচের জারে বন্দি থাকা ফাগুন,
জ্বলে পুড়ে কয়লা হওয়া মন
নতুন করে জ্বালাবে কোথা আগুন?

আরও পড়ুন জীবনের উপহাস-
১ম পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

জীবনের উপহাস (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!