সমকালীন পাঠ প্রতিক্রিয়া
সমকালীন পাঠ প্রতিক্রিয়া
তাহমিনা খাতুন
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ প্রথম আলো সহ বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত ব্যতিক্রম ধর্মী একটি খবর অনেকেরই বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। খবরের শিরোনামটি ছিল এ রকম,
১০১টি প্রিয় বই দেনমোহরে বিয়ে করলেন নিখিল সান্ত্বনা।
খবরটিতে উল্লেখ ছিল,
‘বিয়েতে দেনমোহর টাকা বা স্বর্নালংকার নয়, প্রেমিকা চেয়েছেন তার প্রিয় ১০১টি বই।’ প্রেমিক কবি নিখিল নওশাদ ও তার প্রেমিকা সান্ত্বনা খাতুনের ধরিয়ে দেওয়া ১০১টি বইয়ের মধ্যে ৭০টি বই সংগ্রহ করতে পেরেছেন! শুক্রবার সন্ধ্যায় সেই ১০টি বই নগদ হিসেবে এবং বাকি ৯১ টি বই বাকি হিসাবে দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে এই প্রেমিক যুগলের।’
এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ অক্টোবর ২০২২ দৈনিক প্রথম আলোর আরও একটি খবর, নিশ্চয় অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। খবরটি হল,
“বগুড়ার তরুণ নিখিল নওশাদ ও শিক্ষক সান্ত্বনা খাতুন দম্পতির বিয়ের কাবিন নামায় দেনমোহর ধার্য করা হয়েছিল ১০১টি বই। এবার বগুড়ার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন পত্রে স্থান পেয়েছে বিষয়টি। গত রোববার বাংলা প্রথম পত্র বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ বিষয়ে বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোছা. রাবেয়া খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেনমোহর হিসেবে ১০১টি বই নেওয়ার বিষয়টি খুব আলোচিত হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি ও বই পড়ার গুরুত্ব বোঝাতেই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন পত্র তৈরী করা হয়েছে।”
আরও প্রবন্ধ সমকালীন ভাবনা
বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক ফারহানা আফরোজ প্রশ্নপত্রটি তৈরি করেন। প্রশ্নপত্রে নওশাদ সান্ত্বনাকে নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে বাংলায় একটি অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়া হয়। লেখাটি হুবহু এমন ছিল,
‘নিখিল নওশাদ বিয়ে করেন স্কুল শিক্ষক সান্ত্বনা খাতুনকে। তাদের বিয়ের দেনমোহর হিসাবে টাকা বা সোনা দানা নয়, ছিল ১০১টি বই। কনে সান্ত্বনা খাতুন মনে করেন অন্য সম্পদ ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু বই পড়ে যে জ্ঞান অর্জন করা যায়, তা কখনও হারিয়ে যাবে না। কনে সান্ত্বনা খাতুন বলেন, সোনা দানা টাকা কড়ি আমার কাছে মূল্যহীন। বই আমার কাছে অমূল্য সম্পদ।”
এরপর ১০ নম্বরের চারটি সৃজনশীল প্রশ্ন দেওয়া হয়:
(ক) মনের দাবি রক্ষা না করলে কি বাঁচে না?
(খ) সাহিত্য চর্চাকে শিক্ষার সর্ব প্রথম অঙ্গ বলা হয় কেন?
(গ) কনে সান্ত্বনার মানসিকতায় বই পড়া প্রবন্ধের যে দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে- তা ব্যাখ্যা কর।
(ঘ) সোনা দানা টাকা পয়সা নয়-বই হলো অমূল্য সম্পদ- মন্তব্যটি ‘বই পড়া’ প্রবন্ধের আলোকে বিশ্লেষণ কর।
উপরোক্ত ঘটনাটি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আমাদেরকে ভাবায়। বর্তমানে আমরা এমন একটা অস্থির সময় পার করছি, যেখানে বই পড়ার বিষয়টি দিন দিন অপাংক্তেয় হয়ে যাচ্ছে! সান্ত্বনা খাতুনদের মতো মানুষদের সংখ্যা দিন দিনই কমছে! বই হাতে মানুষ-এখন বলতে গেলে কদাচিত চোখে পড়ে। বই পড়ে সময় নষ্ট না করে মানুষ এখন ইন্টারনেটে ফেসবুক বা অন্য কোন মাধ্যমে বিনোদন খু্ঁজতেই বেশি পছন্দ করেন অথবা ই-বুকে বই পড়ার কাজটি সেরে নেন।
আরও পড়ুন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা
বিষয়টি কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার বর্তমান সময়ে এটি একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু সান্ত্বনা খাতুনের মানসিক সৌন্দর্য আমাদেরকে বিস্ময়াভিভূত ও চমৎকৃত করে। কারন সমগ্র বিশ্ব যখন অর্থ কড়ি, সোনা-দানার মতো বৈষয়িক বিষয়ের পিছনে ধাবিত, সেই সময়ে সান্ত্বনা খাতুন তাঁর দেনমোহর হিসাবে জ্ঞানের ভান্ডার বইকে বেছে নেওয়ার বিষয়টি সত্যিই নজির বিহীন ঘটনা।
দেনমোহর মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং বাংলাদেশে রঅন্য কোন মুসলিম দেশের বিষয়টি আমার জানা নাই) ধনী, নির্ধন, উচ্চ শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর নির্বিশেষে যে কোন মেয়ের দেনমোহর নির্ধারনের ক্ষেত্রে বিয়ের দুই পক্ষের মধ্যে রীতিমত ‘দ্রব্য বেচা কেনার’ মতো দর কষাকষি চলে। এ ব্যাপারে উচ্চ শিক্ষিত বিয়ের কনেও একজন মুক অথবা বধির মানুষের ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে বিয়ের ক্ষেত্রে এই যখন পরিচিত দৃশ্য, সেখানে সান্ত্বনা খাতুনের আধুনিক মানসিকতা বাংলাদেশের মেয়েদের ভাবনার জগতে একটু হলেও নাড়া দিবে বলে আমরা আশা করছি। এর আগেও নাম মাত্র আর্থিক মূল্য দেনমোহরে বিয়ে সংঘটিত হওয়ার উদাহরণ আছে। কিন্তু দেনমোহর হিসাবে বই দাবি করা- মনে হয় এই প্রথম।
এবারে আসা যাক বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন ও শিক্ষক ফারহানা আফরোজের আধুনিক এবং ব্যতিক্রমধর্মী মানসিকতার। ফারহানা আফরোজ বিষয়টি নিয়ে তাঁর শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগতে এবং তাদের মানসিকতায় একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছেন। এমন চমৎকার এবং অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়ে শিক্ষক ফারহানা আফরোজ অভিনন্দন যোগ্য হয়েছেন, আবার ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এমন একটা প্রশ্ন পত্র তৈরীর অনুমোদন দিয়ে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
আজকের বাংলাদেশে যেখানে প্রতিক্রিয়াশীলদের দৌরাত্ম সীমা ছাড়িয়ে গেছে, সেখানে প্রতিক্রিয়াশীলদের ভ্রকুটি উপেক্ষা করে এমন একটা বিষয়কে সামনে আনার চেষ্টা একটু ব্যতিক্রমী ঘটনাই বটে।
আরও পড়ুন ভাষা নিয়ে ভাবনা
প্রথম আলোর আরও একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, নিখিল নওশাদ একজন কবি এবং তিনি নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করেন। এ ছাড়া তিনি বগুড়া থেকে ‘ বিরোধ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ২০১৪ সালে একটি ছোট কাগজে নিখিলের একটি কবিতা ছাপা হলে একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়! চার মাস কারাবাসের পর তিনি মুক্তি পান এবং ২০১৯ সালে মামলার রায়ে আদালত তাঁকে খালাস দেন।
সব।শেষে জ্ঞান পিপাসু, বৈষয়িক বিষয়ে অনাগ্রহী সান্তনা খাতুনের প্রতি রইল অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং এই নতুন দম্পতির প্রতি রইল শুভেচছা।
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
সমকালীন পাঠ প্রতিক্রিয়া