রৌদ্রডোবা চাঁদ (১ম পর্ব)
রৌদ্রডোবা চাঁদ (১ম পর্ব)
সুবর্ণ আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভৈরব বাজার স্টেশন ছেড়ে একটু আগে বেরিয়েছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে মিষ্টি বিকেলটির দিকে তাকিয়ে আছে বিদিতা। দূরের আঁকাবাঁকা পথ ধরে কয়েকটি মেয়ে হেঁটে আসছে। পড়ন্ত সূর্যের সোনালি আলোয় রাঙানো তাদের মুখ। খানিক বাদেই আলোটি মুছে গেল জানালা থেকে। একটি শ্বাস ফেলে ভেতরের দিকে তাকাল বিদিতা।
ট্রেনটি ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পেরিয়ে গেল। বিদিতার পাশের সিট এখনো খালি। আখাউড়ায় ট্রেন দাঁড়াল বেশ কিছুক্ষণ। টিকেট এগজামিনার এলেন কামরায়। তখনই ব্যস্তসমস্ত হয়ে ট্রেনে উঠলেন এক সুদর্শন ভদ্রলোক, সঙ্গে এক প্রৌঢ়া। ডেনিম জিন্স আর খয়েরি শার্টের মানুষটিকে দেখে চমকে উঠল বিদিতা। কী আশ্চর্য, রুদ্র না!
আরও পড়ুন গল্প শিকড়ের সন্ধানে
রুদ্র হাঁ করে বিদিতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “হোয়াট আ সারপ্রাইজ, বিদি, তুই!”
বিদিতার মুখে আনন্দ-সুখের স্মিত হাসি। টিকেট চেকার ভদ্রলোক রুদ্রকে এবং প্রৌঢ়াকে বসালেন বিদিতার ঠিক পাশের সিটে।
রুদ্র সুটকেস আর লাগেজ গুছিয়ে রাখল।
রুদ্র বলল, “বিদি, আমি কিন্তু এখনো ধন্দে আছি। ধাঁধা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এটি তুই-ই তো, নাকি তোর ভূত! কতদিন পর দেখা হলো, বল!”
বিদিতা কিঞ্চিত থমকাল।
একটু ভেবে বলল, “তা বছর বারো তো হবেই।”
রুদ্র এখনো বুঝি চমকটির সঙ্গে ধাতস্থ হতে পারেনি। অবাক চোখে বিদিতাকে দেখছে।
এই বারো বছরে একটু ভারী হয়েছে একদা ছিপছিপে রুদ্র শাওন। চুল কিছুটা পাতলা হয়েছে। তার গমের রঙের মতো গায়ের রঙ খানিকটা তামাটে হয়েছে।
রুদ্র বসে আছে বিদিতার পাশে। বিমনা, নিশ্চুপ। তার গায়ের সেই ভীষণ চেনা মিষ্টি গন্ধটি বিদিতার নাকে আসছে থেকে থেকে। একযুগ দূর থেকে ভেসে আসছে স্মৃতির সুঘ্রাণ।
রুদ্র হেসে বলল, “কীরে বিদি, তুই তো দেখছি একেবারে আগের মতোই আছিস। সেই পেঁকাটি টাইপ। শুধু চোখে চশমা যোগ হয়েছে। মাঝের বারোটি বছর তোর ওপর কি কোনো ছাপই ফেলতে পারেনি?”
বিদিতা হো হো করে হেসে উঠে বলল, “এই বারো বছর আমার কাছে মনে হয় বারোটি ঘণ্টা মাত্র। সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে সকালে জেগে উঠেছি। বয়সের সাথে কেবল বারো ঘণ্টা যুক্ত হয়েছে। তাই বয়স থামিয়ে রাখতে পেরেছি এতগুলো বছর ধরে। কিন্তু আসলে কি তাই!”
বিদিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
রুদ্র ভ্রুকুটি করে বলল, “তোর ছেলেমানুষি স্বভাবটি দেখি এখনো সেই একই রকম আছে। বেড়ে তো উঠেছিস, বড় হয়েছিস কি?”
আরও পড়ুন গল্প সাদা মেঘের তুলো
বিদিতার হৃদস্পন্দন সহসা দ্রুত হলো। বহুকাল পর খুলে গেল অতীতের অর্গল। রুদ্রর স্মৃতির ঝাঁপিতে কি আজও তবে রয়ে গেছে নীলগিরির ঘটনাটি? বারো বছর পেরিয়ে এসেও সেই রাতটিকে কি ভুলতে পারেনি রুদ্র? সে নিজেও কি পেরেছে? সেটি কি সম্ভব!
রুদ্র তখন মার্কেটিং নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বিদিতার সাবজেক্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ফ্যাকাল্টিতে। রুদ্র থাকতো ফজলুল হক হলে আর বিদিতা জনা দশেক মেয়ের সাথে কলাবাগানের এক মেসে। দুজনার মধ্যে ছিল গাঢ় বন্ধুত্ব। ছটফটে স্বভাবের সুদর্শন রুদ্রর প্রতি বিদিতার অন্যরকম আলাদা আকর্ষণ ছিল। রুদ্রও যে তাকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে, সেটিও বিদিতার অজানা ছিল না। কেউ কাউকে প্রপোজ করেনি কখনো, তবুও দুজনের মধ্যে একটি বিশেষ সম্পর্ক দানা বাধছিল একটু একটু করে। ব্যবসায় প্রশাসনের জনা দশেক ছেলেমেয়ের একটি দুর্দমনীয় গ্রুপের মধ্যমণি ছিল রুদ্র আর বিদিতা।
সেদিনের আড্ডায় দুজনের তুমুল বাকবিতণ্ডা। গ্রীষ্মের ছুটিতে বিদিতা বাবা-মার সঙ্গে ঘুরে এসেছে রাঙামাটি থেকে। আড্ডায় উচ্ছ্বসিত বিদিতা গল্প করছিল রাঙামাটি লেকের জলে বোটে বসে সানরাইজ দেখার অপূর্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে। ওদিকে রুদ্ররা কজন মিলে গিয়েছিল বান্দরবানের নীলগিরিতে। সেখানকার মাতাল হাওয়ার স্পর্শ আর সবুজ পাহাড়ের আড়াল ফুড়ে সূর্য ওঠার মোহময় দৃশ্যের নাকি কোনো তুলনাই চলে না। সুতরাং রুদ্র গলা ফাটাচ্ছে নীলগিরির মনোমুগ্ধকর নয়নাভিরাম সানরাইজ নিয়ে। দুজনের বাকযুদ্ধ তুঙ্গে, কেউই হার মানতে রাজি নয়।
রুদ্র চেঁচিয়ে বলল, “সি ইট টু বিলিভইট। যাবি আমার সঙ্গে নীলগিরিতে? যদি সাহস থাকে, তবে চল। নিজের চোখে দেখে মিলিয়ে নিবি কোন্টি ঠিক।”
আরও পড়ুন গল্প একশত ছিদ্রযুক্ত জামা
বিদিতার মাথায় তখন জিদের আগুন। সাত-পাঁচ না ভেবেই সোজা হ্যাঁ বলে দিল।
পরদিন সকালে বিদিতা মেসের কেয়ারটেকারকে বলল, “একটু বগুড়া যেতে হবে মুনিয়াদি, বাড়ি থেকে কিছু জিনিস আনতে হবে।”
মুনিয়াদি হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়তেই ছোট্ট একটি ব্যাগে কিছু জামাকাপড় ভরে সোজা ছুটল বাস টার্মিনালে। রুদ্র বাস স্ট্যান্ডেই ছিল।
একই বাসের আলাদা আলাদা সিটে বসে পৌঁছলো চিটাগং। সেখান থেকে বান্দরবান হয়ে নীলগিরি। এবার পাশাপাশি বসে। নীলগিরিতে যখন নামল, তখন বিকেল। চারপাশের সবুজ পাহাড়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত রহস্য যেন বিছিয়ে আছে মিহি হয়ে।
রুদ্র বলল, “এটিই নীলগিরি। কী, জায়গাটি দারুণ না!”
নীলগিরিতে একটিই মাত্র রিসোর্ট, যেটিতে কিছুদিন আগেই রুদ্ররা থেকে গিয়েছিল। সিঙ্গল বেডেড রুম পাওয়া গেল না। একটি ডাবল বেডেড রুম ফাঁকা ছিল, বাধ্য হয়ে সেটিই নিতে হলো। রুমটি বেশ বড়। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট। গরম জলের ব্যবস্থা আছে। অ্যাটাচড বাথ। বাথরুমটি বেশ ঝকঝকে। পুবদিকে ভারী পর্দার ওপাশে বিরাট উইন্ডোগ্লাস। কাচের ওদিকে পাহাড়ের সারি। নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ম্রো আদিবাসী জনপদ
সন্ধ্যেবেলা দুজন এদিক ওদিক হাঁটল উদ্দেশ্যহীন। সাতটা বাজতে না বাজতেই নীলগিরি জনবিরল। দুজন রুমে ফিরে এল। রাতে ডিনার দিয়ে গেল রুমে। রুদ্র রেলিশ করে মুরগির ঠ্যাং চিবোচ্ছে। বিদিতার তখন খাবার মতো অবস্থা নেই। মনের মধ্যে তুমুল তোলপাড়। খুঁটে খুঁটে কোনো মতে ভাতগুলো গিলল। ঝোঁকের মাথায় চলে এসে এখন কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে, যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়!
আরও পড়ুন গল্প অন্ধকারে জ্বলে দীপশিখা
যে ভয়টি বিদিতা করছিল, ঠিক সেটিই হলো। রুমে তখন মৃদ্ নীল রাত-বাতি জ্বলছে। বিদিতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে রাতের ক্রিম মাখছিল। রুদ্র ডিনার সেরে লবি থেকে সিগারেট টেনে রুমে ঢুকল। মুখে সিগারেটের গন্ধ। সে ধীরে ধীরে হেঁটে এসে বিদিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়াল। যেন এটি তার অধিকার। বিদিতা ভয়ে জড়সড়। অ্যাডভেঞ্চার তখন শিকেয় উঠেছে। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ। যতটা সম্ভব গলায় বীতরাগ মিশিয়ে সে বলল, “আই ডোন্ট এক্সপেক্ট ইউ টু ডু দিস, রুদ্র। তোর ওপর নির্ভর করার মূল্য এভাবে নিবি তুই? কস্মিনকালেও ভাবিনি তুই এরূপ আচরণ করবি! ছিঃ!”
বেচারা রুদ্র! আর কেউ হলে কী হতো বলা কঠিন। তবে রুদ্র অন্যদের থেকে আলাদা। ছিটকে সরে গিয়েছিল সে। অপমানে পাংশু হয়ে যাওয়া রুদ্রর মুখ চোখ বুজলেই এখনো স্পষ্ট দেখতে পায় বিদিতা।
অস্বস্তিতে সারা রাত এপাশ ওপাশ করল বিদিতা। জানালার পাশের সোফায় বসে একের পর এক সিগারেট টেনে সমগ্র রাত পার করল রুদ্র। ভোরবেলা পাহাড় ফুঁড়ে লাল চাকতির মতো নরম সূর্য লাফিয়ে উঠল আকাশে। পুরো পাহাড়টিকে আলোর প্রপাতে স্নান করিয়ে দিল যেন। অলৌকিক লালচে আলোর রেণু ভিজিয়ে দিল রুমটিকে বিমনস্ক রুদ্রর নির্বাক দৃষ্টি পাহাড়ের দিকে। দুজনের কারও মুখেই কোনো কথা নেই। সকাল হতেই ঢাকা অভিমুখে যাত্রা এবং অতঃপর আবার নিজভূমে।
আরও পড়ুন রৌদ্রডোবা চাঁদ-
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
রৌদ্রডোবা চাঁদ (১ম পর্ব)