সোনালী (১ম পর্ব)
সোনালী (১ম পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
সকালের নাস্তা শেষ করে ভাবছি কি করা যায়। আজকের কাগজে সে রকম কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর বা প্রবন্ধ ছাপা হয়নি যে তা পড়ে সকালটা কাটানো যায়। হঠাৎ মনে পরে গেল গত ঈদে দুটো ফুলপ্যান্ট বকশিস পেয়েছিলাম। কিন্তু তা ব্যবহার করার সুযোগ হয়ে উঠে নি। দুটো কারণে তা ব্যবহার করার সুযোগ হয়নি। প্রথম প্রধান কারণ কোভিড-১৯ আর অন্য কারণ প্যান্ট দুটো লম্বা। এখন অতটা কড়াকড়ি নেই। বাইরে সবাই যাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকজন আর ঘরের চার দেয়ালে বসে নেই। বাধা বয়স্ক লোকজনকে নিয়ে। তবে সকাল-বিকালে হাঁটাহাঁটিতে নিষেধ নেই। শরীরটাকে সতেজ রাখতে হবে এবং বিনা টাকায় সূর্য হতে প্রাপ্ত ভিটামিন-ডি গ্রহণ করতে হবে। ভাবছি প্যান্ট দুটো একটু সাইজ করা যায় কিনা। গিন্নীর অনুমতিসাপেক্ষে শপিং ব্যাগে প্যান্ট দুটো ভরে বাসা থেকে বের হলাম।
সেক্টরের ভেতরে বেশ ক’টি বুনিয়াদী দর্জির দোকান আছে, তাদের দিয়ে কাজটা করানো যায় কিনা। বাসা হতে বেড় হয়ে কিছু দূর যেতেই দেখা হলো প্রাত্যহিক হাঁটার সহপাঠি মালেক সাহেবের সাথে। এককালে কলেজে ইসলামিক ইতিহাস পড়াতেন। এখন অবসরে। থাকেন ছেলেদের ঘাড়ে। সুযোগ পেলেই বুনিয়াদী গল্প-স্বল্প করেন। দেখা হতেই বললেন,
-তাড়াহুড়া করে কোথায় যাচ্ছেন?
কোন জবাব না দিয়ে শপিং ব্যাগে রাখা জিনিস দুটো দেখালাম। তিনি একগাল হাসি দিয়ে বললেন,
-সেক্টরের ভেতরে বুনিয়াদী দর্জিগণ আপনার নিম্ন মানের কাজ করবে বলে মনে হয় না।
কথাটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মালেক সাহেব পরামর্শ দিলেন, সেক্টরের বাইরে বেশ ক’টা দর্জির দোকান আসে সেখানে যেতে পারেন। তার কথার মানে হলো রেল লাইন ধার ঘেঁষে অনেক মার্কেট আছে সেখানে যেতে হবে। পরামর্শটা মনঃপূত হলো।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
বাজারটা আমারও চেনা। মাঝে মধ্যে যাওয়া হয় পুরানো বই কেনার জন্য। অভিজাত শ্রেণির গৃহিনীগণ বছরে একবার আসবাবপত্র এদিক- সেদিক করেন, তখন বাতিল মালামাল নিলামে বিক্রি করে দেন। তার সঙ্গে অনেক দামী বই বাতিল তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। আর সেগুলো শ্রীহীন দোকানে স্বল্প মূল্যে বই পড়ুয়া পাঠক কিনে নিয়ে ব্যক্তিগত গ্রন্থগারে সযত্নে সাজিয়ে রাখেন। চেনা মার্কেট। বিশ মিনিটের মত লাগবে। সকাল দশটা বাজে। নিস্তেজ সূর্যের আলো। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না। যথাসময় পৌঁছে গেলাম। আজ মনটা বেশ উৎফুল্ল। নতুন দুটো প্যান্ট পরিধানের উপযুক্ত করতে পারলে আগামীতে কোন অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা যাবে। ঘাতক কোভিড-১৯ একদিন দুর্বল হয়ে পড়বে আর মানুষের নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে। বাঙালী তো সব ব্যাপারে ড্যামকেয়ার। চিরচেনা সেই বইয়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দোকানদার ছেলেটি সালাম দিয়ে বললো,
-স্যার, ভেতরে আসুন ক’খানা ভাল বই আছে।
ও জানে কি ধরনের বই আমার পছন্দ। আমার অভিপ্রায়ের কথা বলতেই দর্জির দোকানের অবস্থান সুন্দরভাবে বর্ণনা করলো। তাতে চেনার কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
যা হোক হাঁটতে হাঁটতে দর্জি দোকানের কাছাকাছি যেতেই চোখে পড়লো একটা দর্জির দোকান। দোকানটা খোলা এবং দুটো সেলাই মেশিন। কিন্তু ভেতরে কোন লোক নেই। বলতে গেলে অগোছালো। সামনে দু-তিন জন লোক, বসার মত পুরাতন একখানা ব্রেঞ্চ। একজন মহিলা বসে আছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রইলাম। হয়ত দর্জি সাহেব কোথাও কোন কাজে গেছে। এখনই এসে পড়বে। মহিলার দিকে নজর পড়লো। বয়স অনুমান করা কঠিন। ইদানিং শহরের মহিলাগণ শাড়ী পরিধান করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। থ্রীপিচ সবার কাছে প্রিয়। তাই থ্রীপিচ পরিহিতা মহিলার বয়স ঠাওর করা সম্ভবপর হচ্ছে না। মার্জিত চেহারা। বাংলাদেশের মানুষ সন্ধ্যার পর টিভি পর্দায় বিদেশী সিরিয়ালে যে সব নায়িকাদের দেখে থাকে তাদের চেহারার চেয়ে কোন অংশেই কম বলা যাবে না। মনে খটকা লাগলো এ রকম সুন্দরী মহিলা এখানে কেন? সে তো কোন দামী দর্জির দোকানে যেতে পারতো। হয়ত আমার মতই জোড়াতালি দেয়ার কোন কাজ করানোর অপেক্ষা করছে। অনেকে আবার একটু সস্তায় কাজ করাতে আগ্রহী।
আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা
একটা বিষয় চোখে পড়লো, মহিলা ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে দোকানের দিকে তাকিয়ে আছে। অগোছালো পরিবেশে দোকানটা হা করে তাকিয়ে আছে। ভাবলাম এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা আমার মত লোকের শোভন হবে না। এছাড়া মহিলা ভাববে তার দিকে তাকিয়ে তার রূপ-রস- যৌবন সুধা পান করছে। দোকানের আশে-পাশে আর দুই-তিনটা দোকান আছে সে গুলো বন্ধ। সময় কাটানোর জন্য আবার সেই বইয়ের দোকানে গিয়ে মূল্যবান বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলাম। আসলেই একখানা পড়ার মত বই পেয়ে গেলাম। টাকা পরিশোধ করে পুনরায় দর্জির দোকানের কাছে আসতেই দেখি সেই মহিলা ভাবলেশহীন অবস্থায় বসে আছে। মনে সন্দেহ হলো নিশ্চয় এই মহিলাকে বসিয়ে রেখে দর্জি সাহেব মহিলার চাহিদা মত কোন কাপড় কিনতে অন্য কাপড়ের দোকানে গেছে। বরং ঘুরাফেরা না করে মহিলার কাছে দর্জির খবরটা নিশ্চিত করে নেই। কারণ উভয়ই দর্জির কাস্টমার। দ্বিধা না করে মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল,
-স্যার, কোন কাজ আছে কি?
মনে সংকোচ নিয়ে বললাম,
-না, মানে আমি দর্জিকে খোঁজ করছি।
স্যার, আমি এ দোকানের মালিক।
-আপনার কি কাজ করতে হবে, বলুন।
এমন একজন মার্জিত ও সুশ্রী মহিলার কথা শুনে মনে হলো সে আমার সাথে তামাসা করছে। ইতোমধ্যে মহিলা দোকানের ভেতরে গিয়ে সেলাই মেশিনের সামনে রাখা ছোট প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে, অগোছালো কাপড়গুলো গোছগাছ করে, বিনীতভাবে আমার দিকে তাকালো। এরপর আমার কোন প্রশ্ন করা ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না। শপিং ব্যাগ হতে দুটো প্যান্ট তার হাতে দিয়ে বললাম দেড়ইঞ্চি ছোট করতে হবে। প্যান্ট দুটো হাতে নিয়ে মনোযোগ সহকারে আধা ঘন্টার মধ্যে কাজ শেষ করে দেখতে দিলো ঠিক আছে কিনা। সম্মতি জানালাম। মহিলা প্যান্ট দুটো ভাঁজ করে শপিং ব্যাগে দিয়ে আমার হাতে দিল।
আরও পড়ুন গল্প কথোপকথন
অনেক সময় ধরে ভাবছি কাজের আগে তো দরদাম মিটমাট করা হয়নি। যদি একশত টাকার বেশি চায় তাই দিতে হবে। বাজারের ভেতরে তো মহিলার সাথে তর্ক করা ঠিক হবে না। সেটা মানাবেও না। পকেট হতে একশত টাকার একটা নোট মহিলার হাতে দিলাম। টাকাটা হাতে নিয়ে তার মেশিনের ড্রয়ার খুলে টাকা রেখে একটা বিশ টাকার নোট আমার দিকে ধরলো। মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন, টাকাটা নেব কি নেব না। যদি না নেই তাহলে উল্টো কোন বেখাপ্পা কথা বলে ফেলে। মহিলা আন্দাজ করতে পেরেছে যে আমি দ্বিধাদ্ধন্ধে ভুগছি। হেসে বললো,
-প্রতিটি প্যান্টের জন্য চল্লিশ টাকা করে নিয়েছি। মোট আশি টাকা। বাকী বিশ টাকা আপনার।
কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। যাকে দেখছি তার কিন্তু পরিচয় জানার সাহস আমার নেই। ভাববে সুন্দরী বলে ভাব করার ইচ্ছে। পুরুষ মানুষ সম্পর্কে মহিলাদের এ রকম ধারণা আছে আমাদের সমাজে। এতটা সময় বসে ছিলাম। উঠবো উঠবো ভাবছি। এমন সময় আবেগ কন্ঠে বললো,
-স্যার, আপনার কিছুটা সময় হবে?
-কেন?
মহিলা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
আপনি যখন প্রথমে এ দিকে এসে কিছু সময় ধরে দোকান এবং আমার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন এই মহিলা কে?
-ঠিকই বলেছেন।
এ রকম অনেক কাস্টমার দ্বিধায় পরেছেন। আপনাকে কেন যেন প্রথমে বলতে পারি নি, আমি এই দোকানের মালিক। দর্জি আমার পেশা।
-কেন পরিচয় দিতে পারেন নি?
-আপনি যদি অবিশ্বাস করেন।
-কিন্তু তাতে তো আপনার লোকসান। কাস্টমার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
-তা তো অনেক হয়েছে। বরং অনেকেই বলেছে ইয়ার্কি করার জায়গা পাওনা। আবার কেউ কেউ অশ্লীলভাষায় গালিও দিয়েছে।
মহিলার কন্ঠ জুড়ে ছিল বেদনার বহিঃপ্রকাশ। শুধু তাই নয় সমাজের ওপর প্রচন্ড ঘৃণাবোধ। তবে কি সে আমাকে কিছু বলতে চায়।
-আপনি যেমন আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছিলেন না সংকোচবোধে। সেই সংকোচবোধ আমার মনের ভেতরেও কাজ করছিল।
-ঠিক ধরেছেন। কাজটা আমার জরুরী বলেই আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম।
আরও পড়ুন গল্প স্বর্ণলতা
মহিলা বেশ কিছু সময় নীরব থেকে আমার চোখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে মনে হলো জীবনে এমন কোন ঘটনা আছে যা বলতে চায়। ভাবনায় পড়ে গেলাম। হয়ত বলবে বিবাহযোগ্য মেয়ে ঘরে আছে তাকে বিয়ে দিতে হবে। স্বামীর সাথে বনিবনা নেই তাই আলাদা থাকতে হচ্ছে। একটু সাহায্য দরকার। এ রকম অনেক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। এ ধরনের মহিলারা পুরুষ মানুষের মন বুঝতে পারে এবং সাহায্যের আশা করে থাকে। দেখা যাক কি বলতে চায়। তার দিকে তাকিয়ে বললাম।
-বেশ। বলুন, কি আপনার বলার আছে?
বিনীতভাবে এককাপ চা খাওয়ার অনুরোধ করলো। না করার মত মানসিকতা তখন আমার নেই।
আরও পড়ুন সোনালী গল্পের-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সোনালী (১ম পর্ব)