একজন-কিশোরীর-প্রেম-শেষ-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

একজন কিশোরীর প্রেম (শেষ পর্ব)

একজন কিশোরীর প্রেম (শেষ পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

──জানো বৌদি, দেশ ছেড়ে যাওয়ার ঠিক রাতে কি ঘটেছিলো? আমরা দেশ ছেড়ে চলে যাবো এটা মোটামুটি সিদ্ধান্ত ছিলো। সব জায়গায় কেমন যেন থমথমে আতঙ্কভাব। নিরাপত্তার অভাব সবার ভেতরে। আমাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেছে। যারা কিনেছিল তারাই বাবাকে আশ্বাস দিয়েছিলো সুযোগ বুঝে বর্ডার পাড় করে দিবে। তারা কথা রেখেছিলেন। কিন্তু বর্ডার পাড় হয়ে আমাদের বেশ ক’মাস কষ্টে দিন কাটাতে হয়েছিল। মামা আমাদের সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। তখন গ্রামের কথা খুব মনে পড়তো। দিন তো সমান যায় না।
──প্রতিবারের মতো এবাবও দূর্গাপূজা দেখতে গেছি ঠাকুর বাড়িতে। বিমলদা তার বন্ধুদের নিয়ে রাতে ঠাকুর বাড়িতে, আর সঙ্গে ছিলেন তাদের একমাত্র মুসলমান বন্ধু সাগর। তারা প্রতিবারের মতো এবারও মজা করবে। জানা ছিলো না এটাই এ দেশের শেষ রাত আর শেষ পূজা। আর কখনো দেখা হবে না কাছের মানুষদের সাথে। নিয়তি আড়ালে বসে হেসে বলছে চিনু মনের মানুষকে শেষ বারের মতো প্রাণ দিয়ে দেখে নে। গায়ে নতুন ফ্রক-সালোয়ার। মনটা পরে আছে সাগরের দিকে। দেখা হবে তো। হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত চারিদিক। সবাই দূর্গা দেখার জন্য ব্যতিব্যস্ত আর আমি খুঁজছি আমার দেবতাকে। অবশেষে দেখা মিললো। বোকা বোকা চেহারায় সাগর এসে দাঁড়ালো প্রদীপদার পাশে। প্রদীপদার মন খারাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ দাদা সাগরকে জড়িয়ে ধরে। দাদা কি জানতো সাগরের সাথে আর কোন দিন দেখা হবে না?

এক সময় দাদা সাগরদাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। এই সুযোগে মার চোখ ফাঁকি দিয়ে সাগরদার কাছে এসে দাঁড়াই। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। চোখের পলকে তাকে নিয়ে অন্ধকার একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াই। সাগরের মুখে কোন কথা নেই। কখন যেন ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম আর ওর বুক পকেটে একটা ছোট কাগজের টুকরো গুঁজে দিয়ে ঝড়ের বেগে চলে যাই মার কাছে। মা বড়ই চতুর আর চালাক। সে সব দেখেছে, তবে বাধা দেয়নি। সে জানতো আজ রাতেই সব দেনা-পাওনা শেষ হবে। স্মরণীয় হয়ে থাকলো ১৯৬৫ সনের পাক-ভারত যুদ্ধের কিশোরী প্রেমের সমাপ্তি।

আরও পড়ুন গল্প সোনালী সকাল

বাবা-মার মনে হয়ত ভয় ধরেছিলো, এই দুটো কিশোর-কিশোরী যৌবনে পা রাখলে আরও বিপদে পড়তে হবে। কেলেংকারী হতে পারে এই আশঙ্কায় জন্মভূমি ত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। যাতে ভবিষ্যতে কোন বিপদে পড়তে না হয়। অনেক পরে দিদির মুখে শুনেছিলাম। কিন্তু সাগর তো আমার হৃদয়ে আঘাত করতো প্রতি মূহুর্তে। আস্তে আস্তে থেমে যায়, শুধু স্মৃতি হয়ে রইলো। ভাবতেই পারিনি আবার দেখা হবে। কাগজের টুকরোতে লেখেছিলাম,

“আবার হবে তো দেখা
এই দেখা শেষ দেখা নয় তো।”

প্রদীপ দা এই গানটা প্রতিদিন গাইতো।
সাগর নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছে চিনুর বেদনামাখা কথাগুলো। নিজে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। বিমল সব জানে। ওদের এসএসসি’র টেস্ট পরীক্ষা। অনেক দিন ধরে মন খারাপ করে নীরবে কাঁদতো।
──চিনু, তোমার মতো সাগরও খুব কষ্টে অনেক দিন অতিবাহিত করেছে। এখনো হয়ত মনের ভেতরে মাঝে মাঝে ঝড় বয়ে যায় সেটা বুঝার উপায় থাকে না। জীবনের প্রথম অনুভূতি আর আবেগের প্রেম। এখন তোমরা তোমাদের ফেলে আসার কষ্টগুলোই মনের ভেতরে ধরে রেখেছো। এটা কত পবিত্র প্রেম। যদি এর বিপরীত কিছু ঘটে যেতো লজ্জায় কারো মুখোমুখি হতে পারতে না। এখন কত সহজে আমাদের সামনে দু’জনের অনুভূতির কথা বলে মনকে হালকা করলে। বাসন্তী আর আমি এমন একটা পবিত্র প্রেমের স্বাক্ষী হয়ে থাকলাম।

আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা

বাসন্তী বৌদির বসার ঘর ক্ষণিকের জন্য নিস্তব্ধতায় ভরে গেলো।
চিনুই নিরবতা ভেঙে বৌদিকে বললো,
──দিদি, সাগরদাকে সকালের জলযোগ করাবে না?
──তাই তো। বৌদি ঠিক বলেছো। সবাই চলো খাবার ঘরে।
সাগর ভাবছে, চিনু বাসন্তী বৌদিকে দিদি বলছে আর বাসন্তী বৌদি চিনুকে বৌদি বলে ডাকছে। আসলে এদের সম্পর্কটা কি জানতে হবে। কিন্তু চতুর বৌদি বাসন্তী টের পেয়ে গেছে। খাওয়ার টেবিলে দুজনের সম্পর্ক খোলাসা করবে। খাবার টেবিলে গরম গরম লুচি সাথে সবজি এবং খেজুরগুড়ের পায়েস। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি যা এ দেশে পাওয়া যায় না। বুঝতে বাকি রইলো না এটা চিনু এনেছে। তৃপ্তি করে সকালের নাস্তা শেষ করে, খাবার টেবিলে অতীত নিয়ে শুরু হলো সাতকাহন অতীত ঘটনা। মানুষের কিশোর জীবনটা থাকে নানান রকমের স্মৃতিময়ী আবেগ ভরা প্রতিটি মূহুর্ত। যা অন্য জীবনের সাথে তুলনা করা যায় না। আবার কেউ কেউ মনেও রাখে না। এটা যেন পুতুল খেলার একটা সময়।

কিন্তু সাগর-চিনু কিশোর কালটা একটা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছিলো তা সহজে ভুলার নয়। হয়ত এটা কারো কাছে নিছক পুতুল খেলার মতোই। আসলে তা নয়। কোন এক সময় পুতুল খেলার ছলে দুজনের মনের ভেতরে একটা আত্মীক সম্পর্ক গড়ে ওঠে আর সেটাই ভালোবাসা এবং তারপর পরিণয়। তবে সবক্ষেত্রে স্বার্থক নাও হতে পারে। কাল-স্থান-পাত্র আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। সাগর-চিনু অবুঝ প্রেম তারই নমুনা।
বিমল একটু আগ বাড়িয়ে বললো,
──সাগর, তোকে একটা বিষয় পরিস্কার করা প্রয়োজন। চিনু হলো তোর বৌদির আপন মামাতো ভাই সুকান্ত ঘোষের বিবাহিতা স্ত্রী। একজন রসিক এবং মুক্ত মনের মানুষ। বয়সে আমাদের চেয়ে কিছুটা বড়ো হবেন। তোর কথা শুনেছেন প্রদীপের কাছে। একই অফিসে কর্মরত ছিলেন। এখন নাটক পাগল।
──তাই বলো। তা না হলে বলে থেমে গেলো সাগর। চিনু বেশ জোর দিয়ে বললো,
──এই “তা না হলে” কি?
──তেমন কিছু না। কিশোরীকে কিশোর প্রেমিকের সাথে সাক্ষাৎ? এই আর কি।
──ও মা, সাগর তো বেশ কথা শিখেছে বিমলদা।

আরও পড়ুন গল্প নীরুর মা

এটা ঠিক, বিয়ের আগে আমাদের বাড়িতে আসতেন। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। দাদাকে বিয়ে দিতে হবে। আমাকে রেখে তো আর দাদা বিয়ে করতে পারে না। বাংলাদেশের অনেক গল্প শুনতেন দাদার কাছে। দাদার প্রিয় বন্ধু কে কে, তাদের গল্প শুনেছেন। মার মুখে সাগরদার প্রশংসার গল্প শুনেছেন। তবে মা একটা বিষয় চেপে গিয়েছিলো, সেটা হলো সাগরের সাথে পুতুল খেলা। তবে তিনি চালাক এবং বুদ্ধিমান মানুষ। বিয়ের পর বলতেন কিশোর বয়সে প্রেম হতে পারে, তবে সেটা একেবারে অনন্য নিখুঁত খাঁটি প্রেম, ভেজালবিহীন তবে বালিরবাঁধ। মনে থাকবে সারাজীবন। কি ভেবে তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন দেখে এসো কিশোর প্রেমিককে আর সাথে শ্বশুরের পৈতৃক ভিটেমাটি। আমিও সুযোগ লুফে নিলাম। জীবনের শেষ সময় যদি দেখা পেয়ে যাই তার সাথে। দেখা পেয়ে গেলাম।

এক সময় থেমে যায় চিনু। দুপুর হয়ে গেছে। একটা অটোরিকশা এসে থামলো বিমলদার বাড়ির আঙিনায়। চিনু ব্যস্ত হয়ে উঠলো। আজকেই নতুন করে হয়ত শেষবারের মতো নিজ জন্মস্থান ত্যাগ করতে হবে। আর রেখে যাবে কিশোরকালের সেই বোকা বোকা মিষ্টি চেহারার সবচেয়ে প্রিয় বালকটিকে। কেন যেন সাগরকে বালক ভাবতে ভাল লাগছে চিনুর।

না, আগের মতো আবেগ নেই। আছে শুধু কিছু হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। সাগর তো আর সেই সাগর নেই। দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। ক্ষণিকের জন্য দেখা হলো, এখানেই ভালোবাসার স্বার্থকতা। অনুভূতি ভালোবাসাকে জাগিয়ে রাখে। চিনু রানী ঘোষ এটাই চেয়েছিলো বলেই সাগরের সাথে দেখা হলো, কথা হলো। কারণ সে কিছু হারায়নি। তার হারানোর কোন ভয় নেই। ভালোবাসার একরাশ আনন্দ আর বেদনা নিয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজগৃহে। সঙ্গে কিছু নেই। সাথে এনেছিলো সাগরের প্রিয় গাঁদা ফুল আর মিষ্টি। ধীরে ধীরে অটোরিক্সার কাছে দাঁড়ায় চিনু। পাশে এসে দাঁড়ায় সাগর। দু’জন চোখ মেলে তাকায় দু’জনের দিকে। চিনুর আঁখি দুটো ভরা এক সাগর জল। জলে ভাসছে সেই ফেলে আসা কিশোর-কিশোরীর অনুভূতির প্রেম।

আরও পড়ুন ভৌতিক গল্প অশরীরী আত্মা

সাগরের চোখে ভেসে উঠে পাক-ভারত যুদ্ধে ভেঙে যাওয়া কত পরিবার নিরাপত্তাজনিত কারনে নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছিল। দিনটা ছিলো দূর্গাপূজা। ক্ষণিকের জন্য চিনু এসে দাঁড়িয়েছিল সাগরের সম্মুখে। আঁখিভরা ছিলো জল। মূহুর্তে জড়িয়ে ধরেছিল সাগরকে। কিন্তু আজ দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। চোখের পানি আর হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে ভালবাসার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বিদায় নিলো। হয়ত এই দেখাই শেষ দেখা। অটোরিক্সা একটা বিকট শব্দ করে বিমল দাসের বাড়ির আঙিনা ত্যাগ করলো।

সাগর বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলো। শীতের দুপুর রোদের তাপ আজ যেন বেশ মিয়্রমান।

সাগর হাঁটছে আর ভাবছে ধর্মের দোহাই দিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান আর ভারত নামে দুটো দেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু মানুষের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল তা কেউ হিসেব রাখেনি। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পর কত প্রেম ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। চোখের জল ফেলে প্রেমিকা চলে যেতে হয়েছিল নতুন অচেনা জায়গায়। শুধু কি তাই? ঘর বাঁধতে হয়েছিল অন্য অপরিচিত পুরুষের সাথে।

এমনই এক উপন্যাসের নায়িকা ইন্দু বালা বরিশালের মেয়ে। ভালোবাসার মানুষ জয়নালকে রেখে চলে যেতে হয়েছিলো ভারতের নতুন রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কোন এক জেলার বাসিন্দা একজন বয়স্ক স্কুল শিক্ষকের হাত ধরে। কপালে লাল সিঁধুর, পরনে নতুন লাল বেনারসী শাড়ি। দরিদ্র বাবা-মার বিবাহ উপযুক্ত মেয়ে এ ছাড়া তো আর কোন পথ ছিলো না। ইতোমধ্যে জয়নালের সাথে সম্পর্ক রটে গেছে। ঘটনার সাথে ঘটনার কি মিল। আবার তারই পুনরাবৃত্তি ঘটলো ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে। ভারতবর্ষ ভাঙ্গন আর ঠিক আঠারো বছর পর দেশ দুটোর শাসকদের নিদারুণ অহংকার আর ধর্মের গোঁমারীর অজুহাতে যুদ্ধে আবার ভাঙ্গলো অগণিত মানুষের ভাগ্য। আপন জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হলো। সাগর ইতিহাস পড়ে জেনেছিলো সাত চল্লিশের দেশ ভাগের কথা। নিজ চোখে দেখেছিলো প্রমত্ত পদ্মা নদী আর গাজনার বিল দুয়ের মাঝখানে বসতি।

অনেক মানুষের মধ্যে দুজন কিশোর-কিশোরীর অবুঝ প্রেম, দূর্গাপূজার সাথে বিসর্জন হয়েছিলো।

আরও পড়ুন একজন কিশোরীর মন-
১ম পর্ব
২য় পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

একজন কিশোরীর প্রেম (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল একজন কবি ও কথাসাহিত্যিক। তিনি নিয়মিত 'আমাদের সুজানগর' ওয়েব ম্যাগাজিনে লেখালেখি করেন। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে, এক কিশোরীর প্রেম, ভোরের কৃষ্ণকলি; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা; কবিতাগ্রন্থ: জোছনায় রেখে যায় আলো। তিনি ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের বোনকোলা গ্রামে তাঁর নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস একই উপজেলার হাটখালি ইউনিয়নের নুরুদ্দিনপুর গ্রামে।

error: Content is protected !!