আলতাব হোসেন,  গল্প,  সাহিত্য

অভিমান ।। ১ম পর্ব ।। ছোটোগল্প ।। আলতাব হোসেন

অভিমান ।। ১ম পর্ব 

আলতাব হোসেন 

রোজ সকালে উঠেই মা রুটি বানিয়ে দেন, সঙ্গে ডিমভাজি। ছোটোবেলা থেকে এই অভ্যেস। এখন আমি চব্বিশের তরুণ, তবুও সকালে ঘুম ভাঙে মায়ের রুটি-গন্ধে। মনে হয়, ঘড়িটা থেমে থাকুক, আমি যেন আজও সেই স্কুলপড়ুয়া ছেলেটাই থাকি। কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না।
আমাদের বাড়িটা পাবনার সুজানগর উপজেলার এক প্রান্তে। চারপাশে মাঠঘেরা, শীতে ধোঁয়াটে কুয়াশা, আর বরষায় কাঁদামাখা কাঁচা রাস্তা।
বাবা মারা গেছেন চার বছর আগে। হঠাৎ এক বিকেলে হার্ট অ্যাটাক, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই সব শেষ। বাবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আমরা চার ভাইবো— আমি সবার বড়ো, তারপর ছোটো দুই বোন।
বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন মা। গয়নার বাক্স থেকে একে একে সোনার চুড়ি, কানের দুল, নাকফুল বিক্রি করে আমাদের চালিয়ে নেন। সেই সময়টায় আমি অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ি। টিউশনি করি, মাসে দেড় হাজার টাকা পাই। তাতে নিজের চলে, কিন্তু পরিবার চলে না।
আমাদের একটাই ঘর, এই ঘরটায় এখন আমি, মা আর ছোটো বোন রিতু থাকি।
বড়ো বোন শবনমের বিয়ে হয়ে গেছে সাঁথিয়ায়, একটা গৃহস্থ পরিবারে। সুখে আছে—অন্তত তাই মনে হয়। ফোনে সবসময় হাসিখুশি কথা বলে। অবশ্য কষ্টের শব্দ মুছে ফেলে দেওয়ার অভ্যাস আছে আমাদের।

আরও পড়ুন লালু

মা প্রায়ই বলেন—
“তুই যদি একটা চাকরি করতিস, রিতুর বিয়েটা দিতে পারতাম আগেভাগেই। মেয়ের বয়স বাড়লে কিন্তু কথা ওঠে। মানুষের মুখ বন্ধ করা যায় না রে বাবা।”
আমি মাথা নিচু করে থাকি। কিছু বলি না। আমার তো ইচ্ছা ছিল সাংবাদিক হব। শহরের পত্রিকায় লিখতাম মাঝেমাঝে। কবিতা, গল্প, কলাম। পাবনা শহরে থাকতে চাইতাম, কিন্তু সংসারের চাপে গ্রামেই টিউশনি করি।
একদিন মা সন্ধ্যায় বললেন,
“তোর আজাদ চাচা এসেছিল আজ। বলল, তার ছেলে ঢাকায় একটা ওয়াশিং কারখানায় কাজ করে; তোর জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। হেল্পার হিসেবে শুরু করবি, পরে কী না কী হয় বলা যায় না।”
আমি চুপ করে থাকি। মা বুঝতে পারেন, আমি এই কাজ করতে চাই না।
তাই গলায় একটু কষ্ট ঝরে—
“সবাই যা করে, তুই তা করতে চাস না। তোর স্বপ্ন আছে, জানি। কিন্তু রিতুর ভবিষ্যত? আমার এই বয়সে তো আর কারো বাড়ি বাসন মাজতে যেতে পারি না।”
মা চোখে পানি চেপে বলেন এসব। আমি শুধু শুনি। বুকের ভিতরে কী যেন দলা পাকায়।

আরও পড়ুন একটি মিষ্টি স্বপ্ন

তিন দিন পর ঢাকায় চলে যাই। সাভারে একটা ওয়াশিং কারখানায় কাজে ঢুকি। শিফটিং বারো ঘণ্টা ডিউটি; সাত দিন ডে আর সাত দিন নাইট। সময় নেই গল্প লেখার, শুধু মাথা নিচু করে ওয়াশিং অপারেটরকে সাহায্য করি। সহকর্মীরা কেউ সিলেটের, কেউ বরিশালের, তাদেরও কাহিনি আলাদা আলাদা।
একদিন বিকেলে বাসা থেকে ফোন আসে। রিতু বলল,
“ভাইয়া, মা সারাদিন চুপচাপ থাকে। অনেক দিন হলো হাসেনি। তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, কিন্তু কিছু বলে না।”
আমি চুপ করে থাকি। সে রাতে ঘুম আসেনি। পরদিন অফিস শেষে রুমে বসে কাঁদলাম চুপিচুপি। প্রথমবার, কাজের কষ্টে না, কাঁদলাম মায়ের জন্য।

দুই মাস পর এক শুক্রবার ছুটিতে বাড়ি ফিরলাম। মা বারান্দায় বসে ছিলেন সেলাই মেশিনে, চোখে চশমা। আমাকে দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন। যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তারপর ধীরে উঠে এসে জড়িয়ে ধরলেন।
“তুই তো শুকিয়ে গেছিস রে বাবা। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস না? অনেক কষ্ট হয় বুঝি?”
আমি কোনো উত্তর দিই না। শুধু মায়ের গায়ের ঘ্রাণ নিই— পেঁয়াজখেতের, বৃষ্টি-পড়া মাটির, আর একটু চোখের জলের ঘ্রাণ।
সেই সন্ধ্যায় মা বললেন,
“তোর জন্য একটা মেয়ে দেখেছি।”
আমি চমকে উঠি।
“মা, আমি এখনো তৈরি না। তোমার মুখে হাসি দেখার জন্য কিছুই করতে পারছি না, আবার বিয়ে…?”
“তুই তৈরি না বলেই তো এত বছর কাটিয়ে দিলি। রিতুরও বয়স হয়ে যাচ্ছে। তুই সংসার না করলে ওরও বিয়ে দিতে পারছি না। আমি একা হয়ে যাব রে।”
মা ঠিকই বলেছে।

আরও পড়ুন আড়ালের চোখ

মেয়ের নাম তাহিরা। পাশের গ্রাম কামালপুরে বাড়ি। শান্ত, ঘরোয়া, বিএ পড়ছে। ছবি দেখলাম। চোখ দুটো যেন পানির মতো স্বচ্ছ। মাকে বললাম,
“তুমি যেমন চাও, মা।”
মা চোখে জল নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
বিয়ের তারিখ ঠিক হলো পৌষের শেষ সপ্তাহে। আমি আবার ঢাকায় ফিরলাম। প্রতিদিন ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা হয়। তাহিরা নিজের হাতে আমার জন্য একটা পাঞ্জাবি সেলাই করেছে; শুনে বুকটা আনন্দে ভরে উঠল।
শীতের হাওয়া যখন গা ছমছম করে, আমি তখন বিয়ে করলাম। গাঁয়ের মেয়ে, মাঠ পেরিয়ে পেঁয়াজ-গন্ধে বড়ো হওয়া একটা মানুষ আমার জীবনে এল। তাহিরা হাসে খুব কম, কিন্তু হাসলে যেন সূর্য গলে পড়ে মুখে। আমার ছোটো ঘরটায় সে আলোর রেখা এনে দিল।

তিন মাস কেটে গেছে বিয়ের। একটা দিনও মা আর তাহিরার মধ্যে বড়ো কিছু হয়নি। কিন্তু ছোটো ছোটো কথার খুঁতখুঁতানি শুরু হয়েছে।
এক সন্ধ্যায় মা বললেন,
“তোর বউ আমাকে কোনো কাজে হাত দিতে দেয় না।”
“মা, তোমার তো বয়স হয়েছে। ও চায় তুমি বিশ্রাম করো।”
“তা তো বুঝি। কিন্তু মেয়েটার চোখে শ্রদ্ধা দেখি না। তোকে নিজের করে রাখতে চায় শুধু।”
তাহিরা এসব কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। তার চুপ থাকাই যেন অনেক কিছু বলে দেয়।
একদিন আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই দেখি মা ঘরে নেই। পাশের বাড়িতে গেছেন। তাহিরা তখন বসে কাপড় ভাঁজ করছিল। জিজ্ঞেস করতেই বলল,
“আমি কিছু বলি না। মা যেন নিজে থেকেই একটু একটু দূরে সরে যাচ্ছেন। আমি চেষ্টা করছি আপন করে নিতে।”
আমি মাথা নিচু করে বলি,
“আমি জানি, তুমি খারাপ নও।”

আরও পড়ুন বড় বাবা

সেই রাতে ঘুম এল না। দুই প্রিয় মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি— একজন জন্মদাত্রী, যিনি জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আমাকে বড়ো করেছেন; আর একজন জীবনসঙ্গী, যার হাত ধরে আমি ঘর বেঁধেছি।
মাঝরাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মাথার উপর পূর্ণিমার চাঁদ। ভেজা বাতাসে কেমন যেন বিষণ্নতা। বুকের ভিতরে একটানা পাথরের মতো ভার অনুভব করি। আমি কি মায়ের প্রতি অবিচার করছি? না-কি তাহিরার প্রতি?
“সবচেয়ে কঠিন অভিমান হয় তখনই, যখন সেটা প্রকাশ পায় না— শুধু নিঃশব্দে ভেতরটায় জমে জমে পাথর হয়ে ওঠে।”
পরদিন সকালে মা বললেন,
“তুই তো আর এখন বাড়ি থাকিস না। এখন তোর বউ, তোর কাজ, তোর ব্যস্ততা— তোর মা কোথায় তোর জীবনে?”
আমি শুধু বলি,
“মা, তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। কিন্তু জীবনটাআ তো শুধু একদিকে গড়ায় না। আমি দুজনকেই চাই।”
মা চোখ মুছে ঘরে চলে যান। তাহিরা রান্নাঘরে কিছু একটা রান্না করছে, আর আমি বারান্দায় বসে পাথরের মতো ভার বুক নিয়ে চুপচাপ আছি।

আরও পড়ুন ‘অভিমান’  গল্পের-
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

অভিমান ।। ১ম পর্ব

Facebook Comments Box

আলতাব হোসেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। তিনি ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!