স্বপ্ন গোধূলি (শেষ পর্ব)
স্বপ্ন গোধূলি (শেষ পর্ব)
পাঁচ.
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে মাস ছয়েক হলো মিস অরুশি চৌধুরী মৃত্যুর প্রহর গুণছে। দিন যায়, রাত আসে। একেকটি রাতকে তার কাছে বড় বেশি প্রলম্বিত মনে হয়। রাত কিছুতেই ফুরায় না। যেন থমকে দাঁড়িয়ে থাকে, এগোয়ই না। প্রত্যূষে পুবাকাশ যখন আরক্ত আভা ছড়ায়, ভীষণ ভালো লাগে তার।
কারা কর্তৃপক্ষ অরুশিকে জানিয়েছে, হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছে। অরুশি জানে, উচ্চতর আদালত ফাঁসির আদেশ অনুমোদন করলে অনুমোদনের তারিখ থেকে একুশতম দিন থেকে আটাশতম দিনের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ইতোমধ্যে ষোলোদিন পেরিয়ে গেছে। তার মানে পৃথিবীর আলো বাতাসে তার শ্বাস ফেলার সময় ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। সে আর চার কি পাঁচদিন, বড়জোর এক সপ্তাহ কিংবা সর্বোচ্চ বারোদিন কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বসে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। অরুশি বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়। তার খুব যে কষ্ট হয়, তা নয়। সেই কৈশোরে যখন সে বুঝতে শিখেছে, তখন থেকেই দেখছে দুষ্টগ্রহের অশুভ প্রভাবে নিরন্তর অন্তহীন কষ্ট বলয়ে নিপতিত হয়েছে তার পরিবার এবং সেও। চতুর আলি নামক অশুভ গ্রহটি নিষ্পিষ্ট করেছে তার পরিবারকে। অরিত্র নামক দুষ্টগ্রহের সর্বনাশা ছোবলে সর্বস্ব হারিয়েছে সে। সে নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত। তার বাঁচা মরার কী অর্থ থাকে তবে! অরুশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আরও পড়ুন গল্প লালু
কনডেম সেলে জেল সুপার, কারা চিকিৎসক, জেলার, সুবেদার আর কর্তব্যরত প্রহরী ছাড়া অন্যকারও প্রবেশাধিকার নেই।
কারা চিকিৎসক প্রতিদিন এসে খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করেন, “অরুশি কেমন আছ?”
অরুশি ঝটপট উত্তর দেয়, “জী স্যার, ভালো।”
অতঃপর ভদ্রলোক মুখ নিচু করে বেরিয়ে যান। অরুশিও যেন চায়, ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি চলে যাক। কারণ, তাঁর বিপন্ন মলিন মুখের দিকে তাকালে অরুশির বুকের ভেতর এক ধরনের কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে। অরুশির চোখে চোখ পড়লেই যেন তিনি বিব্রত বোধ করেন।
যেন মনে হয়, অরুশির সামনে আসলেই তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। তবু কর্তব্য পালনে তাঁকে আসতে হয়। জেল সুপার, জেলার এবং সুবেদারও প্রতিদিন দুবেলা এসে অরুশিকে দেখে যান। সবার মুখেই কেমন বিষাদের ছায়া। অরুশির কান্না পায়। দীর্ঘ কারাবাসে সে সবার অগাধ স্নেহ, অপার ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ণ। এর মূল্য কিছু কম নয় অরুশির কাছে। বরং এই কূলাতিক্রান্ত স্নেহ-ভালোবাসা কখনো কখনো তাকে এতই উদ্বেলিত করে যে, তার বাঁচার সাধ হয় আবার।
কারা চিকিৎসক ডা. রুদ্র শাওন তার চাকরি জীবনে অনেক ফাঁসি দেখেছেন এবং কর্তব্যের খাতিরে তাদের পোস্টমোর্টেমও করতে হয়েছে। তবে খারাপ লাগেনি এমন নয়। প্রতিবারই এই কাজটি করার দিন কেমন এক বিষণ্ণতা তাকে ঘিরে ধরেছে, তবু করতে হয়েছে। কিন্তু এবার বুঝি সে পারবে না। ঐ কচি মেয়েটির নিষ্পাপ মুখ আর মায়াবী চোখের দিকে তাকালে তার মন হু হু করে ওঠে। তার ভীষণ কষ্ট হয়। কী করে মেয়েটির নিথর দেহে ছুরি-কাঁচি চালাবে সে। নাহ্, সে পারবে না।
আরও পড়ুন গল্প পক্ষিরাজের ডানা
অরুশি একটানা দীর্ঘ পাঁচ বছর কুড়ি দিন কারাগারে বন্দি। এই দীর্ঘ নিঃসঙ্গ বন্দী জীবনে তার খুব যে মন খারাপ হয়েছে এমন নয়। সে জানে তার মৃত্যু আসন্ন। স্বেচ্ছায় যেটি সে বরণ করে নিয়েছে, সেটির জন্য কেন তার মন খারাপ হবে! সে প্রসূনদাকে বাঁচাতে চেয়েছে। প্রসূনদা বেঁচে থাকবে, তার কাছে এরচেয়ে বড় পাওয়া তো আর কিছু হতে পারে না! সেই অনন্ত কৈশোর থেকে যে মানুষটি শিশিরের মতো স্বচ্ছ অনুভবে অফুরান ভালোবাসায় দূর থেকে তাকে আগলে রেখেছিল, তাকে সে উপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। সেই মানুষটিই তার অতি বিপদের দিন ত্রাতারূপে নির্ভীকের মতো পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। অরুশির জন্য যে মানুষটির বুকে অথই জলরাশির মতো আকুল প্রেমের দিগন্তপ্রসারী ব্যাপ্তি, তার জন্য যে আত্মবিসর্জনেও শান্তি। সেই বালকবেলা থেকে প্রসূনদা সতত আত্মাবমাননা সয়েও ক্রমাগত ভালোবেসে গেছে অরুশিকে। কোনোদিন মুখ ফুটে কিছু বলেনি। সেই মানুষটির জন্য আজ হঠাৎই অরুশির মন খারাপ হয়ে যায়। অরুশি
অরুশি জানে, প্রসুনদা পাগলের মতো দুয়ারে দুয়ারে ছুটছে তার অরুশিকে বাঁচাতে। ভিখিরির মতো হাত পেতে করুণা ভিক্ষা চাইছে। পথে পথে বিলাপ করে ফিরছে। কিন্তু তার ভিক্ষাভাও যে শূন্যই থেকে যাবে, অরুশি জানে। সে এও জানে, প্রসূনদা তার যৎসামান্য যা কিছু ছিল, সমস্তই বিক্রি করে অরুশির জন্য বড় উকিল নিয়োগ করেছে। সে আজ একেবারে নিঃস্ব, পথের ভিখিরি। এত করেও সে তার অরুশিকে বাঁচাতে পারল না। প্রসূনদাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করে তার। অরুশির বুকের ভেতর গহিন বেদনার আকুল করা তীব্র জল তোলপাড়। কলজে মোচড়ানো হু হু কান্নায় ভেসে যেতে ইচ্ছে করে তার। কী এক দুর্মর স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষায় আরও কটি দিন বাঁচার সাধ হয়।
আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি
সূর্য ডুবে যাচ্ছে। আরও একটি দিনের মৃত্যু ঘটছে। এবং তার মৃত্যুও যেন দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছে। কনডেম সেলের নির্জন কক্ষ দিন শেষের ম্রিয়মাণ ধূসর আলোর বিলাপে মুহ্যমান। বিমূঢ় অরুশি বিষণ্ণ সন্ধ্যার মলিন বাতাসে কান পেতে শোনে প্রসূনদার বুকভরা হাহাকার আর আর্তনাদের শব্দ আর স্বীয় শূন্যতার রোদন। সে চিৎকার করে বলে, “প্রসূনদা, তোমার জন্য আবার আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে। তোমার হাত ধরে শিশিরস্নাত গাঁয়ের মেঠোপথে হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর চলে যেতে ইচ্ছে করে। অথৈই অকূল প্রেমের আকুল করা স্রোতে ভাসতে ইচ্ছে করে আমার। কিন্তু তা তো হবার নয়! প্রসূনদা, তুমি নিশ্চিত জেনো, যদি আবার ফিরে আসি পৃথিবীর বুকে, আমি তোমার পাশেই দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায় তোমারই হাত ধরব।” অরুশির চোখ ভিজে ওঠে। দীর্ঘ বন্দী জীবনে এই প্রথম সে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আজ একুশতম দিন। দীর্ঘ পাঁচ বছর একুশ দিনের মধ্যে আজই প্রথম অরুশি সকলের মধ্যে এক ধরনের চাঞ্চল্য লক্ষ্য করে। তবে কি আজই…? প্রসূনদার সাথে দেখা হলো না আর! ভীষণ ইচ্ছে ছিল শেষ একবার তাকে দেখার। হলো না!
মিস অরুশি চৌধুরীকে ডেপুটি জেলারের রুমে এনে বসানো হলো। অরুশি কিছুই বুঝতে পারছে না। সে স্থির বসে আছে। জেল সুপার অরুশির পাশে একটি চেয়ারে বসলেন। তাঁর হাতে একটি অর্ডারের কপি। অরুশি সহসা পাথর হয়ে গেল। বুকের পাঁজর ভেঙে হৃৎপিণ্ড বুঝি ছিটকে পড়বে। সে জানে, তাকে কী শোনানো হবে। আজই তবে…! সে মনে মনে বলে, “প্রসূনদা আমায় ক্ষমা করো। জানি ভালো থাকবে না, তবুও বলবো, ভালো থেকো।”
আরও পড়ুন গল্প নীলভোর
জেল সুপার অর্ডারটি পড়া শুরু করলেন-“মানবিক বিবেচনায় মিস অরুশি চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ মকুব করে তার মুক্তির নির্দেশ দেয়া হলো।”— মহামান্য রাষ্ট্রপতি ।
মুহূর্তে গোটা জেলে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ল। পরমানন্দের একটি উত্তাল ঢেউ যেন সহসা আছড়ে পড়ল কারা এলাকায়। সকলের মুখেই আনন্দ-সুখের অমলিন হাসি ।
নিজের অজান্তেই অরুশির বুকের গহীনে আটকে থাকা ভারী শ্বাস বেরিয়ে এল। সে তার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার চোখের কোণে অশ্রুর ফোঁটা। সে নির্বাক বসে আছে। এও কি সম্ভব!
জেল সুপার বলেন, “এটি সম্ভব হয়েছে প্রসূন আহমেদ নামে এক তরুণ যুবকের ক্লান্তিহীন ছুটোছুটি আর ব্যারিস্টার এম আলির আন্তরিক প্রচেষ্টায়।”
মিস অরুশি চৌধুরী কারাফটকের লৌহদ্বার দিয়ে বাইরে বেরিয়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়। আহ্! কি শান্তি। সে সম্মুখপানে তাকায়। প্রসূনদা কাতর দুটি চোখে তারই দিকে চেয়ে আছে। তার চোখে জল । অরুশির ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে প্রসূনদার বুকে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু অসংখ্য দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ। সে দৃঢ় পায়ে হেঁটে গিয়ে নিঃসঙ্কোচে প্রসূনদার হাত ধরে। কার্তিকের নরম বিকেলে নিবিষ্ট মায়াবী দুটি ভেজা চোখ মেলে প্রসূনদার দিকে তাকিয়ে বলে, “চলো।” ওদের দুজোড়া চোখে আগামীর অফুরন্ত স্বপ্নের অবিমিশ্র অনন্ত ঝিলিক। হেমন্তের প্রচ্ছায়ায় ওরা সম্মুখে পা বাড়ায়।
আরও পড়ুন স্বপ্ন গোধূলি-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
স্বপ্ন গোধূলি (২য় পর্ব)