শেষ-বিকেলের-ঝরা-ফুল-শেষ-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

শেষ বিকেলের ঝরা ফুল (শেষ পর্ব)

শেষ বিকেলের ঝরা ফুল (শেষ পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল

এত সময় ধরে ফাহির কাহিনি শুনে যাচ্ছিলেন। এবার মুখ খুললেন।
– আচ্ছা, কী কারণে বিচ্ছেদ হলেন তা বললেন না?
– যদি অনুমতি এবং সময় দেন তাহলে বলতে কোনো দ্বিধা করব না।
– শুনব। বলুন।
আজ অন্তত একজন মানুষ পেয়েছে তাকে তো বলা যাবে। যেসব কারণে সুজিতের সাথে ঘর করা হয়নি তার মধ্যে ছিল মাত্র উনিশ বছর বয়সে দৈহিক মিলন এবং সন্তান জন্ম না দেওয়া। এটাই তো জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। কিন্তু আমি কখনো চিন্তা করে দেখেনি যে আমি কোন পরিবাবে, কোন পরিবেশ জন্ম নিয়েছি। ভাবনাটা ছিল বিপরীত মেরুর।
– বিবাহিত জীবন কাটিয়ে অবশেষে নিজের বাস্তব জীবনের স্বাদ উপভোগ করছি। যে কথা বলতে চাইছি। আমার বিয়ের দু’বছরের মাথায় ছোটো দু’দেবরকে বিয়ে দেওয়া হলো। বয়স তাদের বাইশ-পঁচিশ হবে। আর বউদের বয়স ১৫-১৮ বছর হবে। এখন তারা অনেকগুলো সন্তানের মা। মেজো বউটা ছিল এসএসসি পাশ। বেশ জেদি এবং স্পষ্টবাদী। শাশুড়িকে ছেড়ে কথা বলত না। অন্যায় এবং বেশি কড়াকড়ি দেখলেই প্রতিবাদ করে উঠত আর দোষের ভাগি হতাম আমি। শাশুড়ি এবং অন্যদের ধারণা নাটের গুরু বড়ো বউ। স্বামীর কাছে কৈফিয়ত দিতে হতো।

আরও পড়ুন গল্প কালো কঙ্কাল

সেই মেজো বউয়ের মুখে শুনেছিলাম আমাদের শ্বশুর বাড়ির অতীত ইতিহাস। বিষয়টি অনুমান করেছিলাম বিয়ের এক মাসের মধ্যে। প্রতি শুক্রবারে রাতে নিচের তলায় মিটিং হতো। সেইদিন বেশ আয়োজন করা হতো। প্রায় বিশ জনের মতো মেহমানদের খাবার তৈরি করা হতো। এই মিটিং এ শাশুড়িকে নিচের তলায় যেতে দেখেছি। বুদ্ধিমতী মেজো বউয়ের সুকৌশলে একদিন তাদের আলোচনার বিষয়াদি জেনেছিলাম। ভয়ঙ্কর সব আলোচনা, একেবারে দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র। স্বামী এবং তার মায়ের মনের ভেতরে এত প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে, তা বুঝার উপায় ছিল না। শ্বশুর ছিল একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী পক্ষের লোক এবং সক্রিয় রাজাকার বাহিনীর সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল পঁচিশ/ছাব্বিশ এবং অবিবাহিত। বিয়ের কথাবার্তা চলছে, ইতোমধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কী সুন্দর যোগাযোগ। হবু শ্বশুর-জামাই দু’জনেই রাজাকার বাহিনীর সদস্য। হবু শ্বশুর মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নিহত হয়েছিল।

দেশ স্বাধীন হবার পর এই দুই পরিবারের লোকজন তাদের গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। পরবর্তীতে আগের সিদ্ধান্ত মতে বিয়ে হয়েছিল। সুযোগ খুঁজে চলে যায় সৌদি আরবে। আসা-যাওয়া করে অতিসর্পণে। পাঁচটা সন্তানের বাবা হয়েছে। বড়ো ছেলেকে মাদ্রাসা পড়াকালীন সময়ে সৌদি আরবে নিজের কাছে নিয়ে যায়। ছেলেকে বিদেশে রেখে দেশে ফিরে আসে। পাপ মানুষের পিছনে হাঁটতে থাকে। ছদ্মবেশে নিজ গ্রামে এসে আশ্রয় নেয় এক জ্ঞ্যাতি ভাইয়ের বাড়িতে। কানাঘুঁষা চলতে থাকে। আগন্তুক মৌলভি সাহেবকে। ধরা পরে যায়। কি নির্মম পরিহাস! গণপিটুনিতে নিহত হয় একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী আর এক রাজাকার। কিন্তু তার পরিবার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। সুযোগ তাদের হাতে আসে ১৯৭৫ খ্রিটাব্দে, আগস্টে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর। বিধবা স্ত্রী বুদ্ধিমতী ছেলে তিনটিকে গড়ে তোলে বাংলাদেশ বিরোধী করে এবং মেয়ে দুটোকে বিয়ে দেয় তাদের মনোভাবাপন্ন পরিবারের ছেলের সাথে।

আরও পড়ুন গল্প নতুন সূর্যের অপেক্ষায়

– অনেক অজানা কাহিনি তো বললেন, কিন্তু আপনার বিয়ের আগে আপনার পরিবার ছেলের পরিবারের কোনো খোঁজখবর নেননি?
– বড়ো ভাইয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি একটা কথাই বলেছিলেন, ঘোটক যা বলেছিল তাই বিশ্বাস করে বিয়েতে মত দিয়েছিল। এরপর আর কোনো প্রশ্ন করেনি। ডিভোর্সি মহিলা, তাছাড়া বয়স বলে একটা কথা আছে। ভরসা পেয়েছিলাম চাকুরি করার সুযোগ দিবে। শাশুড়ি সাহেবা প্রথম রাতেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমি কোথায় প্রবেশ করেছি। আর সময়টা ছিলো ওদের। বাচ্চারা বড়ো হলো, বিয়ে করে সংসারী হলো। মেয়েটির অল্প বয়সে শ্বশুর বাড়ির পা রাখল। আমি একা হয়ে গেলাম। শরীর আর যৌবনে ভাটা পড়ল। স্বামীর আচরণ সুবিধার লাগল না। শাশুড়ির হাবভাব কেমন যেন। মনের ভেতরে অশান্তি ভর দিয়ে উঠল। তাহলে কী স্বামীর চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ আমি।

শাশুড়ি চায় তার ছেলেকে দ্বিতীয়বার বিয়ে দিবে। একজন মুসলিম চারটি বিবি রাখতে পারে এবং সে ক্ষমতা তার ছেলের আছে। নিয়মমাফিক বড়ো বউয়ের অনুমতি নিতে হবে। শাশুড়ি নিজে তার ঘরে ডেকে প্রস্তাব দিলেন। তিনদিন সময় নিয়ে ফিরে এসে নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে থাকি। সতীনের সাথে স্বামীর সংসার করার চেয়ে আলাদা জীবনযাপন করা এ বয়সে উত্তম। এ সংসারে বুড়ো অকাজের মানুষ হয়ে না থাকাই আমার কাছে নিরাপদ বলে মনে হলো। তাই তিনদিন সময়ের আগেই শাশুড়িকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলাম। তিনি কোনো জবাব না দিয়ে বললেন ,
– তোমার জন্য আপাতত আলাদা একটা থাকার ব্যবস্থা করা হবে। মুসলিম শরিয়ত মতে ব্যবস্থা করা হবে।
– ব্যাস, হয়ে গেল। তারাও বাড়তি ঝামেলা করতে চায় না। এক সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হলো। মেয়েটি অনেক কান্নাকাটি করেছিল। কলেজ জীবনের এক বান্ধবীর কাছে আগেই বলে রেখেছিলাম। উঠলাম তার বাসায়। তার চেষ্টায় এতিমখানায় চাকুরি। তারপর নিজের চেষ্টায় এনজিও। ফিরে তাকাতে হলো না। মুক্ত বয়স্ক পাখি। নীড় না থেকেও নীড়ে আছি। দ্বিতীয়বার বিবাহ বিচ্ছেদ কিন্তু জীবন থেকে বিচ্ছেদ হইনি। জীবনের প্রথম ভুলটা ভুলতে পারিনি। কখনো যদি দেখা হয় মাফ চেয়ে নেব সেই প্রথম পুরুষের কাছে যিনি হাতের মুঠোয় পেয়েও আমার মতামতের সম্মান দেখিয়েছিলেন। কী আশ্চর্য তার সাথে দেখাও হয়ে গেল দৈবক্রমে!

আরও পড়ুন গল্প মাধবী নিশীথিনী

বিকেলের সূর্যের আলো ব্যালকনিতে এসে দোল খাচ্ছে। সুজিত রায়হান চোখ তুলে ফাহির বিষন্ন মুখের দিকে তাকাল। কী যেন বলতে যাবে এমন সময় কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকল তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সি একটা মেয়ে। চঞ্চল এবং আকর্ষণীয় চেহারা।
– বাবা, চলো যাওয়া যাক।
– অবশ্য। তোমরা কথা বলো আমি ওয়াশরুম থেকে আসি।
ফাহির সাথে মেয়েটিকে পরিচয় না করিয়ে এভাবে ওয়াশরুমে চলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক লাগল ফাহির কাছে। মেয়েটি অপরিচিত মহিলার পাশে একটা খালি চেয়ারে বসে নিজের পরিচয় দিল,
– আমি জয়তী। সমাজকর্মে মাস্টার্স করে বাবার সাথে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছি।
– ফাহিমিদা ফাহি। তোমার মতো একটা এনজিওতে আছি।
– বাহ! কী মজা। আপনাকে আমাদের এতিম দলে পেয়ে গেলাম।
– এতিম! তোমার তো বাবা-মা আছেন। নিজেকে এতিম বলছ কেন?
জয়তী ফাহির মুখের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল।
– কেন, এতিম শব্দের অর্থ জানেন না। পিতা-মাতাহীন সন্তান। আমরাও তাই।
– মা, হেয়ালি করছ কেন?
– হেয়ালি নয়, এটাই সত্য। ব্যাখ্যা করি, শুনবেন তো?
– বেশ।
– এতিমখানার রেকর্ড হতে জানতে পারি আমার বয়স তখন তিন/চার বছর হবে। বাবা-মায়ের সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম নানা বাড়িতে। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী। যে বাসে যাচ্ছি সেই বাসটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। বেঁচে গেল ছোটো শিশু এতিম হয়ে। দয়াবান এক ব্যক্তি এতিমখানায় রেখে যায়। কেউ কোনোদিন খোঁজখবর নিতে আসেনি। এতিমখানার সবাই স্নেহ করতেন। যাকে বাবা বলি তিনি প্রতি মাসে এতিমখানায় পরিদর্শনে আসতেন। তখন আমার বয়স পাঁচ/ছয় হবে। বুদ্ধিমতী এবং চঞ্চল ছিলাম, এখনও আছি।

আরও পড়ুন গল্প সে আমার কেউ না

সুজিত রায়হানকে দেখলে বাবার কথা মনে হতো। যদিও বাবা-মায়ের চেহারা মনে নেই। ভাবতাম বাবারা এমনই হয়। বাবা আসতেন ছুটির দিনে। অনেক চকলেট নিয়ে। সবাইকে দিতেন। আমাকে বেশি চকলেট দিতেন। কেন দিতেন জানি না। আমি তাকে প্রায়ই জড়িয়ে ধরে আদর নিতাম। তিনি আমাকে কোলে তুলে খুব আদর করতেন। একদিন এক কান্ড বাধিয়ে বসলাম। বাবাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিলাম, কেউ ছাড়াতে পারছে না, সাথে ভীষণ কান্নাকাটি। বাবা তার মুখ আমার কানের কাছে নিয়ে চুপি চুপি বললেন, “আগামী সপ্তাহে ছুটির দিনে তাকে বাসায় নিয়ে যাবেন।”

বাবাকে ছেড়ে আনন্দে হোস্টেলে চলে যাই। পরে জানতে পারি, কাগজপত্র তৈরি করে আমাকে তার মেয়ে হিসেবে দত্তক নিয়ে বাসায় ওঠেন। আমার জন্য ছোটো ঘর। সুন্দর করে সাজানো। পাশে বাবার ঘর। রান্না করার এবং আমাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন আয়া। রাতে তার ছুটি। এতিমখানায় থাকায় ছোটো বয়সে অনেক কিছু শিখতে হয়েছিল। তাই বাবাকে বেশি কষ্ট করতে হয়নি। ভর্তি করে দেন ভালো স্কুলে। মায়ের কথা জানতে চাইলে বলতেন, পরে বলা হবে। তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। বোর্ডে নাম নিবন্ধন করতে হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষকে বিস্তারিত তথ্য জানানোর পর তারা বাবার নাম লেখেন কিন্তু মায়ের নামের ঘর ক্রস দেয়।

সেইদিন বাবার কাছে নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করি। আমি এতিম। বাবা অবিবাহিত এবং এতিম। মনে একটুও দুঃখ নেই যে আমি এতিম। অনেক বড়ো এবং সুন্দর মনের মানুষ আমার বাবা। বাবার কাছে পথ চলার মন্ত্র শিখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছি সমাজকর্ম বিষয়ে। স্বাধীনভাবে চাকুরি করছি বাপ-মেয়ে। আমার জীবন পরিপূর্ণ। আমার জীবনের সত্যঘটনা শুনে কেউ যদি জীবনসঙ্গী হতে চায় আপত্তি করব না। আমার বাবা তাই বলেন। এত সময় ধরে স্বার্থপরের মতো নিজের কথা বলে যাচ্ছি কিন্তু আপনার পরিচয় জানা হলো না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার মনের ভেতরে এক সাগর দুঃখ আর কষ্ট ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। বলুন না, আপনার জীবনের কথা।

আরও পড়ুন রক্তে জ্বলে একাত্তর

এমন সময় সুজিত রায়হান ঢুকে মেয়েকে তাড়া দিল বাসায় যাওয়ার জন্য। জয়তী বাবার হাত ধরে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় ভিজিটিং কার্ড ফাহির হাতে দিয়ে বলল,
– একই পেশার মানুষ, হয়তো তো ঘুরে ফিরে আবার দেখা হতে পারে। পৃথিবী গোল তো।

ফাহি নির্বাক হয়ে ওদের দিকে চেয়ে ভাবছে, সুজিত রায়হান আজও দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। ফাহি নামের মেয়েটি জীবনকে কাছ হতে দেখেছে। দ্বিতীয়বার সংসারী হয়েছে। সন্তান জন্ম দিয়েছে। কেন যেন সেই সংসারের মানুষগুলোকে অন্য এক জগতের প্রাণী বলে মনে হয়েছে। ভালোবাসা, মমতা বলে কোনো বিশেষণ তাদের ভেতরে আছে বলে মনে হয়নি। তাই সময় থাকতে নিজেকে আলাদা নিয়েছিল চার দেয়ালের মধ্যে হতে।

অজান্তে মনের ভেতর নাড়া দিয়ে যায়, তাহলে কী ফাহি নামের সেই উনিশ বছর বয়সি যুবতীকে ভালোবেসেছিল সুজিত রায়হান। দুটো ঠোঁটের মাঝ হতে বের হয়, আজ আমরা শেষ বিকেলের ঝরা ফুল।

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

শেষ বিকেলের ঝরা ফুল (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!