শরতের-মেঘ-শেষ-পর্ব
গল্প,  শাহানাজ মিজান,  সাহিত্য

শরতের মেঘ (শেষ পর্ব)

শরতের মেঘ (শেষ পর্ব)
শাহানাজ মিজান

অনলের বাবা চশমা ঠিক করে চোখে পরতে পরতে সুদীপকে প্রশ্ন করলেন,
— সে ঠিক কী বলতে চাইছে?
সুদীপ বাধ্য হয়েই বলতে শুরু করল,
— অনল, তুমি হয়তো জানো না, আমি তোমার সুদীপা বউদির ছোটো ভাই। বিশ্বাস করো, শুভ্রা কখনো তোমার ভালোবাসার সাথে বেইমানি করেনি। আর তোমাকেও ইচ্ছাকৃত দোষারোপ করেনি।
আজ থেকে চার মাস আগে, হঠাৎ শুভ্রা অসুস্থ হয়ে গেলে, হাসপাতালে নেওয়ার পর আমরা জানতে পারি, শুভ্রা ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত, লাস্ট স্টেজ। ডাক্তার তার সময় বেধে দিলেন, সে এই পৃথিবীতে মাত্র ছয় মাসের অতিথি। তখন থেকেই শুভ্রা তোমার জীবন থেকে সরে যাওয়ার জন্য তোমাকে মিথ্যে বলেছে। আমার সাথে স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করেছে। তোমাকে কষ্ট দিয়ে নিজে কষ্ট পেয়েছে প্রতিনিয়ত। ও তোমাকে সুখী দেখতে চেয়েছিল। ও ভেবেছিল, পৃথিবী থেকে ওর চলে যাওয়াতে তুমি যেন নিঃসঙ্গ না হয়ে যাও, তোমার পাশে যেন কেউ থাকে।

(অনলের বাবার সামনে এসে) শুভ্রা ভেবেছিল, অনলের কাছে নিজেকে খারাপ প্রমাণ করলে, অনল ওর জীবন থেকে সরে যাবে। কিন্তু অনল যখন ওকে অবিশ্বাস করল না, তখন ও নিজেই অনলকে চরিত্রহীনের অপবাদ দিল। কেননা একজন মানুষ আর যাই হোক নিজের চরিত্রের উপর মিথ্যে আঘাত সহ্য করতে পারে না। আবার ওর বাবা-দাদাকে দিয়ে ফোন করিয়ে, আপনাদের কেও অনেক কথা শুনিয়েছে, যাতে করে আপনারা তারাতারি অনলের বিয়ে দিয়ে দেন। বিশ্বাস করুন মেসো, আমি আগে থেকেই বিবাহিত, যেটা অনল জানত না। অনল সেদিন আমার আর শুভ্রার সাথে যে মেয়েটিকে দেখেছিল, সে শুভ্রার বান্ধবী নয়, সেই আমার স্ত্রী।
(শিখার সামনে এসে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে) শিখা বোন আমার, আমি জানি, আজ তোমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। কিন্তু আমি একান্তই নিরূপায় হয়ে ছুটে এসেছি।
আপনারা সবাই ঐ নির্দোষ মেয়েটিকে এবং আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ।
অনল, এখন এতো কথা বলার সময় নেই ভাই। ডাক্তার শুভ্রাকে ছয় মাসের সময় বেধে দিলেও, গতকাল রাত থেকে ওর শারীরিক পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে গেছে। আইসিইউতে ঢুকতে চাইছে না, শুধু তোমার নাম বলছে বার বার। সে হয়তো শেষ বারের মতো তোমাকে একবার দেখতে চায়, তাই আমি ছুটে এসেছি…।
অনলের এবং আর সবার কিছু বুঝতে বাকি রইল না।

বাবা, মা, দাদা, বউদি, সবাই ভেজা চোখে শুভ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুদীপ, অনলকে নিয়ে কেবিনে ঢুকল।
শুভ্রা আস্তে আস্তে চোখ খুলল, চারদিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখল। নিজে নিজে উঠে বসার শক্তি নেই, তবু অনলকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করল। অনল, শুভ্রার পাশে বসে ওর একটা হাত ধরে আছে। শুভ্রার শুকনো মুখটা দেখে বুকের পাজর ভেঙে যাচ্ছে অনলের, চোখের জল বাধা মানছে না কিছুতেই। শিখাও কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। শিখার দিকে তাকিয়ে শুভ্রা শুকনো করে হাসল।
— শুভ্রা, কি দোষ করেছিলাম আমি? এত বড়ো শাস্তিটা আমায় কেন দিলে? কোন জনমের প্রতিশোধ নিলে? আমি তো শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি। আমাদের এত ভালোবাসা, এত বিশ্বাস…তোমার কাছে মূল্যহীন মনে হলো! এতটুকু ভরসা করলে না আমায়! আমাকে এভাবে দুঃখ দিয়ে, কতটা যন্ত্রণা বুকে নিয়ে একা একা দিন কাটিয়েছ। আমাকে কষ্ট দিয়ে, নিজে আরও বেশি কষ্ট পেয়েছ। এর চেয়ে বেশি কষ্টের, বেশি যন্ত্রণার আমার কাছে আর কি হতে পারে, বলো? যাকে বুকের ভেতরে এত যত্নে রাখলে, জীবনের এই শেষ বেলায় তাকে পাশে রাখলে না কেন? কেন এমন করলে বলতো?
— অনল, এভাবে বলো না প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে চাইনি আমি। আমি ছিলাম তোমার জীবনের আকাশে ভেসে আসা শরতের মেঘ। হঠাৎ করে এসেছিলাম, আবার চলেও যাব। কিন্তু শিখা, সেই ছোটো বেলা থেকেই তোমার ভালো বন্ধু। আজ তোমার সারাজীবনের সঙ্গী হয়েছে সে। এখন থেকে তুমি শুধু শিখাকে ভালোবাসবে। বিশ্বাস করো, আমি ওপারে গিয়েও তোমাদের দেখে খুব খুশি হব, ভালো থাকব। তুমি ওকে খুব ভালোবেস অনল…।
(একটু থেমে) আমি আর কিইবা করতে পারতাম ছোট্ট এই জীবনে। তুমি আমাকে যতটা ভালোবাসা দিয়েছ, সেই ভালোবাসার মূল্য কি করে দিতাম, বলো?
— শুভ্রা, আমি জানতাম, তুমি আমাকে ঘৃণা করতে পারো না। আমাকে কষ্ট দিয়ে, আমাকেই সুখী করতে চেয়েছ তুমি। অথচ তোমাকে চিনতে আমার এতটা ভুল হয়ে গেল শুভ্রা। কি করে করে এত বড়ো ভুল করতে পারলাম আমি! তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে একবারও তোমার মনের কথাটা বুঝতে পারলাম না কেন? (কান্নায় ভেঙে পড়ল) তুমি আমাকে এত ভালোবেসেছ আর আমি তোমাকে কত অপমান করেছি, কত অভিমান করেছি তোমার উপর।
— এভাবে কেদনা, অনল।
(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) যা হওয়ার ছিল, তাই হয়ে গেছে। হয়তো এটাই বিধাতার ইচ্ছে ছিল, ভাগ্য কে মেনে নাও। সব অভিমান ভুলে যেও, অনল…। আজ আমি মরণযাত্রার যাত্রী, শেষ বিদায়ের সময়, তোমাকে যে দেখতে পেলাম, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া। অনল, মনে কোনো অপরাধ বোধ রেখ না, সব দোষ আমার ছিল। আর অপমানের কথা বলছ! সেটা আমিও তো কিছু কম করিনি তোমায়। আমাকে ক্ষমা করে দিও, প্লিজ।
(নিশ্বাসে খুব কষ্ট হচ্ছে। একটু থেমে, হঠাৎ করে জোরে কেদেঁ ফেলল) অনল, আমি ভেবেছিলাম এই পৃথিবীতে আমার আর কিছুই চাওয়ার নাই। কিন্তু এখন তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার কত স্বাধ, কত চাওয়া অপূর্ণ থেকে গেল। আমি আমার পোড়া দেহের ছাই দিয়ে সিথিতে সিদুর পরতে চাইনি অনল। আমি চেয়েছিলাম, তুমি আমার সিথিতে সিদুর দিয়ে, সুন্দর করে সাজিয়ে দিবে। তুমি আমাকে কোলে নিয়ে চিতায় তুলে দিবে, আমার মুখে আগুন তুমিই দিবে। আমি ওপারে যেতে যেতেও পোড়া চোখ দিয়ে শেষ বারের মতো তোমাকেই দেখতে চাই। কোনো কিছু চাওয়ার মতো আপনজন তুমি ছাড়া যে আর কেউ নেই আমার। মরণের পরে তুমি আমাকে এই সম্মানটুকু দিবে, অনল…!
(শিখার হাত ধরে, শান্ত স্বরে) বাহ্ তোমাকে তো খুব সুন্দর দেখতে লাগছে শিখা, খুব মিষ্টি দেখতে লাগছে।

শিখাও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। দৌড়ে গিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় বসানো ঠাকুরের আসন থেকে সিদুর এনে অনলকে বলল,
— শুভ্রার মাথায় পরিয়ে দাও।
অনল বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে একবার শিখার মুখের দিকে তাকাল। এরপর শুভ্রার মাথায় সিদুর পরিয়ে দিল। শুভ্রা, নীচু হয়ে অনলকে প্রণাম করতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। শিখা ওর একটা হাত ধরল, অনল একটা হাত ধরে ওকে বুকে জড়িয়ে নিল। শুভ্রাও এক হাত দিয়ে অনলকে চেপে ধরল। ভাঙা কণ্ঠে শুভ্রা বলল,
— শিখা, আমি জানি তুমি খুব ভালো মনের মেয়ে। তুমি অনলকে খুব ভালো রেখ, তোমরা খুব সুখে থেক।
(খুব কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে, থেমে থেমে বলল) শিখা, কখনো দেখেছ, মৃত্যু কত সুখের হয়, সুন্দর হয়…।

শিখার হাতে শুভ্রার হাতটা ভারী মনে হলো। ‘শুভ্রা’ বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল সে। অনল কোনো কথা বলতে পারল না। ওর চোখের জলও যেন থমকে গেল। উপস্থিত সবাই হু হু করে কাঁদছে। ডাক্তার, নার্স এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী হয়নি কোনোদিন। কেবিন ভর্তি সবার চোখে জল। সবাই শুভ্রাকে দেখছে, সিথির সিদুর নাকের ডগায় লেগে গিয়ে শুভ্র সুন্দর মুখটি আরও বেশি শুভ্রতায় ভরে গেছে।

আরও শরতের মেঘ-
১মপর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

শরতের মেঘ (শেষ পর্ব) 

Facebook Comments Box

শাহনাজ মিজান গল্প ও উপন্যাস লেখেন। প্রকাশিত উপন্যাস: অধরা চাঁদ; গল্পগ্রন্থ: আকাশে চাঁদের পালকি তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!