সরদার-জয়েনউদ্দীন-৪র্থ-পর্ব
কামারহাট,  নাজিরগঞ্জ,  বই পর্যালোচনা,  লেখক পরিচিতি,  সাহিত্য

সরদার জয়েনউদদীন (৪র্থ পর্ব)

সরদার জয়েনউদদীন (৪র্থ পর্ব)

 

সাহিত্য মূল্যায়ন:

কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীনের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নয়ান ঢুলী’। নয়ান ঢুলী, কানা ফকিরের ব্যাটা, ফুলজান গল্প পর্যালোচনা-

নয়ান ঢুলী

‘নয়ান ঢুলী’ গল্পের প্রধান চরিত্র নয়ান। সে ঢোল মেরামতের কাজ করে জীবিকা চালায়। তার এ-পেশায় দিনদিন রোজগারপাতি কমে আসছে। কারণ আগে হাতে খুব কাজ আসত। বারোয়ারি মন্দিরের কাজ, চৈত্রসংক্রামিত্মর কাজ, গাঁয়ের যাত্রা পার্টির কাজ। তাছাড়া ভাসান-গাজির গান, তিননাথের মেলা, রামনামের আসর থেকেও তার ডাক আসত। ঢোল মেরামতের বায়না, দিনদিন সব কেমন হয়ে গেল। পরিবর্তন হলে একশ্রেণির মানুষের পেটে যে টান পড়ে তার একটা ইঙ্গিত স্পষ্ট দেখা যায়। তাই আজকাল কাজ পেলে নয়ানের মন ভরে। হাতে যেন সোনার তাল পায়। চোখে অনেক স্বপ্ন গিজগিজ করে। দুঃখ-সুখের দিনগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকে। হতভাগ্য একজন মানুষের জীবনের কাহিনি গাল্পিক অত্যন্ত দরদের সঙ্গে চিত্রায়িত করেছেন। দারিদ্র্য মানুষকে কুরে-কুরে নিঃশেষ করে।

আজ নয়ানের ঘরবাড়ি মানে ওই জড়াজীর্ণ ঝুপড়ি, সাথি-সঙ্গী সব মরে গেছে। শুধু ওই ছাগল টেপীকে নিয়েই সংসার! বারান্দায় বসে হুককুর-হুককুর কাশে আর কাজকর্ম দেখে। ওর এককালের সাগরেদ পচাই। তার দুঃখ-দুর্দশার কথা শোনায়। নয়ানের স্বতন্ত্র একটা জীবন ছিল। মানুষের বাড়িঘর নির্মাণ ওর পৈতৃক পেশা। নয়ান ঘরামির ডাকনাম ছিল দেশগাঁয়ে। একবার হারান পরামানিকের বাড়িতে কাজ করে চারদিন; কিন্তু টাকা দিতে চায় না। বলে, টাকা নাই, কাল নিও… নয়ান জানায়, বাড়িতে চাল নাই, তবু হারান নাছোরবান্দা ফিরিয়ে দেয়। ঘরে মেয়ে জরিপোশ ক্ষুধায় কাতর, ওর মা জ্বরে অজ্ঞান। ঘরে চাল নেই, বার্লি নেই, ডাক্তারও পয়সার অভাবে আসে না। দিশেহারা নয়ান শীতেলের কাছে যায়। জেলের ঘুঘু শীতেল চোর, গরিবের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। সিঁদকাটা চোর হলেও মানুষের কষ্ট বুঝত। নয়ানের কথা শুনে শীতেল বলল, কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকার জায়গাটা শুধু দেখিয়ে দিবি। সে-রাত্রে দুজনে হারানের বাড়ি চুরি করে। সকালে ডাক্তারের কাছে ফিসের টাকা নিয়ে গেলে ধরিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের তারা পরিচিতি রিভিউ

সারা গাঁয়ে হুলস্থুল কান্ড! বিচারে দুজনের ছয়-ছয় মাসের জেল হয়। জেল থেকে বের হয়ে জরিপোশ আর ওর মাকে দেখতে পায়নি নয়ান। মরে গেছে না-খেতে পেয়ে। সেই থেকে পিতৃপুরুষের পেশা ছেড়ে নয়ান ঘরামি হয়ে যায় নয়ান ঢুলী। কথা বলতে-বলতে চোখ ফেটে পানি ঝরে। সাগরেদ পচাই বলে, কাঁদলে হবে না, চলো আবার শিকারে। আমি নিজের হাতে করব। তুমি উঠে দাঁড়াও নইলে যে আমরা বাঁচব না। গল্পের শেষে দেখা যায়, শেষরাত্রের দিকে পচাই আসে নয়ানের বাড়ি। ঘন অন্ধকারে দুজন এগিয়ে যায় সামনে। আঁধারের গভীরতা ভয় জমিয়ে তোলে মানুষের মনে, তবু ওরা আঁধার ভেদ করে যেতে থাকে। আঁধারের চেয়ে ক্ষুধা বড় মারাত্মক। দারিদ্র্য মানুষকে ভীরু করলেও উদ্যমী ও সাহসী করে তোলে কখনো। নয়ান ঢুলী সেই পিতা, যে তার মেয়ে জরিপোশকে ক্ষুধার অন্ন দিতে পারেনি। বউকে ওষুধ-পথ্য দিতে পারেনি, টাকার অভাবে বাড়িতে ডাক্তার আসেনি।

মানুষের প্রতি মানুষের এই নির্মমতা-পৈশাচিকতা সাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীন সহজ-সরল ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। মাটি-মানুষের এই মেলবন্ধন গল্পটিকে একটা যোগ্য আসনে উপনীত করেছে বলতে দ্বিধা নেই।

কানা ফকিরের ব্যাটা

মায়ের নিকের পক্ষের স্বামী নসিব মিঞা। লোকে বলে কানাফকির। কোলটুও কানাফকির বলেই ডাকে। ‘কানা ফকিরের ব্যাটা’ গল্পে কোলটুর চরিত্র নজর কাড়ে। ওর বাপ তোরাপ বেপারী, ব্যবসা-বাণিজ্য করত; মরিচ-পটোলের বেপারী ছিল। অথচ আজ সে কানাফকিরের বেদম মার খায়। কারণ ওর সঙ্গে ভিক্ষে করতে যায় না এই অপরাধে। কোলটু আর ওর মা এভাবে অত্যাচার সহ্য করতে করতে কখনো সত্যিই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তবে কানাফকিরের হাজারো যুক্তি দিয়ে অপমান-অশ্রাব্য গালিগালাজ করে। একদিন কোলটু বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ওর বয়সী ছেলেরা স্টেশনে কুলিগিরি করে পয়সা রোজগার করে। চ্যারাগের সঙ্গে সেও কুলিগিরি করবে বলে মনস্থির করে। কানাফকিরের মতো ভিক্ষা করে জীবন চালানো কোনো সম্মানের কাজ নয়। ওর মাও ভিক্ষাকে ঘৃণা করে। গল্পে দেখা যায়, একজন মানুষের মাথা উঁচু করে বাঁচার মধ্যে আছে অনেক তৃপ্তি-আনন্দ। সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কোলটুর ভেতর দিয়ে সভ্যতাকে দেখা যায়। জীবনের রং স্পর্শ করা সম্ভব হয়।

ফুলজান

‘ফুলজান’ গল্পে একজন দশ বছরের বাবলুকে দেখা যায়, যার পিতা কবির মাস্টারের স্বপ্ন ছিল ছেলেকে গড়ে তুলবেন দেশের গৌরবের জন্য। মানুষের মতো মানুষ করে। কিন্তু সে-স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গেল। হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হিসেবে কবির মাস্টারের গ্রামে একটা নামও ছিল। তাই সময়-অসময়ে রাত্রিদিন ডাক পেলেই কলেরা রোগীকে দেখে। রোগ দেখে একফোঁটা ডোজ দিয়ে আসতে হয়। শেষাবধি কলেরার আক্রমণে তাকেও চলে যেতে হলো একদিন আকস্মিকভাবে। বাবলু হলো এতিম। নবীনগরের কবির মাস্টারের ভিটে ছেড়ে ফুলজান পেটের দায়ে ছলিম সরদারের ঘর করতে যায় দশ বছরের বাবলুকে নিয়ে চরসানিকদে। চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল। একদিন দিন ফিরবে; কিন্তু সবই ভুল হলো।

ছলিম কারণে-অকারণে মা-ছেলেকে অত্যাচার করতে থাকে। দিনে দু-চারবারও নির্যাতন চলে অতটুকু বাবলুর ওপর। করূণ চোখে তাকিয়ে থাকে আর বলে, মা-মা… ছলিম পাষাণ মানুষ। হুঙ্কার আর মারমুখী ভাব সবসময়। সহ্য করতে পারে না ফুলজান ছেলের ওপর এত অত্যাচার। একদিন বাবলুকে বলে, আমি তোর মা নই। তোর মার নবীনগরের মাস্টারের বাড়িতে সমাধি হয়েছে। এখানে তোর কেউ নেই, মামুদের বাড়ি যা। তারপর আরেকদিন দুহাতে ঠেলে বের করে দেয় ছেলেকে। যাওয়ার সময় দুটো পান্তা খেতে চেয়েছিল, তাও দেয়নি। বলেছিল, তোর পাতে ভাত আর উঠবে না। ঘরের বেড়া ধরে অনেক কেঁদেছিল বাবলু। তারপর বেরিয়ে যায়, কোথায় হারিয়েছে কেউ জানে না। লোকে বলে, মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে চাকরি দেবে বলে। ফুলজান সবই সহ্য করেছে। যেদিন ছলিম ওকে তালাক দিয়েছিল, সেদিনও মুখ বুজে স্বামীর ভিটে ছেড়ে আর্তনাদ করে বলেছিল, হায় অদৃষ্ট!

আরও পড়ুন আমাদের সুজানগর সাহিত্য সংকলন রিভিউ

গল্পে পাঠক একজন সংগ্রামী ফুলজানকে দেখতে পান। যে আজ ভাগ্যদোষে অন্যের বাড়ির ঢেঁকিপাড়ার ধানবারানি। ফুলজানের চেহারা-সুরত ভালো বলে নবীনগরের মাতবর রশিদ মিয়া রসিকতা করে নিকে করতে চেয়েছিল। একবার ভেবেছিল গেলেও মন্দ কী। কিন্তু মন সায় দেয়নি, বাবলুর অপেক্ষায় থাকবে। সে নিশ্চয় একদিন ফিরে আসবে। কিন্তু আবার মন বলে, সে কি সত্যিই আর ফিরে আসবে? যুদ্ধ তো কবে শেষ। তবে কি যুদ্ধের ময়দানে কোথাও হারিয়ে গেল? স্বপ্ন শেষ হলেও আশা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। ফুলজান সেই আশায় বুক বাঁধে। স্বপ্নহীন আশাহীন মানুষের জীবনের গল্প এভাবেই একটা অন্ধকার-বাঁকে এসে থিতু হয় অথবা হারিয়ে যায়। তারপরও ফুলজানেরা-বাবলুরা-কবির মাস্টারেরা বেঁচে থাকে মানুষের আকাঙক্ষায় আপন বৃত্তে। সরদার জয়েনউদ্দীন এভাবেই প্রতি গল্পের ছত্রে-ছত্রে দাগ রেখে গেছেন, সে-দাগ আমাদের অনেক দূরে নিয়ে যায়। আমরা তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকি তাঁর গল্পের কাহিনিমালার দিকে। গল্পের বাঁকে-বাঁকে এত জীবন্ত ছবি, তা যেন আমাদের জীবন বা পারিপার্শ্বিক ছবি, চিত্রায়িত হয়েছে বিশাল ক্যানভাসে। সত্যিকার সাহিত্যিকই তো সেই ক্যানভাসকে ফুটিয়ে তোলেন জগতের মুখোমুখি।

ভাষায় গতিময়তায় অসামান্য ভাস্কর্য নির্মাণ করতে পেরেছেন সরদার জয়েনউদ্দীন। কোনো কোনো গাল্পিকের কোনো একটি গল্পের ভাবকল্পে, তার অন্তর্বয়ন ও শিল্পনির্মিতির স্বাতন্ত্র্যে কিংবা নির্মিতির স্রষ্টার শিল্পীসত্তার বিম্বিত রূপ অনুসন্ধান তীব্র অবিনাশী পুনর্নির্মাণ। হয়তো তা বিদ্যায়তনিক সাহিত্যালোচনা নয়, বিদ্বদগোষ্ঠী অনুমোদিতও নয়। কিন্তু সরদার জয়েনউদ্দীনের যে সাহিত্যকৃতির সঙ্গে আমাদের পরম আত্মীয়তা, সেখানে সেই শিল্পবাস্তবে সবই রহস্যময়। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ বা ডিটেলসের প্রতি আকর্ষণ তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি, বরং প্রতিক্ষেত্রে সচেতন নিমগ্নতা তাঁকে বাস্তব পরিপ্রেক্ষেতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে প্ররোচিত করে। এই বিশ্বস্ততা দেখি ইতিহাসের প্রতি, মানুষের প্রতি, দেশমাতৃকার প্রতি এবং স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের প্রতি। আখ্যানে যেস্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, তাতে আমরা দেখি একটি জনপদ, একটি জনগোষ্ঠী, জনপথের অতীত-বর্তমান, সেইসঙ্গে ভবিষ্যৎ-অতীতের হাড়গোড়ের স্তূপ থেকে নড়েচড়ে ওঠে আরেকবার, একটি অমরণশীল জীবনযাপন।

১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
৭ম পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

সরদার জয়েনউদদীন (৪র্থ পর্ব)

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!