শেষ বিকেলের ঝরা ফুল (২য় পর্ব)
শেষ বিকেলের ঝরা ফুল (২য় পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
সুজিত রায়হান আশ্চর্য হয়ে শুনে যাচ্ছে সেই উনিশ বছর বয়সি চঞ্চল মেধাবী তরুণীকে। তার ইচ্ছের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ডির্ভোস দিয়েছিল। আজ তার এই পরিণতি কেন। সে যদি নিজে না বলে তবে বলার অনুরোধ করবে না। কারণ এটা তার একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। হয়তো ফাহিমিদা ফাহি মনে করবে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে। তাকে অপেক্ষা করতে হলো না। ফাহি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
– যদি অনুমতি দেন, বলতে চাই। আপনাকে বলে শেষ বেলায় যদি কিছুটা শান্তি পাই। যদিও আপনার সঙ্গে শুধুই বিয়ে হয়েছিল কিন্তু কোনো দৈহিক মিলন হয়নি। আমাদের সমাজে বিয়ে স্বামী-স্ত্রীর একটা গভীর বন্ধন। আবার দ্বিতীয়বার বিয়ে করে আমাকে অনেক কাফফারা দিতে হয়েছিল। সেই ইতিহাস বলতে চাই।
– বেশ, বলুন।
সুজিত কেন যেন ফাহির প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে। তবে এটা সত্য, ফাহিকে তার খুব পছন্দ ছিল এবং এখনো আছে। ততক্ষণে কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সুজিত উঠে গিয়ে দু’মগ কফি অর্ডার দিয়ে এলেন।
— বলতে লজ্জা নেই। অপরিণামদর্শী এক যুবতীর জীবনে এমন ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে, আগে বুঝতে পারেনি। আমার মতামত সেইদিন বাড়ির কেউ সর্মথন করেনি। কিন্তু আমার জেদের কাছে পরিবারের সবাই পরাজিত হয়েছিল। এইচএসসি পাশের পর বিএ ভর্তি হলাম। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম বটে পরিবারের সাথে অনেক যুদ্ধ করে। এটা ঠিক আমাদের পরিবারের মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সহজেই কেউ হাত বাড়ায় না। আমি নাছোরবান্দা। বিএ পাশ করার পর একটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরি পেয়েছিলাম। দু’বছর চাকুরি করে বেশ টাকা জমিয়েছিলাম। সেই ভরসায় ভর্তি হলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিষয়ে। দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে সমাপ্ত হলো শিক্ষাজীবন। বয়স তখন আটাশ পার হয়ে উনত্রিশ। কেউ বিয়ের কথা বলে সাহস পায় না।
আরও পড়ুন গল্প আলতা বানু
জীবনে একটা ঘটনা ঘটিয়েছি; তাই এ পথে কেউ হাঁটতে চায়নি। কারণ এমএ পাশ করা বয়সি মেয়ের পাত্র তাদের খোঁজে নেই। জানেন তো, সমাজের মানুষ ডিভোর্সি মেয়েদের অন্য চোখে দেখে। কিন্তু পুরুষের বেলায় সাত খুন মাফ। তাকায় সুজিতের দিকে। সুজিত মনে মনে হাসে। ফাহির ধারণা সুজিত দ্বিতীয় বার বিয়ে করে সংসারি হয়েছে। কফি তখন গরম আছে। লম্বা একটা চুমুক দিয়ে ফাহি তার নিজের কথায় ফিরে আসে।
– আমার এক দূর সম্পর্কের ভগ্নিপতি যিনি একটা মাদ্রাসার শিক্ষক। ঘটকালি করে থাকেন। তিনি এক পাত্রের সন্ধান দিলেন। তাদেরকে বিস্তারিত জানানো হলো। সত্যটা জেনে যদি রাজি হয়, তাহলে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে। পাত্র পক্ষকে আরও অবগত করা হলো পাত্রী ডিভোর্সি, বয়স্ক এবং উচ্চ শিক্ষিত। আমাদের দেশে বিশ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময়। বেশি বয়সি মেয়েদের পাত্র পাওয়া যায় না। যা দু’একটি পাওয়া যায় হয়তো যাদের স্ত্রী মারা গেছে কিংবা যে-কোনো কারণেই হোক ছাড়াছাড়ি হয়েছে। পাত্রের বয়স চল্লিশের ওপরে। বিএ পাশের পর দীর্ঘদিন মিডিল-ইস্টে চাকুরি করে দেশে ফিরে ছোটো ভাইদের নিয়ে ব্যবসা করছেন। শহরে চারকাঠার উপর তিন তলা বাড়ি আছে। তিন ভাই- দু’বোন এবং বিধবা মা নিয়ে তাদের সংসার।
মানুষের জীবনে সবকিছু হয় না। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। চারদিকে অন্ধকার। আচ্ছা, আপনি কী আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন?
– এ কথা কেন মনে হলো আপনার?
– আপনাকে বিনা কারণে অন্যায়ভাবে ডির্ভোস দেওয়াতে।
– না, আমি তা মনে করিনি। একজন মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকতে পারে এবং তার ভালোমন্দ বোঝার জ্ঞান আছে।
ফাহি এক দৃষ্টিতে সুজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে অজান্তে চোখের পানি ছেড়ে দিল।
আরও পড়ুন গল্প চোখের আলোয় দেখেছিলেম
– তাহলে এটাই আমার ভাগ্যে লেখা ছিল। অবশেষে বিয়ের মত দিলাম। বিয়ে হয়ে গেল। স্বামীর পরিবারের কাছে বিয়ের আগে বলা হয়েছিল, বিয়ের পর সে একটা মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করতে চায়। তারা না-কি বলেছিল অসুবিধা হবে না। বড়ো আশা করে স্বামীর বাড়িতে গেলাম। এই প্রথম স্বামীকে ভালো করে দেখে নিলাম। আসলে বয়স চল্লিশ তো হবেই। মাথা ভর্তি পাকা-কাঁচা ছোটো চুল। স্টাইল করে দাড়ি ছাঁটা। বিশেষ ধরনের নক্স করা টুপি পরিহিত। চেহারা দেখে আমার মনে হয়েছিল চেহারায় এবং চোখের ভেতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। এটাও মনে হয়েছিল ভদ্রলোক স্বল্পভাষী। তবে ভেতরে ছিল চাপা ক্রোধ। শুধু তাই নয়, এক রোঁখা চরিত্রের মানুষ। পরবর্তীতে আমার অনুমান সঠিক হয়েছিল।
যাহোক, স্মামীর বাড়িতে ঢুকেই বুঝতে পেরেছিলাম একটা জেলখানায় বন্দি হলাম। কে যেন সব পুরুষ মানুষগুলোর ভেতরে যেতে বলল। তিন/চার জন মহিলা এসে গাড়ি হতে নামিয়ে আমাকে দোতলার একটা রুমে নিয়ে গেলেন। রুমটা বেশ বড়ো। এক পাশে সাদা চাদরে আবৃত একটা খাট। রুমের সারা মেঝে কার্পেট বিছানো, তার ওপরে সাদা কাপড়। মনে হলো কোনো পিরের আস্তানা। খাটের একপাশে একটা ইজি চেয়ার এবং চেয়ারের পাশে জায়নামাজ পাতা। ছোটো একটা বুকসেলফে কিছু ধর্মীয় বই। ষাটোর্ধ্ব সাদা বোরকা পরিহিতা একজন মহিলা হাত ধরে আমাকে ভেতরে নিয়ে খাটের ওপর বসালেন।
একগ্লাস ফলের শরবত হাতে দিয়ে বললেন, “বিসমিল্লাহ বলে শরবতটা খেয়ে নাও।”
তার আদেশ পালনের পর পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষায় আছি।
“আমি তোমার শাশুড়ি আম্মা। শুনেছি তুমি বাংলা লাইনে এমএ পাশ। মনে রাখবে আমরা মুসলিম ঘরের সন্তান। তাছাড়া তুমি একজন মুসলিম মহিলা। বিবাহিত মুসলিম মহিলা হিসেবে আমার সংসারে চাকুরির করার কোনো সুযোগ নেই। পর্দাশীল এবং ইসলামিক ধারায় জীবনযাপন করতে হবে। একজন স্ত্রী হিসেবে স্বামীকে খুশি এবং তার আদেশ মান্য করা কর্তব্য এবং তা মেনে চলতে হবে। আজ এ পর্যন্ত, আগামীকাল আরও অনেক কথা হবে এবং আরও কিছু জানতে পারবে।”
আরও পড়ুন গল্প প্রিয়তমার লাল চোখ
আগের সেই মহিলারা ঘরে ঢুকে আমার হাত ধরে ঘরে বাইরে নিয়ে এলো। দুটো রুমের পর অন্য একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ভেতরে ঢুকতেই দেখি রুমটা মোটামুটি গোছানো। তবে বাসরঘর যেভাবে সাজানো হয়ে থাকে সেভাবে সাজানো হয়নি। দামি আতরের সুগন্ধিতে রুমটা ভরে উঠেছে। ইতোমধ্যে মহিলা চারজন সালাম দিয়ে রুম হতে বের হয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে ভাবছি কী করা যায়। খাটে গিয়ে বসবো কি না। কতটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না।
হঠাৎ “আসসালামু আলাইকুম”, বলে আমার স্বামী ঘরে ঢুকলেন। খাটের উপর বসতে বলে একটা আলমারি খুলে কী যেন বের করে আমার পাশে বসলেন। আমার অনুমতি নিয়ে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলীতে একটা আংটি পরিয়ে দিলেন। কোনো ভণিতা না করে সরাসরি বললেন, “এ বাড়ির কর্তী আমার আম্মাজান। তার আদেশের বাইরে আমরা কিছুই করি না। আশা করি আপনি সেভাবে চলবেন। আপনি যতক্ষণ আমাকে ‘তুমি’ বলার সুযোগ দিবেন না ততক্ষণ এভাবে চলবে।”
আমার শাশুড়ি আম্মা এবং স্বামীর কথায় বুঝতে বাকি রইল না আমি কোথায় এসেছি। আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা বলতে আর কিছু নেই। সুতরাং নিচু কণ্ঠে, জি বললাম।
‘শুকুরিয়া’ বলে আমাকে বিশ্রাম নিতে বলে বিয়ের পোশাক বদলাতে উঠে পাশে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, “নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হবে। ইতোমধ্যে আম্মাজান কিছু বলেছেন এবং আরও বলবেন। নিশ্চয় জেনেছেন আমরা তিনভাই দু’বোন। বোন দুটোর আঠার বছর বয়স হতেই বিয়ে দিয়েছেন আম্মাজান। দু’ভাই অবিবাহিত। শ্রীঘই বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। আমার মতো আইবুড়ো বয়সে বিয়ে না করাই ভালো। শুধু আম্মাজানের হুমুক পালন করেছি।”
আরও পড়ুন গল্প নিরূপায় নীলাঞ্জনা
এই পর্যন্ত বলে একটু থেমে যে কথাগুলো বললেন, তা শুনে আমার মতো একজন শিক্ষিত মহিলার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। মাথার ভেতরে ঘুর্ণিঝড় বয়ে গেল। মনে পড়ে গেল বেগম রোকেয়ার সেই বিখ্যাত প্রবন্ধ অবরোধবাসিনী। একশত বছর আগে নির্যাতিত ঘরে বন্দি নারীদের করুণ কাহিনি আজ আমার জীবনে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস হারিয়ে ফেলেছি; আমি ডিভোর্সি নারী। দেখতে পাচ্ছি সামনে ঘোর অন্ধকার।
“শুনে রাখুন, একজন স্ত্রীর কর্তব্য তার স্বামীকে সবর্দা খুশি রাখা। স্বামীর চাহিদা মোতাবেক সেটা পূরণ করা। স্বামীর কাছে স্ত্রীর দেহ একখণ্ড জমির মতো। সেই কর্ষিত জমিতে আমার বংশধর জন্মগ্রহণ করবে।”
বাসরঘরে আমার স্বামী বিড়াল মেরে স্বামীত্ব জাহির করলেন। পরে দিন রাতে বুঝতে পেরেছিলাম জমি কীভাবে কর্ষণ করতে হয়। দশ বছরে তিন ছেলে এবং এক মেয়ে আমার দেহ জমিতে উৎপাদিত হয়েছিল। এখন তারা বিবাহিত এবং সংসারী। বিবাহিত জীবন প্রায় ত্রিশ বছর পর আবার বিচ্ছেদ হলাম মানে হতে বাধ্য করা হলো। আমিও সবকিছু মেনে বিচ্ছেদ হতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভাইবোনরা জোর আপত্তি তুলেছিল। কারণ তাদের ঘাড়ে চেপে বসি এই ভেবে। তাদের আশ্বাস দিয়েছিলাম এই বলে যে, পৈতৃক সম্পদের ন্যায্য ভাগটা দিলে তাদের ঘাড়ে চাপবে না। তারা তাতেই রাজি হয়েছিল। প্রায় দশ লক্ষ টাকা পেয়েছিলাম। স্বামী কিছু অর্থ দিতে চেয়েছিল তা গ্রহণ করিনি। সেই দশ লক্ষ টাকা দিয়ে গড়ে তুললাম এনজিও। সমাজকর্ম নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তাই কাজে লাগাতে চাই শেষ বয়সে। আমার মতো আরও ক’জন অসহায় স্বামী-সংসার ছাড়া এবং নির্যাতিত বিধবা আমাদের আশ্রয় দিলাম এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলো। কঠোর পরিশ্রম করে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি।
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
শেষ বিকেলের ঝরা ফুল (২য় পর্ব)