সুকৃতি এবং বৈরীকাল (শেষ পর্ব)
সুকৃতি এবং বৈরীকাল (শেষ পর্ব)
ইদানিং সুকৃতির কিছু নতুন বন্ধু জুটেছে। ওরা গান গায়, গিটার বাজায়, ব্যান্ড দল করে। তারা এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুকৃতির রুমে আড্ডা মারে। ওর মা বলছিল, আজকাল সুকৃতি সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে। প্রায়শই ওর রুম থেকে গন্ধ পাওয়া যায়। কখনো কখনো নাকি বেশ কটু গন্ধ আসে। খুবই দুশ্চিন্তায় পড়লেন বাবা। বাউলদের মজমা-আসরের সাথে গাঁজার একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। বেশির ভাগ বাউলই গাঁজায় বুঁদ হয়ে বিশেষ উন্মাদনায় নিজেদের সমর্পণ করে ভাবের জগতে। তাই বাউলদের আসরে যাবার তথ্য যখন বাবা পেয়েছিলেন, তখন থেকেই এক অজানা আশঙ্কা তাকে তাড়া করে ফিরছিল। সেটাই বুঝি সত্য হলো!
বাবা-মা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, সুকৃতির সাথে বসে কথা বলতে হবে। ওকে নিয়ে তাঁরা বসলও একদিন। মাথা নিচু করে সিগারেট খাবার কথা স্বীকার করলেও অন্য কোনো নেশার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করল সুকৃতি। বাউল আসর আর এ সব বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গ ত্যাগ করবে বলেও জানাল সে বাবা-মাকে। দেখা গেল সত্যি সত্যিই আস্তে আস্তে বন্ধুদের বাসায় আসা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু অন্যদিকে প্রায়শই সুকৃতির বাসায় ফেরায় বিলম্ব হতে শুরু করল। এ নিয়ে বাবা একদিন বকাঝকাও করলেন তাঁকে। সদাচারী বিনম্র সুকৃতি মাথা নত করে সময় মতো ঘরে ফেরার ওয়াদা করল। এরপর থেকে আর ঘরে ফিরতে দেরি করেনি সে।
কিন্তু অন্তর্মুখী সুকৃতি কেমন যেন আরও বেশি শান্ত হয়ে গেল। কারো সাথে তেমন কথা বলে না, ভার্সিটি ছাড়া সারাক্ষণ নিজের ঘরেই থাকে সে। ডাকলে খাবার টেবিলে এসে খেয়ে উঠে যায়। বোঝা যায় ভেতরে ভেতরে গভীর টানাপোড়েন চলছে তার। হয়তো নিজেকে ভেঙ্গেচুরে নতুন করে তৈরি করতে চাইছে সে। বাবা-মা আর ছোট ভাই যথাসাধ্য চেষ্টা করল তাঁকে স্বাভাবিক করতে। কিন্তু তত কতটা স্পন্দিত হলো সে তা মোটেও বোঝা গেল না ।
আরও পড়ুন গল্প রৌদ্রডোবা চাঁদ
এ ভাবেই গড়িয়ে যাচ্ছিল সময়। সবার মধ্যে থেকেও কেমন যেন একা হয়ে গেল সুকৃতি। কারো সাথে তেমন কথা বলে না সে, কৈশোরের দুরন্ত আবেগ-উচ্ছ্বলতা, সুক্ষ্মানুভুতিতে হঠাৎ পুলকিত হওয়া কিছুই নেই ওর মধ্যে। কেমন যেন নিরেট যান্ত্রিকতা ওর আচার-ব্যবহারে। প্রাণোউচ্ছ্বল ছেলের অকস্মাৎ এমন বদলে যাওয়ায় খুবই মুষড়ে পড়ল বাড়ির সবাই। বিশেষ করে ওর মায়ের উৎকণ্ঠা আর গোপন অশ্রুপাত বাবাকেও বিচলিত করে তুলল । সকলকে বসলেন তিনি। আলোচনা করলেন। সবাই খুব সচেষ্ট হলো সুকৃতিকে আগের মতো স্বাভাবিক করে তুলতে। মনে হলো কিছুটা পরিবর্তিত হচ্ছে সে। হতাশার মধ্যেও খানিকটা আশার আলো জাগল সবার মনে। আরও নিবিড় প্রয়াসী হলো সবাই ।
এ ভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় ‘নিচে থেকে আসছি’ বলে সেই যে বেড়িয়ে গেল সুকৃতি আর ফিরে এলো না। সে রাতেই সমস্ত বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনের বাসায় খোঁজ নেওয়া হলো। না, কোথাও যায়নি সে। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল সবাই। পরদিনই পুলিশ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল থানায় থানায় খবর পাঠানো হলো। নিখোঁজ সংবাদ গেল পত্রিকায়। ছেলের দুশ্চিন্তায় একেবারে ভেঙ্গে পড়ল সুকৃতির মা। খাওয়া- দাওয়া বন্ধ করে দিলো সে। অজানা শংকা আর দুর্ভাবনা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে সবাইকে। সকল আত্মীয়-স্বজন সমস্ত জায়গায় নিবিড়ভাবে খোঁজখবর করছে। কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না সুকৃতির। দুদিন পরে সন্ধ্যায় নিউমার্কেট থানার ওসি টেলিফোন করলেন সুকৃতির বাবাকে, ‘স্যার, আপনি কি একটু থানায় আসতে পারেন?’
আরও পড়ুন গল্প অন্ধকারে জ্বলে দীপশিখা
ওসি সাহেব চাকরির সুবাদে সুকৃতির বাবার পূর্ব পরিচিত। বেশ আন্তরিকতা নিয়েই সহযোগিতা করছেন তিনি। টেলিফোন পেয়েই কাউকে কিছু না বলে ড্রাইভারকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন বাবা। তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তিনি অনুমান করছেন, টেলিফোন কোনো সুখবর বয়ে আনেনি। হয়তো দুঃসংবাদই অপেক্ষা করছে তাঁর জন্যে। সেই আশঙ্কায় কাউকে এমনকি স্ত্রীকেও না জানিয়ে একা এসেছেন তিনি। চৌকশ পুলিশ অফিসার ওসি সাহেব চা আপ্যায়ন আর হালকা আলাপে কিছুটা সময় নিয়ে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করলেন সুকৃতির বাবাকে। অবশ্য টেলিফোন পাবার পর থেকেই দৃঢ় মনোবলের অধিকারী বাবা আগে থেকেই যে কোনো দুঃসংবাদের জন্যে মানবিক ভাবে তৈরি ছিলেন। তাই ওসি সাহেব যখন চট্টগ্রামের নির্জন পাহাড়ে পাওয়া এক লাশের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন বুঝতে বাকি রইল না লাশটি তারই হতভাগ্য সন্তানের।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন তিনি। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। চেয়ার থেকে উঠে এসে পাশে দাঁড়ালেন ওসি সাহেব। কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,’স্যার, আপনি ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না। পরিবারের সবাইকে তো আপনিই সাহস যোগাবেন। আপনাকে শক্ত হতে হবে স্যার।’
চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হ্যা, তাঁকে শক্ত হতে হবে। ঋজু মানসিকতা আর সাহসে সকলকে আগলে রাখতে হবে, তছনছ হয়ে যাওয়া পরিবারকে তাকেই তো গোছাতে হবে। নীলকণ্ঠের মতো সমস্ত বিষ গলাধকরণ করে মুখে হাসি ধরে রাখতে হবে! আসতে আসতে বাইরে এসে ছোট ভায়রাকে ফোন করলেন তিনি। সব জানিয়ে কাউকে কিছু না বলে সোজা থানায় চলে আসতে বললেন তাকে। সে রাতেই গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রামে রওয়ানা হয়ে গেল ছোট ভায়রা। সাথে গেল ড্রাইভার আসাদ। নিজে চট্টগ্রামে যাবার মতো মনোবল আর সাহস কোনোটাই আর অবশিষ্ট ছিল না তাঁর। ইতোমধ্যে বাসায় জেনে গিয়েছে তাঁর ভায়রার চট্টগ্রামে রওয়ানা হবার সংবাদ। কেন গেল, কি হয়েছে নানান প্রশ্ন সবার। বাসায় ফিরে স্বাভাবিক হবার খুব চেষ্টা করলেন সুকৃতির বাবা। পারলেন না তিনি। বুকের ভেতর থেকে হুহু করে কান্না বেড়িয়ে এলো। জানাজানি হয়ে গেল সব।
আরও পড়ুন গল্প রক্তে জ্বলে একাত্তর
বাড়িতে কান্নার রোল পরে গেল। দেওয়ালে মাথা কুটে অজ্ঞান হয়ে পড়ল মা। চিৎকার করে মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল ছোটভাই। বড়বোন লন্ডনে পড়াশুনা করছে। কিছুই জানানো হলো না তাকে। দুঃসংবাদ পেয়ে ছুটে এলো আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু কি সান্ত্বনা দেবে তারা? এই হারানোর বেদনায় সান্ত্বনা দেবার কি কোনো ভাষা আছে? কিছু কিছু কষ্ট আছে, বেদনা আছে, যা অপনোদনের ভাষা সারা পৃথিবীতে নেই। এই ক্ষত কখনো শুকায় না, প্রশমিত হয় না, সারা জীবন দুঃসহ যন্ত্রণায় এই দগদগে ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় বুকের ভেতর। তুষের অনল যেমন ধিকিধিকি জ্বলে কেবলই পোড়ায়, কেবলই দগ্ধ করে, এই কলজে ছেঁড়া হারানোর বেদনা তেমনই অবিনাশী, তেমনই সারাক্ষণ অন্তর্দাহী। জীবনের সাথে, পরমায়ুর সাথে এই অপার যন্ত্রণা ওতপ্রোত বসবাস করে আর অহর্নিশ নিভৃতে শুধুই কাঁদায়।
সুকৃতির লাশ এলো একদিন পর। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে জানা গেল মাথায় জখমের দাগ রয়েছে। কেটে দেওয়া হয়েছে হাত-পায়ের রগ। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ আর মাথায় আঘাতেই মৃত্যু হয়েছে তার। হত্যার পর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছে নির্দয় হত্যাকারীরা। কিন্তু কেন সুকৃতিকে হত্যা করা হলো, কি শত্রুতা তার সাথে, কিছুই বুঝতে পারল না পরিবারের কেউ। স্বল্পভাষী এই ছেলেটা কারো সাথে কোনোদিন বিবাদেও জড়ায়নি। তার বন্ধু-বান্ধবের সাথে মনোমালিন্যের তথ্যও জানা নেই কারো। বরং বহুমাত্রিক প্রতিভার জন্যে বন্ধু মহলে ওর আলাদা একটা খাতির ছিল, সবাই ভালোবাসতো ওকে।
আরও পড়ুন গল্প একশত ছিদ্রযুক্ত জামা
ছেলের হত্যার সাথে জড়িত কাউকে সন্দেহ পর্যন্ত করতে পারছেন না বাবা-মা। অপহরণ করে মুক্তিপণের জন্যেও কেউ ফোন করেনি তাঁদের। নাকি ত্বরিত পুলিশী তৎপরতার কারণে অপহরণকারীরা সাহস পায়নি। কিছুই বুঝতে পারছে না তারা। অসহায়ের মতো কেবল অব্যক্ত যন্ত্রণায় দগ্ধিত হচ্ছে সবাই । সুকৃতির হত্যাকাণ্ড নিয়ে সীতাকুণ্ডু থানায় অস্বাভাবিক হত্যা মামলা ঋজু হলো। পুলিশের তদন্ত-অভিযানও চলল জোরেশোরে। চট্টগ্রাম থেকে তদন্ত দল এলো ঢাকায়। বাসার লোকজন, আত্মীয়-স্বজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করল তথ্য সংগ্রহের জন্যে। এআইইউবি-তে গিয়েও বেশ কদিন পরিদর্শন-তদন্ত করল তারা। কোর্সমেট, বন্ধু-বান্ধবদেরও জবানবন্দি গ্রহণ করা হলো। কয়েকটি বাউল আসরেও হানা দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালাল তারা। কিন্তু কোনো ক্লু পেল না তদন্তকারী দল ।
সুকৃতির বাবা-মা-ভাই, আত্মীয়-স্বজনরাও কোনো তথ্য-উপাত্য দিতে পারল না তাদের। আবার আসবে বলে ঢাকা ত্যাগ করল তারা। এরপর বেশ কবার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকায় এসেছে, তদন্ত করেছে। অকুস্থল চট্টগ্রামেও তদন্ত- চেষ্টা চলল কিছুদিন। কিন্তু সব তাদন্তিক প্রয়াশই নিস্কলে গেল। শেষাবধি কোনো প্রামাণিক তথ্যাদি না পাওয়ায় সুকৃতির অপমৃত্যু মামলাটির অপমৃত্যু হলো। কেসটির ‘চূড়ান্ত রিপোর্ট’ দিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। সুকৃতির হত্যা রহস্যের জট আর খুলল না, অনুৎঘাটিত, অবগুণ্ঠিতই রয়ে গেল। শুধু রেখে গেল একটি পরিবারের জন্যে অনুক্ষণ অলঙ্ঘনীয় যন্ত্রণা, অন্তহীন বেদনা, সম্ভাবনাময় প্রসন্ন হৃদয় চত্ত্বরে অমোচনীয় ঘোর কালো দগদগে ক্ষতচিহ্ন।
আরও পড়ুন গল্প প্রথম প্রভাত
আজকাল বড়ই অরক্ষিত সময়ে বাস করছি আমরা। সুজনের আবরনে স্বজন সেজে আমাদের চারপাশেই বাস করছে নির্দয় ঘাতক। বন্ধুত্বের মোহন মায়ায় স্বার্থান্ধ কপটচারী অলক্ষে সারাক্ষণ করছে ষড়যন্ত্র। প্রতি মুহূর্তে আমাদের জীবন রয়েছে হুমকির মুখে। কখন যে কাল-বৈশাখীর দমকা হাওয়ায় ঝড়ে পড়বে হিরণ্ময় ভবিষ্যৎ, ছিন্নভিন্ন হবে সুস্থির সাজানো সংসার, অতর্কিতে নিভে যাবে স্বপ্নিল জীবনের কনকোজ্জ্বল আলোক বর্তিকা, তা কেউ বলতে পারে না। উন্মাতাল অপসংস্কৃতির কড়াল গ্রাসে আমরা বড়ই অসহায় হয়ে পড়েছি। আমাদের তারুণ্য, যৌবন এখন অগ্নি-পরীক্ষার ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছে। জাতির স্বপ্নের চাবি যাদের কাছে গচ্ছিত, সেই সব কিশোরদের, তরুণদের সামনে পদে পদে স্খলনের হাতছানি, পঙ্কিল আবর্তের লোলুপ আবাহন, কদর্যময় স্বার্থপরতার নৃশংস জিঘাংসা। আজ তাই অপার সম্ভাবনাময় সুকৃতিরা অকালে ঝড়ে যায়, সুনন্দ-প্রত্যাশারা অসময়ে অবিশ্বাস্য অন্তহীন বেদনায় মৃত্যুর কফিনে গড়ায় ।
আমাদের এভাবে আর কতদূর যেতে হবে? কত বেশি দিলে শোধ হবে ঘাতকের দায়?
আরও পড়ুন সুকৃতি এবং বৈরীকাল-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সুকৃতি এবং বৈরীকাল (শেষ পর্ব)