শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
তাহমিনা খাতুন
কিছুদিন আগে আমার স্কুল জীবনের প্রথম শিক্ষক জনাব নূরুল ইসলামের মৃত্যু সংবাদ পেলাম। প্রথম যেদিন আমার গ্রাম দ্বারিয়াপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে ক্লাস করতে গিয়েছিলাম, হয়তো বছর চারেক বয়স হবে, জনাব নুরুল ইসলাম আমাকে ডেকে কাছে বসিয়ে একটা ছড়া পড়ে শুনিয়েছিলেন। ছড়াটি এত বছর পরেও স্পষ্ট মনে আছে,
এক যে ছিল ময়না,
কত যে তার গয় না,
আসমার কিছু দেয় না!
আসমা আমার ডাক নাম। পরবর্তীতে শিক্ষক নূরুল ইসলাম সাহেব বৈবাহিক সূত্রে আমার ঘনিষ্ট আত্মীয় হয়েছিলেন। তিনি আমার আপন চাচাতো বোন লিলিকে বিয়ে করেছিলেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রায় সবার কথাই আমার মনে আছে! আমি যখন শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হই, ঐ সময় দ্বারিয়াপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রদ্ধেয় জনাব ইসমাইল হোসেন। ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট তিনি ছিলেন অসম্ভব প্রিয় একজন শিক্ষক। দ্বারিয়াপুরের স্থানীয় একজন শিক্ষক তাঁকে স্কুল থেকে অপসারণ করে নিজে প্রধান শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত সফল হন। ইসমাইল হোসেন স্যার অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নেন। ছাত্র-ছাত্রীরা স্যারের মায়ায় কেঁদে ভাসায়। আমি তখন হয়তো খুব বেশী হলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ি! তবু ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে।
আরও পড়ুন মাওলানা শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ
পরদিন স্কুলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্ররা এসে আমাদের বললেন, যেহেতু সবার প্রিয় প্রধান শিক্ষক ইসমাইল হোসেনকে নতুন প্রধান শিক্ষক ষড়যন্ত্রমূলকভাবে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করেছেন, সেহেতু বিষয়টিকে বিনা প্রতিবাদে ছেড়ে দেয়া হবে না। এ কারণে নতুন প্রধান শিক্ষক যখন স্কুলে প্রবেশ করবেন, প্রতিবাদে সব ছাত্র-ছাত্রী ক্লাস ত্যাগ করে স্কুল মাঠে বেরিয়ে যাবে। যে কথা, সেই কাজ! নতুন প্রধান শিক্ষক স্কুলে ঢোকার সাথে সাথে আমরা স্কুলের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী স্কুল ঘর ছেড়ে খেলার মাঠে বেড়িয়ে গেলাম! এরপর আমাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কিনা-মনে নাই।
ঐ সময়ে অনেক বয়স্ক একজন শিক্ষক ছিলেন। নাম সম্ভতও ছিল আফতাব হোসেন। অসম্ভব রাগী ছিলেন তিনি। রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন! সম্ভবত অংকের শিক্ষক ছিলেন। একদিনের কথা মনে আছে। তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্র অংকের সমাধান করতে না পারায়; একটা গাছের চিকন ডাল দিয়ে এমন নিষ্ঠুরভাবে মারতে শুরু করলেন যে ডালটি ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেল। স্কুলের পাশের ঝোপ থেকে নতুন আরেকটি ডাল ভেঙে আনতে গেলে ঐ ছাত্র দৌড়ে ক্লাস থেকে পালিয়ে গেল। পরে ভীত ছাত্রটি কয়েকদিন আর ক্লাসেই আসে নাই।
জয়নাল আবেদীন নামে আর একজন অংকের শিক্ষকও ছিলেন প্রচন্ড রাগী। তিনিও চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রদের অংক না পারলেই প্রচণ্ড মার দিতেন এবং বাজে ভাবে গালাগাল করতেন! শিক্ষার্থীদের প্রহার করা তখন অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার ছিল। প্রহার ছাড়াও আরও কিছু শাস্তি দেওয়া হতো। যেমন পড়া না পারলে দাঁড় করিয়ে রাখা, বেঞ্চের উপর বা ক্লাসের মধ্যে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা, দুই কান ধরে দাঁড় করানো, নীল ডাউন বা বেঞ্চের নীচে মাথা দিয়ে থাকতে বাধ্য করা সহ আরো কত ধরনের শাস্তি! উচ্চ আদালতের রায়ে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান নিষিদ্ধ করা হলেও মাঝে মাঝেই শিক্ষার্থীদের উপর অমানবিক আচরণের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়!
আরও পড়ুন মাওলানা রইচ উদ্দিন
শমশের হোসেন নামে একজন শান্ত প্রকৃতির শিক্ষক ছিলেন। প্রাইমারী ছাড়ার বহু বছর পরে ১৯৭১ সালে, সৈয়দপুর থেকে পাক সেনাদের ভয়ে মাঠ ধরে পালানোর সময় সমশের স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল। এর পর আর কখনো স্যারের সঙ্গে দেখা হয়নি। আব্দুর রশিদ নামে একজন শিক্ষকের বাড়ি ছিল বেশ দূরের কোন গ্রামে। তিনি আমাদের গ্রামের এক বাড়িতে ‘লজিং’ থাকতেন। রশীদ স্যার স্কুলে যোগদান করার পরে শিক্ষকদের সম্বোধন করার ক্ষেত্রে নতুন এবং সঠিক নিয়ম করলেন, আর তা হল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিক্ষকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে হবে। রশীদ স্যার স্কুলে যোগদান করার আগে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ‘মাস্টার সাহেব’ বলে সম্বোধন করত! কি হাস্যকর ব্যাপার! রশীদ স্যার সঠিক নিয়মটি করে দেওয়ার পর থেকে আমরা শিক্ষকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করি।
রশীদ স্যারের নিকট আমরা কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী প্রতিদিন সকালে স্কুল শুরুর আগে নিয়মিত অংক শিখতে যেতাম। স্যার কোন ‘সন্মানী’ ছাড়াই আমাদের পড়া বুঝিয়ে দিতেন এবং কখনও বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। একই ভাবে দুলাই হাই স্কুলের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আলী শের খান সাহেবের কথাও বলতে হয়। স্কুল ছুটির পর প্রায় দিনই ইংরেজি বিষয়ের পড়া বোঝার জন্য স্যারের শরণাপন্ন হতাম। স্যার কোন দিনও বিরক্ত হননি কিংবা সন্মানী দিতে বলেন নি।
দুলাই হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন প্রধান শিক্ষক জনাব গোলাম রসুল। নারী শিক্ষায় উৎসাহী জনাব গোলাম রসুল স্কুল প্রতিষ্ঠার পরই ‘দুলাই বয়েজ হাইস্কুলে’ ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই ছাত্রীদের ভর্তির সুযোগ অবারিত করে দেন। ফলে বেশ কিছু মেয়ের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগোম হয়ে যায়।
আরও পড়ুন শিক্ষাবিদ ও লোকসাহিত্য গবেষক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন
দুলাই হাই স্কুলের শিক্ষক বাবু হরিপদ স্যারের কথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে মনে। স্যার স্কুলে ইংরেজি গ্রামার পড়াতেন। এত চমৎকার ভাবে পড়া বুঝিয়ে দিতেন যে ভোলার সুযোগ ছিল না! স্কুল ছাড়ার কয়েক বছর পরেই স্যার চির বিদায় নেন! স্যারের সাথে আর কখনো দেখা হয়নি! দুলাই হাইস্কুলের স্যারদের মধ্যে আরও ছিলেন শ্রদ্ধেয় জনাব আব্দুল গফুর, আব্দুল জব্বার, আবুল হাসান।
আমাদের শিক্ষাগ্রহণ কালীন সময়ের আদর্শবান শিক্ষকেরা শিক্ষাদানকেই মর্যাদা দিতেন, অর্থপ্রাপ্তিকে নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষকের আত্মমর্যাদা বোধের স্থানটি প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষা প্রদানের নামে ‘কোচিং’ বাণিজ্য এবং তা থেকে যে অর্থ প্রাপ্তির কথা শোনা যায়, তা রীতিমত লজ্জাজনক। শুনতে পাই শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টারে উপস্থিত না থাকলেও সমস্যা নাই, মাস শেষে টাকার খামটি শিক্ষকের হাতে পৌঁছালে পরীক্ষার ফলাফলে তার প্রভাব পড়বেই!!
দুলাই হাইস্কুল ছাড়ার দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পর আলী শের খান স্যারের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। আমার সৌভাগ্য এমন নির্লোভ, শিক্ষানুরাগী, কয়েকজন শিক্ষকের নিকট শিক্ষালাভের সুযোগ হয়েছিল!
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মধ্যে আরও দুজন শিক্ষকের কথা মনে থাকবে সব সময়। একজন হলেন সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রী কলেজের বাংলা শিক্ষক মাসুদ স্যার এবং আরেক জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক জহুরুল ইসলাম চৌধুরী। জহুরুল ইসলাম চৌধুরী ‘মুসলিম ল’ পড়াতেন। এত চমৎকার ভাবে বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করতেন যে শুনলেই মনে গেঁথে যেত! দুঃখজনক হলো স্যার শিক্ষকতা থেকে অবসরে যাওয়ার বেশ কয়েক বছর আগেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।
মাসুদ স্যার কলেজে বাংলা পড়াতেন। খুব সুন্দর ছিল তাঁর উপস্থাপনা। কলেজ ছাড়ার অনেক বছর পর সিদ্বেশ্বরী ডিগ্রী কলেজে ‘মহিলা আইনজীবী সমিতির’ পক্ষ থেকে আইন সচেতনতা মূলক একটি ‘সেসন’ পরিচালনা করতে গিয়ে স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল। স্যার এখন কোথায়, কেমন আছেন জানা নাই। যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন শ্রদ্ধেয় মাসুদ স্যার এবং আমার প্রিয় অন্যান্য শিক্ষকগণ।
আরও পড়ুন যাপিত জীবনের কথকতা-
দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আত্রাই নদী
আমার বাবা
আমার মা
ভাই-বোনদের কথা
আমার শিক্ষাজীবন
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো
যেভাবে আইনজীবী হলাম
সংসার ও আইনজীবী জীবন
পাশের বাড়ির আপনজন
আমার নানী
প্রথম শহর দেখা ও প্রথম বিদেশ ভ্রমণ
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
ছেলেবেলার ষড়ঋতু
মধুর স্মৃতি
স্নেহশীল কজন
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ