লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (শেষ পর্ব)
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (শেষ পর্ব)
হেনরিয়েট কবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
— আরেকটা কবিতা হয়ে যাক।
কবির আবৃত্তি করতে শুরু করল,
“তোমাকে চোখের মধ্যে রেখে কাঁদি, আমার দু’চোখে তুমি
বিগলিত ঠান্ডা হিম, তুমি কাঁদছ, দু’চোখের একান্ত ভেতরে
গলে যাচ্ছে কালো আঁখিতারা, গলে গলে একটি গাছের মতো
সবুজ, তোমার মতোন করুণ হয়ে যাচ্ছে অশ্রুমালা
তুমি নিথর নিরীহ দাঁড়িয়ে আছ আঁখিতারার ভেতরে,
তুমি, একাকিনী সবুজ পল্লব, কাঁপছ বাতাসে সাদা হিমে…।”
অস্ফুট কণ্ঠে হেনরিয়েট বলে উঠল,
— অপূর্ব! অপূর্ব! এটা কার কবিতা কবির?
কবির সলজ্জ গলায় বলল,
— আমার।
— তোমার!
সম্পূর্ণ আবেগ ধরে রাখতে না পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল হেনরিয়েট।
— তুমি কবি? তুমি কবিতা লেখ? এত সুন্দর কবিতা! অনবদ্য। একে তো ক্রিস্তফ কিংবা পল ভার্লেইনের কবিতা বলেও দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়। তোমার কবিতার বই বেরিয়েছে?
কবির বলল,
— হ্যাঁ। ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ নামে একখানা কবিতার বই বেরিয়েছে বছরখানেক আগে। তবে পরবর্তী বইগুলোতে কবির নামটা আর রাখব না ভাবছি। কবির নামটা ছেঁটে ফেলে আজাদ করে দেব। আজাদ মানে হচ্ছে মুক্ত স্বাধীন। পরিণত বয়স থেকে আমি নিজেকে শৃঙ্খলহীন মনে করি। আমার নতুন লেখক নাম হবে হুমায়ুন আজাদ। তোমাদের বিখ্যাত কবি স্তেফান মালার্মের মতো। ওর নাম তো ছিল এতিয়েন মালার্মে। পরে এতিয়েন বদলে স্তেফান করেছে। আর আমি প্রথমটুকু ঠিক রেখে শেষের অংশটা বদলে দেব শুধু।
আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা
হেনরিয়েটকে রান্নাঘর থেকে সরাতে ব্যর্থ হয়ে গজগজ করতে করতে নিজেই ওখান থেকে বেরিয়ে গেল শেরদিল।
হেনরিয়েট কিছুটা শিশুসুলভ গলায় বলল,
— আমার নামটাও কিন্তু ফরাসি একজন কবির নামে, জানো?
কবির বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
— তাই নাকি, বেশ তো! তাহলে ওর দু’একটা কবিতা শোনাও।
হেনরিয়েট আফসোসের স্বরে বলল,
— মুখস্থ নেই। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল হেনরিয়েট ডিবনের কবিতা। সেজন্যই তো আমার মা ওর নামের সঙ্গে মিলিয়ে আমার নাম রাখে হেনরিয়েট ডিবন।
হেনরিয়েট দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে উৎকণ্ঠিত গলায় বলল,
— ওঠ। ওঠ এবার। চলো সমুদ্রের ধারে বেরিয়ে আসি। ওখানে বসে বসে নীল জল আর সমুদ্রচিলদের ডানা ঝাপটানো দেখব দুজন।
সমস্ত দিন লাইব্রেরিতে কাটিয়ে পরদিন ছাত্রাবাসে ফিরছিল কবির। শব্দহীন বিকেল। সূর্যাস্তের আভা মেঘের ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে কমলা রং। গ্র্যান্ড ভবনের সামনে লতাপাতা ও শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দৈত্যের মতো যে উইলো গাছটা দাঁড়িয়ে আছে, সেটারই তলায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে হেনরিয়েট। দূর থেকেই তাকে দেখতে পেল কবির। বাগানের চেরি গাছগুলোতে বসেছে লাল, গোলাপি, ক্রিম আর বেগুনি রঙের ফুলের মেলা। ফুলের ঐশ্বর্যের মধ্যে হেনরিয়েটকে দেখতে লাগছে ডানাহীন পরির মতো।
কবির বিস্মিত গলায় বলল,
— এখানে বসে কী করছ, হেনরিয়েট?
— তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
সহাস্য বদনে হেনরিয়েট বলল,
— আমার পাশে এসে বসো।
কবিরও হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল হেনরিয়েটের পাশে।
আরও পড়ুন গল্প পক্ষিরাজের ডানা
হেনরিয়েট বলল,
— জানো, কাল সারারাত তোমার কথা ভেবেছি। তোমাকে একবার দেখার জন্য, একটু কথা বলার জন্য এখানে অপেক্ষা করেছি দু’ঘণ্টা ধরে। আচ্ছা কবির, তোমার কি এখানে ভালো লাগে?
কবির চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
— মোটেও না। আমার দেশ ও আমার গ্রামের জন্য হৃদয়ে অনুভূত হয় ব্যাকুলতা। শূন্য শূন্য লাগে সবসময়। জানো, ঢাকা থেকে মাত্র ২০ মাইল দূরে আমার গ্রাম। রাড়িখাল গ্রামটি ছিল অনেকটা পানির গ্রাম। ইতালির ভেনিসের মতো বলা যায়। সমস্ত গ্রামজুড়ে পুকুর আর পুকুর। বর্ষাকালে গ্রামটি পানির ওপর কচুরিপানার মতো ভাসে। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাই পছন্দ নয় আমার। নেহায়েত দায়ে পড়ে এসেছি পিএইচডি করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি প্রভাষক হিসেবে। পিএইচডিটা না থাকলে প্রমোশন হবে না সহসা।
জানো হেনরিয়েট,
— আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। পরীক্ষার খাতার একটি প্রশ্নের উত্তরে বন্ধুর কাছে লেখা চিঠিতে লিখেছিলাম ‘ইংলিশ ইজ অ্যা কার্স অন আওয়ার সোসাইটি’।
আমার প্রিয় শিক্ষক এবং সেই সঙ্গে যার প্রিয় ছাত্র ছিলাম ক্লাসে ডেকে নিয়ে আমাকে বলেছিলেন,
— ইংরেজি অভিশাপ হতে যাবে কেনরে বোকা? ওটা অভিশাপ নয় বরং আশীর্বাদ।
মাঝে মাঝে বাড়ির জন্য ভীষণ কষ্ট হয়। আমার ঘরের জানালার পাশে একটি চালতাগাছ আছে। গ্রীষ্মকালে গাছটিতে ফোটে অসংখ্য সাদা রঙের ফুল। সেই ফুলের হালকা ও মিষ্টি গন্ধে ভরে যেত আমার পড়ার ঘর। বর্ষাকালে ফুটত থোকা থোকা কদমফুল। সেই ফুলের সে কী গন্ধ ও সৌন্দর্য! তোমাকে কী করে বোঝাই।
হেনরিয়েট সন্তর্পণে তার ডান হাতটি রাখল কবিরের বাঁ হাতের উপর। তারপর বলল,
— শেরদিলের সঙ্গে আজ সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে এলাম। ওদের সঙ্গে যেহেতু তোমাদের যুদ্ধ চলছে, সেহেতু একই সঙ্গে দুজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা চলে না। আমি জেনে-শুনে বর্বরদের সমর্থন করতে পারি না। আমার সবটুকু সমর্থন তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। আচ্ছা কবির, আমরা কি আজ সারা রাত কবিতা নিয়ে কথা বলতে পারি?
কবির বলল,
— অবশ্যই।
গাছতলা থেকে উঠে দুজনে ডর্মের দিকে এগোল। ডর্মে ঢুকতেই ওরা দেখল শেরদিল বাক্সপেটরা গুছিয়ে ডর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও।
শেরদিল অর্থাৎ যার দিলটা বাঘের মতো, সে আজ ছাত্রাবাস ছাড়ছে বিড়ালের মতো। বেশ পুলকিত বোধ করল কবির। রুমে ঢুকে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল হেনরিয়েট। কবিরও গিয়ে দাঁড়াল ওর পাশে।
আরও পড়ুন গল্প কাঠগোলাপ ও প্রেম
হেনরিয়েট কবিরের হাতে আলতো স্পর্শ করে বলল,
— আমার মনের মধ্যে কী চলছে, তুমি কি বুঝতে পারো কবির?
কবির বলল,
— হুম।
হেনরিয়েট বলল,
— তাহলে এমন কিছু বলো যাতে আমার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।
কবির আবৃত্তি করতে লাগল,
কী যে ভালোবাসি, প্রেয়সী, তোমার তনুবিতান!
অলস অঙ্গ-চালনে
মনোহর ত্বক রেশমের মতো কম্পমান
রশ্মির প্রতিফলনে!
সাগরের মতো গভীর, সুরভি তোমার চুলে,
যেখানে অনবরত
নীল, পাটকেল ঢেউ জেগে ওঠে বাউন্ডুলে,
তিক্ত স্মৃতির মতো।
হেনরিয়েট প্রশ্ন করল,
— কার কবিতা এটা?
— শার্ল বোদলেয়ারের, হেনরিয়েটের কানে ফিসফিস করে বলল কবির।
হেনরিয়েট বলল,
— দারুণ। অনবদ্য।
আরও পড়ুন লেখকের মুক্তিযুদ্ধ –
১ম পর্ব
২য় পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
লেখকের মুক্তিযুদ্ধ (শেষ পর্ব)