সাইদ-মো-আহসান-হাবিব
বৃমালঞ্চি,  মুক্তিযুদ্ধ,  মুক্তিযুদ্ধে সুজানগর,  মুক্তিযোদ্ধা,  মুক্তিযোদ্ধাদের কথা,  রানিনগর,  সমাজসেবক

সাইদ মো. আহসান হাবিব

সাইদ মো. আহসান হাবিব : একজন বীর যোদ্ধার কথকতা

 

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী উত্তরাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনসভায়, হালকা পাতলা ঝাকরা চুলের যে যুবকের বক্তৃতা জনতার মনে ঝড় তুলতো, তিনি আর কেউ নন ভাগ্যবিড়ম্বিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আহসান হাবিব।পুরো নাম সাইদ মো. আহসান হাবিব। সাধারণ মানুষের কাছে পাগলা হাবিব বলেই বেশি সমাদৃত। তিনি নিজ যোগ্যতায় তৎকালিন কেন্দ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নজর কাড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আহসান হাবিবকে অত্যন্ত আদরের সাথে বুকে টেনে নেন। ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নগরবাড়ি বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ উদ্বোধনীতে লাখো জনতার সমাবেশে, আহসান হাবীবের বক্তব্য শুনে আবেগ আপ্লুত বঙ্গবন্ধু আহসান হাবিবকে হেলিকপ্টারে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় নিয়ে যান।

বিল গাজনার জনসভায় আহসান হাবিব, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং ত্রাণ ও পুর্ণবাসন মন্ত্রী এ এইচএম কামরুজ্জামান।
নগরবাড়ি জনসভায় সৈয়দ মো. আহসান হাবিব 

সাইদ মো. আহসান হাবিব পাবনার সুজানগর উপজেলার রাণীনগর ইউনিয়নের বৃমালঞ্চি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বয়েজ উদ্দিন। আহসান হাবিব পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরি করতেন। তিনি ছুটিতে দেশে আসার পর মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলে আর পশ্চিম পাকিস্থানে ফেরেননি। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে, আহসান হাবিব মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত করতে শুরু করেন। তার গলার আওয়াজ এতই শক্তিশালী ছিলো যে, মাইক ছাড়াই অনেক দুর থেকে তার গলা শোনা যেতো।

আরও পড়ুন সুজানগরের একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক আজিজুর রহমান

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সুজানগর থানা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করতে, বিভিন্ন হাট-বাজারে ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতেন। হাট বাজারে আসা মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনতেন। তিনি ২৬ মার্চ সকাল সাড়ে ৭ টায় সুজানগরের নিশ্চিন্তপুর বাজারের রাধা পালের দোকানের ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে জনগনকে উজ্জীবিত করতে বক্তব্য রাখেন।

এরপর তিনি বিমল কুন্ডু (সাবেক জেলা প্রশাসক ও যুগ্মসচিব) সহ বেশ কয়েক যুবককে নিয়ে সুজানগর থানার উদ্দেশে রওনা হন। সাতবাড়িয়া কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারি অধ্যাপক মো. মোতাহার আলী বিশ্বাস ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সভাপতি হিসেবে আহসান হাবিবের সাথে সুজানগর থানায় যান। আহসান হাবিব থানার দরজা খুলতে ওসিকে আহ্বান জানালে, সে অস্বীকৃতি জানায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতায় ওসিকে অস্ত্র দেয়ার আহ্বান জানালেও, থানার দরজা না খোলায়, তখন তারা সিও অফিসে যান।

সুজানগরের সিও আব্দুল জব্বার আকন্দ’র সহযোগিতায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের নির্দেশনায় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল গণির নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটিতে স্বেচ্ছায় বহু যুবক যোগদান করায়, সেসময় মুক্তিকামী জনতার কাছে সিও হয়ে উঠেন ভরসাস্থল। তাই আহসান হাবিব সেদিন সিওর সাথে দেখা করতে গেলে, দেখতে পান সাতবাড়িয়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ফজলুল হক, সাতবাড়িয়া কলেজের রসায়নের প্রভাষক দেবব্রত ঘোষসহ বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাগামী মানুষ সেখানে অবস্থান করছেন। এরপর আহসান হাবিব ওসিকে মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র দেবার জন্য আহ্বান জানালে তিনি আবারও অস্বীকৃতি জানান।

আরও পড়ুন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ বুলবুল

সুজানগর থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আহম্মেদ তফিজ উদ্দিনের কথায়, ওসি থানা থেকে ৩০-৪০টি রাইফেল দিতে বাধ্য হয়। আহসান হাবিব নগরবাড়ি প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয়ার পর ভারতে যান । সেখান থেকে ফিরে ৭ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেন।

বিল গাজনা রাণীনগর হাই স্কুল এন্ড কলেজ
                         বিল গাজনা রাণীনগর হাই স্কুল এন্ড কলেজ

এরপর তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ফিরে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। সুজানগর উপজেলার যোগাযোগবিহীন প্রত্যন্ত বিলপাড়ের রাণীনগরে, তিনি ১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে রানীনগর বিলগাজনা হাই স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ সড়ক নির্মাণ করেন। স্কুল প্রতিষ্ঠার আগে ৭-৮ মাইল পায়ে হেটে খলিলপুর হাই স্কুলে এলাকার ছেলে-মেয়েদের পড়তে যেতে হতো। আহসান হাবিব তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও ত্রাণ ও পুর্ণবাসন মন্ত্রী এ এইচএম কামরুজ্জামানকে বিশাল জনসভায় আমন্ত্রণ জানান এবং রানীনগর বিলগাজনা হাই স্কুল ও সড়কের উদ্বোধন করেন। সে সড়কটি আহসান হাবিব সড়ক নামে প্রতিষ্ঠিত। রানীনগর থেকে আহম্মদপুর পর্যন্ত এ সড়কটি এলাকার যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক বড় ভুমিকা রাখে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিলগাজনা হাই স্কুলটি হাটি হাটি পা পা করে ৫০ বছর পার করেছে।

আকস্মিক আহসান হাবিবের জীবনে যেন ছন্দপতন ঘটে। তিনি আ স ম আব্দুর রবের জাসদে যোগ দেন। চরম সঙ্কটাপুর্ণ অস্থির রাজনৈতিক সঙ্কটে দেশ নিপতিত হয়। একেতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাবার নেই, রাস্তাঘাট নেই, সবই ধ্বংস স্তুপ; তার মধ্যে পরিস্থিতি এমন দাড়ায় যে, একভাই অপর ভাইয়ের শত্রু বলে চিহিৃত হয়। জাসদ টার্গেট করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে, আবার আওয়ামী লীগ টার্গেট করে জাসদকে। সে সময় বেশ কয়েকবার আহসান হাবিবকে হত্যার চেষ্টা করা হয় । কাশিনাথপুরসহ বিভিন্ন এলাকার সমন্বয়ে গঠিত তৎকালীন শক্তিশালী একটি টিম, আহসান হাবিবকে বার বার হত্যার চেষ্টা চালায়।

আরও পড়ুন বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু

সেসময় রাণীনগর ইউনিয়নে সাংগঠনিক অভিযান চালাতে, আগে বাবার সম্মতি নিয়ে তারপর যেতে হতো। তাই যেদিন আহসান হাবিবকে মারার অপারেশন ঠিক হতো, তা আগেই বাবা জানতে পারতেন। এ সুযোগে আহসান হাবিবকে ডেকে এনে আমাদের বাড়িতে নিরাপদে বসিয়ে রাখা হতো। এরপর হত্যা প্রচেষ্টাকারীদের সাথে নিয়ে বাবা অভিযানে অংশ নিতো। এভাবে কয়েকবার আহসান হাবিবের হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ করা হয়। বাবা তখন ঘনিষ্ঠদের বলতোট, মানুষ মেরে কিসের রাজনীতি? আমার ইউনিয়নে একজনও হত্যার শিকার হোক, আমি তা চাই না। তাই কোন হত্যাকান্ড আমি হতে দেবো না। তার এ মনোভাবের কারণে আমাদের এলাকায় সেসময় কোন অঘটন ঘটেনি।

সেসময় কাশিনাথপুর থেকে কাঁচা, উচু-নিচু ৮ মাইল বন্ধুর পথ পায়ে হেটে আমাদের রানীনগর ইউনিয়নে যেতে হতো। রিক্সায় যাওয়া বেশ কঠিন ছিলো। কাশিনাথপুর মোড়ের হোসেন নায়েবের বাড়ির নিকট দিয়ে কাচা রাস্তায় কিছুদুর এগিয়ে গেলে নয়াবাড়ি মোড়ে ছিলো অনেক নিচু গ্যাপ। সে গ্যাপে রিক্সা নামাতে হলে পিছন থেকে টেনে ধরে আস্তে আস্তে নামানোর পর, পিছন থেকে ঠেলে রাস্তার উপরে উঠাতে হতো। এভাবে কিছুদুর পর পর রিক্সা থেকে নামতে হতো।

একদিন আহসান হাবিব ঢাকা থেকে ফেরার পথে রিক্সায় নয়াবাড়ি মোড়ে এলে, সাবমেশিনগানসহ সুসজ্জিত কয়েক যুবক তাকে ব্রাশফায়ার করতে উদ্যত হয়। এসময় আহসান হাবিব এ্যাটাসি খোলার ভঙ্গিতে মুখে এমন হুঙ্কার দেয় যে, প্রতিপক্ষের যুবকরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়।

আরও পড়ুন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রসাদ রায়

এরই মধ্যে আহসান হাবিবের জীবনে ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা। তার আপন সহোদর বিএম সিদ্দিকুর রহমান, পাবনাতে ব্যাংকে টাকা তুলতে এলে, তাকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। ভাই হত্যাকান্ডে তিনি অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়েন। সাদাসিধা সুদর্শন নিরাপরাধ বিএম সিদ্দিকুর রহমান, রাজনৈতিক কোন কিছুতে না থাকলেও শুধুমাত্র আহসান হাবিবের ভাই হবার কারণে, নির্মম হত্যার শিকার হতে হয়। তাকে হত্যার পর এডরুকের পাশে ফেলে রাখা হয়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নির্মম হত্যাকান্ডের পর, মেজর জিয়াউর রহমানের সেনা শাসনে তিনি গ্রেফতার হন। পাবনা ক্যাডেট কলেজ (সাবেক মডেল স্কুল) সেনা ক্যাম্পে, আহসান হাবিবকে অকথ্য নির্যাতনের পর জেলে রাখা হয়। নির্যাতনে আহসান হাবিব মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে, বেশ কিছুদিন পর জেল থেকে বের হন।

এরপর বাড়িঘড় ছেড়ে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকেন। এক সময় নগরবাড়ি ঘাট আর ঢাকার রাস্তায় ছেড়া ময়লা কাপড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।

আরও পড়ুন সম্মুখ সমরের প্লাটুন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিফা আশরাফ

৮০ দশকে আহসান হাবিব ঢাকা স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকায় যেন আবাস গড়ে তোলেন। সারা দিনরাত এ মার্কেট এলাকাতেই তিনি থাকতেন। আমার সাথে এখানেই একদিন দেখা। স্টেডিয়াম মার্কেটের ২য় তলায় বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনেরর মহাসচিব কোহিনুর ভাইয়ের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে সবেমাত্র নিচে নেমেছি, দেখি হাবিব কাকু দাঁড়িয়ে। আমি যেন স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। এমন সময়ে কয়েকজন লোক জড়ো হলো। এরই মধ্য থেকে একজন বলে বসলো-হায়রে মানুষের ভাগ্য! আজ ভালো থাকলে সে মন্ত্রী হতো আর এখন সে পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় হাত পাতছে। আমি না চেনার ভান করে জিজ্ঞাসা করলাম, উনাকে চেনেন? তারা জানালো, পাগলা হাবিব দিনরাত আমাদের এখানে অনেকদিন ধরে থাকেন। স্টেডিয়াম এলাকার ব্যবসায়ীরা তাকে খুবই ভালোবাসেন। তার জন্য হোটেলের খাবার ফ্রি করে দেয়া হয়েছে বলে তারা জানান। আহসান হাবিবের বন্ধু সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, তাকে কয়েকবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেলেও, তিনি সুস্থ হননি বলেও তারা জানায়।

তিনি হাসপাতালের বাইরে এসে, আবার সে আগের অবস্থায়ই ফিরে যান। এরপর ১৯৯৬ সালে আ স ম আব্দুর রবের সহায়তায় তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসার পর তিনি নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। দুই ছেলে, দুই মেয়ের পিতা আহসান হাবিব রোগ শোক আর বয়সের ভারে শেষ জীবন নিজ বাড়িতেই কাটান।

সৈয়দ মো. আহসান হাবিব সবাইকে কাঁদিয়ে, আজ ৭ মার্চ মৃত্যুবরণ করেছেন।

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

Facebook Comments Box

কৃষ্ণ ভৌমিক দীর্ঘকাল সাতবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা শেষে বর্তমানে অবসর যাপন করছেন। দৈনিক জনকণ্ঠের পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে লিখছেন। তিনি ১৯৬০ সালের ১২ মে, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত রাণীনগর ইউনিয়নের বাঘুলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!