সুকৃতি এবং বৈরীকাল (২য় পর্ব)
সুকৃতি এবং বৈরীকাল (২য় পর্ব)
অনেক বাবা-মা এক সাথে থেকেও হাজার কাজের চাপে সন্তানদের একেবারেই সময় দিতে পারেন না। কিন্তু তাঁরা বুঝতেও পারেন না নিজের অজান্তে কত বড় ক্ষতি করছেন সন্তানের। যে সন্তানের জন্যে বাবা-মা’র হাড়ভাঙ্গা শ্রম, সার্বিক চেষ্টা-প্ৰয়াস, সেই পিতা-মাতাই যদি সন্তানের সুন্দর মানসিক গঠনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তবে অনুশোচনার আর জায়গা থাকে না। সুকৃতি তার বঞ্চনা নিয়ে কোনোদিন মুখে অনুযোগ না করলেও ভেতরের উষ্মা থেকে তার মধ্যে এক ধরনের নিভৃতচারিতা গড়ে উঠেছিল। সে হয়ে উঠেছিল ভীষণ রকম অন্তর্মুখী। ছুটি-ছাটায় বাড়িতে এলেও সারাক্ষণ ডেক্সটপ আর বই নিয়েই ব্যস্ত থাকত সে। আচরণেও তেমন কোনো চপলতা নেই, বয়সের তুলনায় কেমন যেন একটু বেশি ‘ফরমাল’।
ওর আরও এক ছোট ভাই ছিল, সুতনু। সে তার উচ্ছলতা সারাক্ষণ বাসাময় সকলকে মাতিয়ে রাখলেও, অনেক দিন পর কাছে পাওয়া সুকৃতির অভেদ্য নিস্পৃহতা অবাক করত বাবা-মাকে। বড় বোন সুনন্দা সব সময় ওকে মনস্তাত্বিক সহযোগিতা বার চেষ্টা করত, বোঝাত। কিন্তু সুকৃতির দূরবাসী মন তাতে কতটা প্রফুল্ল হতো, তা খুব একটা বোঝা যেত না ।
ওর স্কুলের ‘রেজাল্ট’ বরাবরই ভালো। এছাড়া ‘এক্সট্রা কারিকুলাম’-এ বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার পারদর্শিতাও ছিল ঈর্ষনীয়। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, অবিরাম গল্প বলা, গল্প-কবিতা লেখা, আবৃতিতেও থাকত শীর্ষে। সুকৃতির এই সব ফলাফলে খুবই আশাবাদী হয়ে উঠেছিল বাবা-মা। কিন্তু ছেলের ভেতরের অব্যক্ত যন্ত্রণা, রক্তক্ষরণ প্রায় অজানাই রয়ে গেল তাদের কাছে। কারণ একসাথে থাকা অন্য দুজন ছেলে-মেয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যে নৈকট্য, খোলামেলা ভাবের যে আদান-প্রদানের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সুকৃতির সঙ্গে তেমন হয়নি। ওর মনোজগতে প্রবেশের ছাড়পত্র যে তাদের তেমন ছিল না, বাবা- মা’র সরল-সোজা ভাবনা সেটা অতখানি তলিয়েও দেখেনি কখনো। তাঁরা বুঝতেই পারেননি, বঞ্চিত সময়ের ব্যপ্ততা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্বের বাতাবরণ তাদের ভাবানুভূতির মধ্যে বিভেদের একটা সীমারেখা টেনে দিয়েছিল। আপন সন্তান যেন ক্রমেই দুরবাসী অপরিচিত হয়ে উঠছিল।
আরও পড়ুন গল্প উপলব্ধি
খুব ভালো রেজাল্ট করে এসএসসি এবং এইচএসসি পাশ করল সুকৃতি। সে বিবিএ-তে ভর্তি হলো অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (এআইইউবি) তে। বাবাও ঢাকায় বদলি হয়ে এলেন। নিজেদের ফ্ল্যাটে উঠলেন, ধানমন্ডি এলেকায়। নিজস্ব গাড়িতেই যাওয়া-আসা করত সে ভার্সিটিতে। ছোটভাই সুতনু তখন ধানমন্ডির সোডা’তে পড়ছে। বড়বোন সুনন্দা লন্ডনে গেছে মাস্টার্স করতে। ভার্সিটিতে ঢোকার বছর খানেকের মধ্যেই সুকৃতি ঝুঁকে পড়ল গানের দিকে। আগে থেকেই সে গল্প- কবিতা লিখত। এবার শুরু করল গান লেখা, গান করা। বাবা-মা’র অজান্তে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে ‘স্টেজ পারফর্ম’ করত সে। লেখালেখির মন-মননটা পেয়েছিল সে তার বাবার কাছ থেকেই। তার বাবাও সাহিত্য চর্চা করতেন। গোটা চারেক বইও বেড়িয়েছিল তাঁর। পরে সরকারি চাকরিতে এসে নানান দায়িত্ব-ঝামেলায় লেখালেখিতে তেমন মন-সংযোগ করতে পারেননি তিনি। তবুও মাঝে-মধ্যেই পত্রিকায় লেখা ছাপা হতো তাঁর। বাবার সেই সাহিত্য-ঝোঁকটা সুকৃতির মধ্যে ছোটবেলা থেকেই বিস্তারিত হয়েছিল। বাসায় বাবার ছোট-খাট লাইব্রেরিতে যে সংগ্রহ ছিল, সব ছেলে-মেয়েদের কাছেই তা ছিল অত্যন্ত প্রিয়।
ওরা সবাই ছিল বই-পোকা। এমনকি জন্মদিনে অন্য উপহার বা পোশাকের বদলে একগুচ্ছ বই পেলেই তারা বেশি খুশি হতো। বই পড়ুয়া সুকৃতি- ভাইবোনরা স্কুলে থাকতেই বাংলা-ইংরেজি সাহিত্য আর সায়েন্স ফিকশনের অনেক ভালো ভালো বই শেষ করে ফেলেছিল। কিন্তু গানের ব্যাপারটা ছিল পরিবারের কাছে একেবারেই নতুন। নিকট আত্মীয়ের কেউই কখনো নাম করা গাইয়ে ছিল না। বাঙালি স্বভাবে নিজে নিজে গুনগুন করে গান করা ছাড়া স্টেজে ওঠেনি কেউ কখনো। তাই যখন জানাজানি হলো সুকৃতি গান গায়, স্টেজ পারফর্ম করে, তখন বাসার সবাই একটু অবাকই হয়েছিল। ওর আর এক প্রতিভার বিকাশ দেখে খুশিও হয়েছিল। ঠিক এ সময়েই সে হঠাৎ করে প্রবল ভাবে লালন-দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়ল।
আরও পড়ুন গল্প নীল সমুদ্রের ঢেউ
একদিন সে কাচুমাচু করে বাবাকে বলল,
‘আব্বু, তুমি আমাকে লালনের শাহ’র উপর কিছু বই কিনে দেবে?”
একটু অবাক হয়ে বাবা বললেন,
‘কেন শেলফে তো লালনের উপর বই আছেই। ওটা পড়।’
সুকৃতি মাথা নিচু করে বলল,
‘ওটা পড়েছি। আমি আরও বিস্তারিত জানতে চাইছি। শুনেছি কুষ্টিয়ার কোনো এক অধ্যাপক লালন শাহ’র উপর বিস্তারিত গবেষণা করছেন। আমি তাঁর সাথে দেখা করতে চাই।’
হঠাৎ লালন শাহ’র উপর অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ায় বাবা একটু আশ্চর্য হলেন। লালন শাহ’কে জানার জন্যে একেবারে কুষ্টিয়ায় গবেষকের কাছে যাবার আগ্রহটা বাড়াবাড়ি পর্যায়েই মনে হলো তাঁর কাছে। তবুও ওকে প্রশমিত করার জন্যেই শান্ত কণ্ঠে বাবা বললেন,
‘ঠিক আছে। আগে নিজে লালনকে ভালো করে জানো। গবেষকের সাথে আলোচনায় যাবার আগে নিজের জ্ঞানকে পুষ্ট করে নেওয়াই সঙ্গত। আমি কালকেই তোমাকে কিছু বই এনে দেবো। পড়ে নিয়ো।’
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে গেলেন তিনি। কিন্তু চিন্তা ছাড়ল না তাঁকে। স্বল্পভাষী নিরাবেগী ছেলেটার এমন আবেগী একরোখা মনোভাব তাঁকে বেশ ভাবিয়ে তুলল। পরদিনই লালনের উপর একগাদা বই কিনে ছেলের হাতে তুলে দিলেন তিনি। ছেলের ভাব-আচরণে মনের ভেতরে তাঁর গভীর দুর্ভাবনা। সেই মানসিক দুশ্চিন্তা থেকেই খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলেন বাবা। যা ভেবেছিলেন তাই-ই। ঢাকায় যেখানে যেখানে লালনের গান হয়, বাউলের আখড়া বসে সে সব আসরে সময় দেওয়া শুরু করেছে সুকৃতি। বাসায় সময়ের হিসেবটা ঠিক রাখতে ক্লাস ফাঁকিও দিচ্ছে মাঝে মধ্যে। বাবার জানা ছিল সুকৃতি আধুনিক ব্যান্ড গান গায়। সেখান থেকে বাউল গানে ঝুঁকে পড়া, বাউল আসরে সময় কাটান ভালো কথা নয়। দুশ্চিন্তা এ জন্যে যে, এ ধরনের প্রায় সব আসরেই গাঁজা, মদ অবাধ সেব্য। কিশোর ছেলে গাঁজা-মদে একবার আসক্ত হয়ে পড়লে জীবনটা একেবারে শেষ হয়ে যাবে। ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ল বাবা-মা।
আরও পড়ুন গল্প পরনারী
এআইইউবি বেশ ভালো প্রতিষ্ঠান। পড়াশুনার স্ট্যান্ডার্ড-এ ঢাকার হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি। তবে বেশ ব্যয়বহুল। এখানকার বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীই উচ্চবৃত্ত ঘরের। ইদানীং অতি আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই সব উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের মানসিক গঠনে যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে, তাঁর ঢেউ সুকৃতিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও লেগেছে। উচ্ছ্বল স্বভাব, দায়িত্ববোধের অভাব, আড্ডাবাজি আর অকারণ পয়সা উড়ানোর প্রবণতা পেয়ে বসেছে ছেলে-মেয়েদের। সুকৃতির বাবা চাকরিজীবী বলেই হিসেব করে চলতে হয় তাঁকে। নেহায়েত সেমিস্টার ভিত্তিক একটা ভালো waiver পাবার কারণেই তাঁর পক্ষে ছেলেকে এআইইউবি-তে পড়ানো সম্ভব হচ্ছে। তাঁর শঙ্কা সুকৃতি যদি ওই সব বখে যাওয়া ছেলেদের সংস্পর্শে আসে এবং তাদের স্বভাব-আচরণ ওর মধ্যে সংক্রমিত হয় তবে, সকল সম্ভাবনা ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে।
ইদানীং কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের অনৈতিক ভাবাবেগ, উৎকট আধুনিক সংস্কৃতি, নেশা-আসক্তি এবং একরোখা মনোভাব প্রত্যেক বাবা-মাকেই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ এবং আতঙ্কিত করে তুলেছে। সম্ভাবনাময় সন্তানদের একটা বিরাট অংশের মধ্যে সম্প্রসারিত বর্তমান সময়ের মূল্যবোধ-বৈরী চেতনা, বিপথগামী প্রবণতা, বিধ্বংসী তারুণ্য-দাপট পুরো সমাজ-জাতিকে এক অনতিক্রম্য সংকটে ফেলে দিয়েছে। এই কাল-বৈরীতা নিয়েই সংশয় সুকৃতির বাবার। কালিক অপ-ভাবনা সামাজিক সুস্থির চেতনাকে গিলে খেতে বসেছে। জাতির একমাত্র আশ্রয়স্থল, সকল ভরসা আর সম্ভাবনার সুরম্য চত্বর আমাদের নতুন প্রজন্মকে এই বৈরী সময়ের অপ-সংস্কৃতি যেন বৃত্তচ্যুত, লক্ষ্যচ্যুত করে ক্রমাগত পতনোন্মুখ নিঃসীম অন্ধকারের পঙ্কিলতা আর অপার দগ্ধ-যন্ত্রণার মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন সুকৃতি এবং বৈরীকাল-
১ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সুকৃতি এবং বৈরীকাল (২য় পর্ব)