সোনালী-সকাল-শেষ-পর্ব; www.amadersujanagar.com
গল্প,  সাহিত্য

সোনালী সকাল (শেষ পর্ব)

সোনালী সকাল (শেষ পর্ব)

মোহাম্মাদ শাহ্ আলম

 

এদিকে রবি স্যান্ডেল নিয়ে পথে বের হল। কিন্তু যে পথে বসে মুচিরা জুতো মেরামত করেন, সে পথে তাদের গ্রামের অনেকেই আসা যাওয়া করে। দুশ্চিন্তায় রবির মুখটা হঠাৎ নিস্প্রভ হয়ে গেল। কারণ যেখানে সে জুতাগুলো সারাতে নিয়ে যাবে সেখান থেকে তাদের বাড়ি বেশি দূর নয়। এমন কি সে পথে দিনে দশ বার তাদের বাড়ির প্রত্যেককে যেতে আসতে হয়। আজ তার নির্ঘাত ধরা পরতে হবে। তাই সে পথে এসে দ্রুত তার বেশভূষা পরিবর্তন করল। দু’মিনিটের মধ্যে গন্তব্য স্থলে পৌছে গেল রবি। একজন বলল,
_বাবু এদিকে আনুন, খুব ভালো করে সেরে দেব। এটা বলার পর মুচি একদৃষ্টে রবির দিকে চেয়ে থেকে ফিক করে হেসে বলল,
_বাবু আপনার নকল মুচটা বাম পাশে উঠে গেছে যে। এদিকে পিছন থেকে মহিলা কণ্ঠে বলল,
_এখানে দুটো কাঁটা মেরে দিন তো দাদা।
রবি পিছন ফিরে চাইতেই দেখল, মিতা।
মিতাও রবিকে দেখে বলল,
_একি সেঝভাই তুই? চল বাড়ি যাবি। বাবা-মা-আমরা সবাই তোর জন্য খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আজ একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে দৈনিক পত্রিকায়। কিন্তু রবি সে কথার কোন জবাব না দিয়ে ছেঁড়া স্যান্ডেলের ব্যাগটা তুলে নিয়ে দিল ছুট।
পথের মানুষ আর দু’একটা রিকশা ভ্যানকে কৌশলে এড়িয়ে ছুটে চলেছে রবি। আর পিছন থেকে মিতা ছুটে ছুটে বলছে,
_এই দাঁড়া, এই দাঁড়া।

আরও পড়ুন গল্প রোদেলা দুপুর কাঁদে

এদিকে পথের মানুষগুলো ভাবল চোরটা মেয়েটির নিশ্চয়ই কিছু চুরি করে পালাচ্ছে। কিন্তু এটাতো হতে দেওয়া যায় না। তাই সবাই চোরকে ধরার জন্য চোরের পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে। সকলের মুখে একটা মাত্র শব্দ চোর…. চোর…..চোর…..
রবি দিশাহারা হয়ে পাড়ার রাস্তার পাশে ঝোঁপের মধ্যে মাথা এগিয়ে দিল। কিন্তু ভাগ্য আজ তার কোথা থেকে ঘুষ পেয়ে সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচরণ করল কে জানে। ঝোঁপের মধ্যে বড় একটা বল্লার চাকে কষে ঢুঁমেরে দেওয়ায় চাকের বাসিন্দারা কঠিন ভাবে প্রতিবাদ করল। তারা আইন হাতে তুলে নিয়ে বিচারের আগেই শাস্তির বিধান জারি করে দিল। কিন্তু অপরাধীর চোখে, যন্ত্রণার অশ্রু প্রবাহিত হলেও, প্রতিবাদের নিন্মস্তরের ক্ষীণ শব্দও কান্না হয়ে কণ্ঠ থেকে নির্গত হল না। তাই জীবনে বোবার ভূমিকা পালন করা কত বড় মহত্তের বিষয় আজ তা হাড়ে হাড়ে সে উপলদ্ধি করল।

সমাজে সংসারে অনেক বোবাই আছে, নির্বিবাদে অনিয়মের বিষাক্ত হূলের জ্বালা হজম করে মিথ্যার স্বর্গ রচনায় আত্মহুতি দিয়ে কীর্তিমান হওয়ার চেষ্টা করেন। বিদ্রোহের বাণীকে অবহেলায় পরিত্যাগ করন। এতে মানবতা কতটুক তুষ্ট হয় জানি না, তবে অন্যায়কে আমন্ত্রণ করে সংসারে জ্বালা যন্ত্রণাকে প্রতিষ্ঠা করার কারিগরি বিদ্যা অশুভ অত্মার যথেষ্ট সমাদর পুষ্ট হয়েই আছে। এদিকে লোকজন তন্ন তন্ন করে খুজছে চোরটাকে। হতভাগা চোরটা ঝোপের মধ্যে বল্লার হুল ফুটানো থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য একপাশ দিয়ে মারল জোরে ছুট। কিন্তু একেই লক্ষ্মী ছড়া বলে কিনা জানি না। তবে আহম্মক যে বটে বাংলা ভাষায় এর যথেষ্ট জ্যাঠামি অবিদিত মনে হয় কারো নেই। ভাবতে পারেন! আমরার ঢেঁকিটা স্যান্ডেলের বোঁচকাটা তবুও ছাড়েনি। এত কষ্টে, সে হা করে পৃথিবীটা গেলার মত অবস্থায় অক্সিজেন আহরণ করে ছুটে চলেছে।

আরও পড়ুন গল্প পথভোলা এক পথিক

হুট করে কে একজন দেখে ফেলল আর অমনি সবাই তার ইঙ্গিতে ছুটতে লাগল তার পিছু পিছু। মিতা সবার পিছন পিছন চিৎকার করে বলছে,
_আপনারা ভুল করছেন। উনি কোন চোর টোর নন। উনি আমার মেঝ ভাই।
কিন্তু কে শুনছে কার কথা।
ততক্ষণে চোরটা বড় এটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পরেছে।
সেই বাড়ির কর্তা সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক নিয়ে বের হলেন। তিনি রাগে মাতৃভাষাটাকে অবধি ভুলে গিয়ে ইংরেজিতে বললেন,
Where is the thief? রাসকেলটাকে ধর সবাই।
হঠাৎ পাশের হাসনাহেনার ঝোপটা নড়ে উঠল।
বাড়ির কর্তা সবাইকে সজাক করে দিলেন এ যেমন তেমন চোর নয়। এ ধরিবাজ চোর। নইলে হাজার লোকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শেষে কিনা এই হাসনাহেনার ঝোপে? এই লোকেরা! গার সাথে গা লাগিয়ে ঝোপটা ঘিরে দাঁড়াও সবাই। পালিয়ে যেন না যায়।

আরও পড়ুন গল্প পক্ষিরাজের ডানা

এদিকে রবি ওরফে সকাল ‘দৈনিক পত্রিকার’ প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান করে ঘরে ঘরে ঘুরছে।
সোনাই পেপারটা দেখেই অজ্ঞান হয়ে পরেছে। মামা মামিরা সবাই হাহাকার করে ছুটে এল। শুনেছি কলির কথা! কিন্তু বিজ্ঞানের তান্ডব যে এতটা যাচ্ছে তাই হয়, এমনটাতো ভেবে দেখিনি? পেপারটা ছুঁতেই বেচারি সোনাই সংজ্ঞা হারালো? না, এভাবে মানুষ কি করে বাঁচবে? বিজ্ঞানের উন্নতিকে আমরাও সাধুবাদ জানাই। তাই বলে এমনভাবে সংবাদপত্রের পাতায়ও ভাইরাস ছড়িয়ে মানুষ মারা শুরু করল নাকি?
ছোট মামা তরুণ মানুষ। তার কোন ভয় ডর নেই। সে কুচপরোয়া নেহি ভঙ্গিমায় সংবাদপত্রটা ধরতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই বড়মামা বিকট বিশ্রি জোরে দিলেন এক ধমক,
_এই ছোট বেশি গোঁয়ারতুমি দেখিও না। দেখছ না সবার সামনে সোনাই সংবাদপত্র ধরেই অজ্ঞান হয়ে গেল?
কিন্তু ছোট মামা সে কথা কর্ণপাত করল না। সে সংবাদপত্র ধরেই উচ্চস্বরে লাফিয়ে উঠে বলল,
_আরে একি! একি!
বড়মামা বিজ্ঞ এবং যথার্থ পন্ডিত ব্যক্তি। তিনি অল্পেই বুঝে ফেললেন ছোটটার নির্ঘাত একই ভাইরাসে ধরেছে। কিন্তু এখানে লক্ষণটা আলাদা দেখা যাচ্ছে। সোনাইতো নিশ্চুপ হয়ে আছে, আর ছোটটা খুব লাফাচ্ছে দেখছি। কিন্তু আর ভাবার সময় নেই। তিনি কণ্ঠস্বর ছিন্ন-ভিন্ন করে উপস্থিত সকলের কর্ণ বিদীর্ণ করে বললেন,
_এই দেখছ কি চেয়ে চেয়ে? জলদি পানি নিয়ে এসো, ছোটটার মাথায় ঢালো।
কিন্তু এতক্ষণে ছোটমামা সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন,
_আমি সুস্থই আছি। কিন্তু একি! এতো দেখছি আমাদের রবির ছবি।
ততক্ষণে সোনাই হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠে বলল,
_শোন মামা! ও সত্যি সত্যি রবি নয়! ওর নাম সকাল। তোমাদের ভাগ্নি জামাই। আমার বান্ধবী মানে বর্তমান ননদিনী একটু আগেই ফোন করেছিল। একমাস হলো ওর ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না।
অনন্তর সবাই রবির খোঁজে বের হল।
সোনালি বলল,
_আমিও যাব মামা।
বড়মামা বললেন,
_যাবি তো দেরি করছিস কেন?

আরও পড়ুন গল্প কাঠগোলাপ ও প্রেম

আর এদিকে সকাল ঝোপের মধ্যে কেঁদেই চলেছে। সেই কান্না শুনে কোথা থেকে যেন লাল পিঁপড়ে (অনেকে চাড়ালে পিঁপড়ে বলে, অবশ্য ডাকু পিঁপড়ে বলেও তার যথেষ্ট খ্যাতি আছে) এলো সমবেদনা জানাতে ভিন্ন কায়দায় এবং কান্নায় আরো উৎসাহিত করতে সুরসুরি সহ সামান্য জাগরণী মন্ত্রে অভিষিক্ত ইনজেকশনের ন্যয় তাদের প্রচীন পদ্ধতির সূচে অনর্গল বিদ্ধ করতে লাগল। এতে তার কান্নার উৎসাহ অব্যাহত থাকল।
অপরদিকে বাড়ির কর্তা বন্দুক তাক করে বলেই চলেছেন,
_বেটা নচ্ছার ভালোয় ভালোয় বেরিয়ে আয় বলছি। নইলে প্রাণটা নিয়ে আর বেরোতে পারবি না।
ইতিমধ্যেই মিতা হাঁপতে হাঁপতে এসে বলল।
_বাবা তুমি কি করছ? ও চোর নয়, আমাদের সেঝভাই।
একথা শুনে বাড়ির কর্তা হতভম্ভ হয়ে বন্দুকটা নামিয়ে রেখে আহম্মকের মত মেয়ের দিকে একইভাবে চেয়ে রইলেন।
ঠিক এমন সময় সোনালি এবং তার মামা-মামিরা সেখানে উপস্থিত হল। বাড়ির কর্তা অবাক হয়ে বললেন,
_আরে! আপনারা কারা? চিনতে পারছি না তো।
মিতা এগিয়ে এসে বলল,
_বাবা আমাকে ক্ষমা করো। নির্ঘাত নিরুপায় হয়েই বান্ধবীর সাথে সেঝভাই এর বিয়ে দিয়েছি। যা শাস্তি হয় আমাকে দাও, সেঝভাইকে নয়।
সোনালি গুটি গুটি পায় এগিয়ে এসে ঝপাত করে বাড়ির কর্তার কদমবুছি করে বলল,
_বাবা আমাকে আশির্বাদ করুন।
কিছু বলতে যাওয়ার আগেই মিতা বলল,
_বাবা তোমার পুত্রবধু পছন্দ হয়েছে তো?
উত্তরে তিনি মুচকি হেঁসে বললেন,
_তোর পছন্দ আছে বলতে হয়।
এরপর বড়বউ, মেঝবউ, আর নওয়াবউ তাদের এই নতুন জা টিকে বগলচাপা করে ছো মেরে নিয়ে চলে গেল বাড়ির মধ্যে।
অতপর মি. হাওলাদার ছেলেকে ভর্ৎসনা করে বললেন,
_একি চেহারা করেছিস হতভাগা। বুদ্ধি সুদ্ধি আর হলো না তোর, যাও মায়ের কাছে যাও।

আরও পড়ুন গল্প  ওরা তেরোজন

অবশেষে রাত বারোটায় বাসর ঘর সাজানো শেষ হল। সকাল খাটের একপাশে বসে নাকি সুরে কেঁদে অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে চলেছে। নাকের জলে দামী পাঞ্জাবিটার নাজেহাল দশা হয়ে উঠল। শুধু আফসোস! এত কষ্ট করেও সোনাইকে সে পেল না। এদিকে নতুন বধুকে বাড়ির অন্য বউয়েরা তারপাশে বসিয়ে দিয়েই চলে গেল।
সবাই মুখটিপে হাঁসছে। সোনাই দরজাটা দিয়ে খাটের মাঝখানে বসে কিছুক্ষণ নিরবে বসে থাকল।
আর এদিকে আবেগে সোনাই সোনাই করে সকাল ডুকরে কেঁদে উঠল।
সোনাই মুখে আঁচল দিয়ে নিঃশব্দে হাসছে।
এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর তার মনে হল আর কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। তাই সে বলল,
_রবি আমার মাথাটা টিপে দাওতো।
সঙ্গে সঙ্গে সকালের মাথায় যেন পুরো পৃথিবীটাই ভেঙ্গে পড়ল। সে অবাক হয়ে পিছন ফিরে বলল,
_এ কি সোনালি তুমি?

আরও পড়ুন সোনালী সকাল গল্পের-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

সোনালী সকাল (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

‘আমাদের সুজানগর’ সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত একটি অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন। সংগঠনটি সুজানগর উপজেলার কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে নিয়মিত ম্যাগাজিন প্রকাশ, বইমেলা ও সৃজনশীল মেধা বিকাশে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন আয়োজন করে আসছে। এছাড়া গুণিজনদের জীবন ও কর্ম নিয়ে ধারাবাহিক লাইভ অনুষ্ঠান ‘অন্তরের কথা’ আয়োজন করে থাকে। ‘আমাদের সুজানগর’ সংগঠনের মুখপত্র হলো ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিন, যা সুজানগরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, গুণিজনদের জীবন সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রচার করে থাকে। এছাড়া সুজানগর উপজেলার কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি প্রকাশ করে থাকে। ওয়েব অ্যাড্রেস: www.amadersujanagar.com মেইল অ্যাড্রেস: editor.amadersujanagar@gmail.com

error: Content is protected !!