লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (২য় পর্ব)
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (২য় পর্ব)
বেশ কয়েক প্রকার ব্যঞ্জন প্লেটে সাজিয়ে সেগুলো টেবিলের উপর এনে রাখল শেরদিল। মুরগি ভাজা, রুটি ও চিজ পনিরের সঙ্গে রেড ওয়াইন। শেরদিল যখন রেড ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল; কবিরের মনে হচ্ছিল ওয়াইন নয়, শেরদিল আসলে পান করছে বাংলাদেশের মানুষের রক্ত। কামড় দিয়ে যখন মাংস ছাড়িয়ে নিচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল পাকিস্তানি হায়েনা কামড় বসিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার পবিত্র শরীরে।
হেনরিয়েট কাটা চামচ দিয়ে সন্তর্পণে খাবার মুখে তুলে নিচ্ছে। ও পরে আছে গাঢ় নীল রঙের লংস্কার্ট। ধবধবে সাদা শার্টের উপর অরুণ বর্ণের ছোটো ছোটো ফুল আঁকা। দারুণ লাগছে দেখতে। শেরদিলের পোশাক-পরিচ্ছেদও মন্দ নয়। আকাশি রঙের শার্টের উপর অ্যাশ কালারের ব্লেজার। কালো রঙের ট্রাউজার। পায়ে অক্সফোর্ড সুজ।
হেনরিয়েট শেরদিলের দিকে তাকিয়ে বলল,
— তোমার ব্লেজারটা কিন্তু বেশ সুন্দর।
শেরদিল বলল,
— এটা ‘ইয়াপ সেইন্ট লরেন’ ব্র্যান্ডের। কত নিয়েছে জানো? একশত পাউন্ডা স্টারলিং। আমি যে শার্টটি পরেছি এটা ‘ল্যানবিন’ ব্র্যান্ডের।
বাঁ হাতটি হেনরিয়েটের মুখের সামনে এগিয়ে দিয়ে হাতঘড়িটির দিকে ইঙ্গিত করে শেরদিল বলল,
— দেখো তো এটা কোন ব্র্যান্ডের, চেনো কি না?
হেনরিয়েট স্মিত হেসে বলল,
— পিয়েরে কারডিয়ান। এগুলো তো সব ফরাসি ব্র্যান্ড। চিনব না কেন? তুমি আমাকে এগুলোর দাম শোনাচ্ছো কেন? আমি কিন্তু এগুলোর মূল্য জানতে চাইনি। তোমার জানা উচিত ছিল এটা ভীষণ রকম অভদ্রতা।
আরও পড়ুন গল্প পথভোলা এক পথিক
হেনরিয়েটের এসব কথায় শেরদিলের চোখে-মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। শেরদিল লজ্জাহীন, নীরব, নির্লিপ্ত ও নির্বিকার।
শেরদিলের এসব কাণ্ড-কারখানায় বেশ কৌতুকবোধ হচ্ছিল কবিরের। ছেলেটি মূর্খ নাকি উন্মাদ। মগজহীন মানুষের কাছ থেকে নিজের বিত্তবৈভবের স্তুতি ছাড়া আর কী-ই বা আশা করা যায়। বেওকুফটার মাথায় যদি এতটুকু ঘিলু থাকত, তাহলে সুন্দরী এই তরুণীর হৃদয় জয় করার জন্য এসব অসাড় জিনিসপত্রের কীর্তি জাহির করায় লিপ্ত হতো না নিশ্চয়ই।
কবির ঈষৎ কৌতূহলী কণ্ঠে হেনরিয়েটকে জিজ্ঞেস করল,
— তুমি বাংলাদেশ সম্পর্কে আর কী জানো?
হেনরিয়েট এমনভাবে মাথা নাড়াল, যেন না-জানাটা বড়ো ধরনের অপরাধ।
কবির প্রসন্ন গলায় বলল,
— আমি কিন্তু তোমার দেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানি।
হেনরিয়েট বিস্ফারিত নেত্রে বলল,
— যেমন?
প্লেটে খাবার তুলতে তুলতে কবির বলল,
— এই যেমন ধরো অ্যাতুর র্যাঁবো।
হেনরিয়েট উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠল,
— আমার ভীষণ…ভীষণ…প্রিয় কবি।
দরাজ গলায় কবির আবৃত্তি শুরু করে,
“তুষারের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এক রাজসিক নারীমূর্তি
তার চারপাশে মৃত্যু
শিস, মৃদু নিঃশ্বাস এবং ফাঁপা সঙ্গীতের চক্রে তার দেহ ভূতের মতো উত্থিত স্ফীত ও আন্দোলিত হয়
সুন্দর ত্বকে লাল-কালো দাগ ফুটে ওঠে…।”
আরও পড়ুন গল্প রোদেলা দুপুর কাঁদে
হেনরিয়েটের কণ্ঠে সীমাহীন উৎফুল্লতা।
— দারুণ! দারুণ! এই কবিতাটির শিরোনাম ‘সুন্দরী’, তাই না? আমি ঠিক বললাম কি না বলো?
কবির সহাস্যে বলল,
— হুম, ঠিক বলেছ।
হেনরিয়েট স্মিত হেসে বলল,
— তুমি কি আমাকে উদ্দেশ করে কবিতাটি আবৃত্তি করলে?”
কবির মৌন রইল।
— গিয়ম আপোলিনেয়ারের কবিতা কেমন লাগে তোমার?, প্রশ্ন করল কবির।
মুখাবয়বে হাসির ফোয়ারা তুলে হেনরিয়েট বলল,
— আমার দ্বিতীয় প্রিয় কবি। জানো তো ওর শরীরে এক ফোঁটা ফরাসি রক্তও নেই। তারপরও আপোলিনেয়ার খাঁটি ফরাসি কবিদের মধ্যে অন্যতম। মা পোলিস আর বাবা ছিলেন ইতালিয়ান।
— হুম, বেশ জানি, বলল কবির।
— ও-ই তো ফরাসি কাব্যে প্রথম সুররিয়ালিজমের ব্যবহার করেছিলেন। যথেচ্ছ প্রশংসা করে পিকাসোকে বানিয়েছিল চিত্রশিল্পী পিকাসো। ওঁর একটি কবিতার চারটি লাইন তাহলে শোনো,
“হায়রে আমার পরিত্যক্ত যৌবন
শুকনো ফুলের মালা
এখন অন্য ঋতুর আসার পালা
সন্দেহ আর জ্বালা।”
এটার শিরোনাম ‘ভালোবাসায় নিবেদিত জীবন’।
— আচ্ছা হেনরিয়েট, তুমি কি জানো ‘মোনালিসা’ চুরি করেছে সন্দেহে পুলিশ একবার আপোলিনেয়ারকে গ্রেফতার করেছিল?”
হেনরিয়েটের চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময়,
— কই, জানি না তো। সত্যি নাকি!
আরও পড়ুন গল্প স্বপ্ন জল
কবির বলল,
— হুম। ১৯১০ কি ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের কথা। ঠিক করে মনে পড়ছে না। সপ্তাহখানেক জেলও খেটেছিলেন আপোলিনেয়ার।
— শার্ল বোদলেয়ার তোমার কেমন লাগে?
হেনরিয়েটের কাছে জানতে চায় কবির।
— ভালো, তবে ও বড্ড অশ্লীল লেখে।
কবির ভ্রু কুচকে বলল,
— শিল্পের আমার শ্লীল-অশ্লীল কী? শিল্প তো শিল্পই। একবার কী হয়েছে জানো। অশ্লীল কবিতা লেখার জন্য বোদলেয়ারকে তোলা হয়েছে কোর্টে। তো বিচারক ওকে জিজ্ঞেস করলেন-এই যে মান্যবর কবি, এত কিছু থাকতে আপনি অশ্লীল কবিতা লেখেন কেন, বলুন তো? বিচারকের এমন প্রশ্নে বোদলেয়ার কী বলল জানো?”
হেনরিয়েট ভ্রূ কপালে তুলে বলল,
— কী বলল?
বোদলেয়ার বলল,
— ধর্মাবতার, ফুল, ফল, গাছ, লতা, পাতা সবকিছু নিয়েই তো ইতোমধ্যে কবিতা লেখা হয়ে গেছে। নারীর শরীর নিয়ে লেখাই শুধু বাকি আছে এখন।
কোর্টে উপস্থিত সবাই তো একেবারে তাজ্জব! বলে কি লোকটা!
কবির লক্ষ করল তাদের মধ্যকার এই কথোপকথনগুলো শেরদিলের হৃদয়ে কামানের গোলার মতো বিদ্ধ হচ্ছে। নানা ছুতোয় কীভাবে হেনরিয়েটকে ওখান থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়, সে চেষ্টাই শুধু করছিল শেরদিল। এই অজুহাতে সে বারবার হেনরিয়েটের দুই বাহু স্পর্শ করে তাগাদা দিচ্ছিল আর বলছিল,
— ওঠো এবার। চলো সাগরপাড়ে গিয়ে বসি দুজন।
প্রেম-ভালোবাসার মতো সূক্ষ্ম বিষয়গুলোতে সাধারণত ধৈর্য ধরতে হয়। সংযম দেখাবার মধ্যেও যে একটা অহংকার আছে; এই উজবুকটা সেটা বুঝবে কেন? ও তো পাকিস্তানি। পাকিস্তানিদের মধ্যে সংযম বলে কিছু নেই।
হেনরিয়েট শেরদিলকে বলল,
— এখান থেকে এখন এক পা-ও নড়ব না আমি। কবিরের সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করব আজ সারাবেলা। এডিনবরায় আসার পর এতদিনে মনের মতো একজন মানুষ পেলাম।
আরও পড়ুন লেখকের মুক্তিযুদ্ধ –
১ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (২য় পর্ব)