শেষ-বিকেলের-ঝরা-ফুল-১ম-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

শেষ বিকেলের ঝরা ফুল (১ম পর্ব)

শেষ বিকেলের ঝরা ফুল (১ম পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল

এই মাত্র ফাল্গুনের শেষ বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। রাজধানী শহর ঢাকার বাইরে গাজীপুরে অবস্থিত একটা দামি রিসোর্টে আয়োজিত একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছেন সুজিত রায়হান। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাপরিচালক। বলতে গেলে পঁচিশ বছর চাকুরি মেয়াদ শেষ হতেই স্বইচ্ছায় অবসরে গিয়েছেন। যোগ দিয়েছেন একটা খ্যাতমানা আন্তর্জাতিক এনজিওতে। একটু নিরিবিলি এবং একাকি থাকতে পছন্দ করেন। জীবনকে একটা নিয়মে বেঁধে নিয়েছেন। শখ বইপড়া এবং ভ্রমণ। নিজ জন্মভূমিতে কোথায় কী আছে তা দেখে বেড়ানো আর বইপড়া। নতুন লেখকদের বই পড়তে বেশি আগ্রহী।
একটু আগে অতিথিদের সাথে খাওয়া শেষ করেছেন। খাওয়া শেয হতেই হঠাৎ ঝড় সাথে বৃষ্টি। আধঘণ্টায় ঝড়-বৃষ্টির অবসান। কিন্তু এই আধঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন এলাকা। ইদানীং ঝড় আসার আভাস পেলেই বিদ্যুৎ কোম্পানির কর্মীগণ দুর্ঘটনা ঘটার অজুহাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাখে। তবে আজকে বেশি সময় ব্যয় করেনি সচেতন বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ।

আয়োজক ফয়সাল আরেফিন, তিনিও আন্তর্জাতিক খ্যাতি একটি এনজিও-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর। এই সুবাদে পরিচয়। বলতে গেলে এখন অন্তরঙ্গ বন্ধু। সুজিত রায়হা, বন্ধু আরেফিনের অতিথি। আরও নামিদামি অতিথি এসেছেন। তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ আয়োজন। এই বিশেষ আয়োজনে সুজিত যোগদান না করে বাকি সময়টা একাকি কাটাতে চান। রিসোর্টের তিনতলা দক্ষিণ পাশে লম্বা ব্যালকনি বেশ নিরিবিলি। বসার জায়গা চমৎকার। ওয়েটারকে ডেকে বড়ো এক মগ কফি দিতে বলে তিন তলায় চলে গেলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওয়েটার এক কাপ কফি সুজিতের সামনে রেখে, আরও কিছু প্রয়োজন আছে কি-না জানতে চাইল। সুজিত মাথা নেড়ে না সংকেত দিলেন।

আরও পড়ুন গল্প কাকভোর

জায়গাটা বেশ মনোরম; পছন্দ হয়েছে সুজিতের। যদিও আরও কিছু আসন আছে, তবে একটু দূরে। কর্নারে দুজন বসার মতো একটা টেবিলে দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসেছেন। সামনে বৃষ্টি ভেজা দেবদারু গাছ। পাতা ঝরে এখনো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ছে। দারুণ লাগছে। পড়ন্ত বিকেলের শেষ ফাল্গুন। ঠান্ডার আমেজ। মন্দ লাগছে না। কফির মগ মুখে ধরে গরম কফিতে একটা চুমুক দিয়ে মগ টেবিলের ওপর রেখে দেবদারু গাছের দিকে তাকিয়ে নিমিষে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। গরম কফির ধুঁয়া বাতাসে উড়েছে।

তিন তলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে আর একজন সম্মানিত আমন্ত্রিত অতিথি। তিনিও একটি এনজিও-এর কর্মকর্তা। বলতে গেলে অধিকাংশ অতিথি এনজিও কর্মকর্তা। আরেফিনের এই আয়োজনের একটা উদ্দেশ্য আছে; এটা মোটামুটি সবাই বুঝে নিয়েছেন। তিন তলায় উঠতেই চোখ পড়ে দক্ষিণ পাশের ব্যালকনিতে। পছন্দ হয় তার। তিনি ওয়েটারকে ডেকে এক মগ কফি দিতে বলে ব্যালকনির ভেতরে পা রাখতেই থমকে দাঁড়িয়ে যান। চোখে পড়ে ব্যাললকনির শেষের মাথায় একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। মাথা ভর্তি আধা কাঁচাপাকা চুল। ভদ্রলোক গভীরভাবে কী যেন ভাবছেন। হয়তো কবি-সাহিত্যিক হতে পারেন কিন্তু চেহারাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। ভেতরে ঢুকবে কী ঢুকবে না দ্বিধায় পড়ে যায়। ইতোমধ্যে ওয়েটার ট্রেতে কফি এনে হাজির। একটা টেবিল দেখিয়ে সেখানে রেখে চলে যেতে বললেন। আরও একটু ভেতরে ঢুকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ, এবার পরিষ্কারভাবে ভদ্রলোকের মুখমন্ডল চোখে পড়ে। চমকে উঠেন, এ কি করে সম্ভব! এখানে এই পরিবেশে।

আরও পড়ুন লেখকের মুক্তিযুদ্ধ

ফিরে যায় আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। নিজের একরোখা জেদের পরিণতি কী হতে পারে; তার প্রায়শ্চিত্ত প্রতিক্ষণে মাশুল দিতে হচ্ছে। একটুও চিনতে ভুল হলো না সুজিত রায়হানকে।
চল্লিশ বছর আগে জেলা সমাজকল্যাণ অফিসার ছিলেন। বড়ো ভাইয়ের সাথে বাসায় আসতেন। তখন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। পড়াশোনায় বেশ ভালোই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বড়ো সাধ। সুজিত রায়হান ভালো ছেলে মানে যোগ্যপাত্র। সরকারি চাকুরি। আরও উন্নতি হবে জীবনে। জেলা শহর হতে বিভাগীয় পর্যায়ে চলে যাবে। সবেমাত্র পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বিয়ের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে বলা হলো।

দেখতে অপছন্দ হবে না। যে-কোনো পুরুষের চোখে পড়ার মতো। নিটোল স্বাস্থ্য এবং দৈহিক বিবেচনায় বিয়ের উপযুক্ত পাত্রী । কিন্তু বয়স মাত্র উনিশ। আর পাত্রের বয়স ছাব্বিশ সাতাশ তো হবেই। কথায় আছে না সোনার আংটি বাঁকাও ভালো। পাত্র সাত-আট বছরে বড়ো এটা কোনো বিষয় নয়, যোগ্যতা কতটুকু সেটাই মূল কথা।
ইতোমধ্যে বিয়ের কথাবার্তা দু’পক্ষের মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু তারিখ নির্ধারণ বাকি। এক বান্ধবীর কিছু পরামর্শ মনে ধরেছিল। বিয়ের পর পড়াশোনা করা যাবে কি-না এবং আর যেটা ছিল তা একটা পুরুষের পক্ষে মেনে নেওয়া একেবারে অসম্ভব। শেষটা ছিল বিএ পাশ না করা পর্যন্ত কোনো সন্তান গর্ভে ধারণ করবে না। সুজিতের সাথে বেশ কদিন এক সঙ্গে মেলামেশার পর প্রস্তাবটা দিয়েছিল। সুজিত এত বড়ো মনের মানুষ তা আগে কখনো ভাবতে পারেনি। ভাবতে থাকে বুদ্ধিমতী বা বুদ্ধিমান মানুষ কী একটু বেশি স্বার্থপর হয়ে থাকে। তার ক্ষেত্রে কী তাই হয়েছিল। না-কি বন্ধুদের ভুল পরামর্শে সারাজীবন খেসারত দিতে হচ্ছে। নিশ্চিত সুজিত রায়হান সংসারী হয়েছেন।

নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছিল বেশ ক’মাস। দেখিয়েছিল বিভিন্ন অজুহাত। একজন পরিণত পুরুষ মানুষ বিবাহিত জীবনে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক মিলন হতে বঞ্চিত হবে; এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় নিজের ইচ্ছায় ডির্ভোস নিয়েছিল। তারপর হতে আর দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।

আরও পড়ুন গল্প অন্তর্দাহ

বড়ো ভাইয়ের মুখে শুনেছিল বদলি হয়ে ঢাকায় চলে গেছেন সুজিত রায়হান। অতীতের সবকিছু ঝেড়ে ফেলে নতুনভাবে জীবনকে গড়ে তোলার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছিল। তবে সুজিত রায়হান একজন ভালো মনের মানুষ এতে সন্দেহ নেই। এখনো তার প্রতি রয়েছে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। শুধু নিজের ক্যারিয়ার তৈরির ক্ষেত্রে অপরিমাণদর্শী ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবনে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল। শেষ জীবনে বঞ্চিত মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
এত ঘটনার পর একজন সুস্থ এবং আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ সহজে কী মেনে নিবেন। দীর্ঘদিন পর আজ একটা সুযোগ পেয়েছে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার। যদি তাড়িয়ে দেন তাহলে কিছু করার নেই। নানান ধরনের কথা ভাবতে ভাবতে ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ফাহিমিদা ফাহি।

সুজিত রায়হান অনুভব করছেন কেউ যেন তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আলতো চোখ মিলে তাকায় আগন্তুকের দিকে। একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে সুজিত। এটা কি করে সম্ভব! ঊনিশ বছর বয়সি যুবতীকে বিয়ে করেছিলেন, এরপর বিচ্ছেদ। সেই ফাহিমিদা ফাহি। সুশ্রী সুদর্শনা চেহারা এ রকম হাল হয়েছে কেন। কী ঘটেছে। ফাহি ভুল করে তার সামনে দাঁড়ায়নি তো।
তখন সে ছিল অনেকটাই মানসিকভাবে অযোগ্য। সাধারণ মধ্যমশ্রেণির ঘরের সন্তান কিন্তু উচ্চালোভী;, যা আমাদের সমাজে হয়ে থাকে। বিশেষ করে মধ্যমশ্রেণির ঘরের মানুষ উপরে উঠার জন্য আপ্রাণে চেষ্টা করে। সবাই সফল হয় না, কেউ কেউ হন। সুজিত রায়হানের মনের বাসনা ছিল ফাহিকে তার ইচ্ছে পূরণে সহযোগিতা কররে। কিন্তু ফাহির একঘেঁয়েমির কারণে তা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত ফাহির ইচ্ছেকে মূল্য দিয়েছিল। কিন্তু আজ এখানে এই অবস্থায় আবার তার সামনে, কেন।

আরও পড়ুন গল্প গয়নার নৌকা

কেনোর উত্তর তো ফাহি দিবেন। না, তাকে অপমান করে ফিরিয়ে দিবেন না। মানুষ মাত্রই ভুল করে। ভুল হতে শিক্ষা নিয়ে তারপর হয়তো জীবনকে শুধরে নেয়। ভদ্রতার খাতিরে ওঠে দাঁড়িয়ে সামনে রাখা চেয়ারে বসতে বললেন। চেয়ে দেখলেন পাশে টেবিলে ধুঁমায়িত কফি। নিজে উঠে গিয়ে মগটা এনে ফাহির সামনে রেখে দিলেন।
– দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
– ধন্যবাদ বলে চেয়ারে বসল বটে। কিছুক্ষণ সময় টেবিলের ওপর তাকিয়ে চোখ তুলে সুজিতের দিকে তাকাল ফাহি। চোখে মুখে যেন অপরাধের ছায়া পড়েছে। ভেবেছিল অপমান করে তাড়িয়ে দিবে। কিন্তু উলটো ভদ্রতার খাতিরে তাকে বসার জন্য অনুরোধ করল।
– আপনার স্বাস্থ্য এবং চেহারা ভেঙে গেছে। আপনার বড়ো ভাই জানিয়েছিলেন, আপনি বিয়ে করেছেন শুনে খুশি হয়েছিলাম। এরপর আর কোনো খবর জানি না। কারণ…
– বড়ো ভাই আমার বিয়ের পরপরই বিদেশে চলে যান। আর ফিরে আসেননি। আর আমাকে তুমি বললে হয় না?
– তা কেমন করে হয়? আপনি বিবাহিতা, একজনের স্ত্রী। এ সম্মান তো আপনার প্রাপ্য।
– বিবাহিতা ছিলাম। এখন দ্বিতীয় বার ডির্ভোসি মহিলা। আমার ভাগ্য আমাকে সঠিক পথে চালিত করেনি। প্রথম জীবনে যে ভুল করেছি, সেই ভুল জীবনকে তচনচ করে দিয়েছে। সংসার ছিল, সন্তানদি ছিল; এখন নিঃসঙ্গ, নিঃস্ব। ভাগ্যক্রমে একটা এনজিওতে চাকুরি করে বেঁচে আছি।

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

শেষ বিকেলের ঝরা ফুল (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!