রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (১ম পর্ব)
রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (১ম পর্ব)
ইতালি। নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হাজার হাজার বছরের এক প্রাচীন সভ্যতা, যার পাতায় পাতায় জড়িয়ে আছে জুলিয়াস সিজার, ক্লিওপেট্রা, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ভ্যাটিক্যান সিটি, ভেনিসের গন্ডোলা, ফুটবল প্রেমী মানুষদের প্রিয় ক্লাব এ সি মিলান ইত্যাদি। সেই শতাব্দী প্রাচীন, ঐতিহাসিক ইতালি দেখতে যাওয়া হল। আমার মেয়ে সঞ্চিতার সহকর্মী জাবেদ ইতালির মিলানের কনসাল জেনারেল। জাবেদের আমন্ত্রণে জেনেভা থেকে মিলানে যাত্রা করলাম। জেনেভা থেকে বাসে চার ঘন্টার কিছু বেশি সময়ে মিলানে পৌছালাম।
মিলানের বাস টার্মিনালে জাবেদের পাঠানো গাড়িতেই আমাদের ইতালি ভ্রমণ শুরু হলো। আমাদের ভ্রমণ সঙ্গী মিলান কনসুলেটের আর এক কূটনীতিক তাজুল ইসলাম। বেলা তখন প্রায় একটা। জাবেদের অনুরোধ সত্বেও সময় বাঁচাতে একটা রেস্তোরাঁয় ইতালির ঐতিহ্যবাহী খাবার পিজ্জা-পাস্তা খেলাম। এরপর শুরু হল ইতালিও ভাষায় মিলান-ভ্রমণ।
প্রথমে দেখতে গেলাম মিলানের দৃষ্টিনন্দন ‘লেক কুমো’। মিলান শহর পেরোতেই লেক কুমোর মেরিন ড্রাইভ ধরে আমাদের গাড়ি ছুটে চললো। মেরিন ড্রাইভের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় চোখে পড়লো, লেক কুমোর পাশ ঘেঁষা পর্বতমালার সারি। পাহাড়ের পাদদেশে লেকের পাড় ঘেঁষে ধাপে ধাপে মানুষের বাড়ি-ঘর।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী শানশি লাইব্রেরি ও মোরগ ডাক
ঘন্টা খানেকের কিছু সময় গাড়ি চলার পর আমরা পৌঁছালাম এক ফেরিঘাটে। চল্লিশ মিনিটের মতো সময় নিয়ে ফেরি চলার পর লেক কুমোর অপর পাড়ে পৌছালাম। লেকটি ইতালির লোম্বার্ডি এলাকায়। এটি ইউরোপের গভীরতম লেকগুলোর একটি। লেকের ওপারে সুন্দর ছবির মতো ছোট ছোট শহর গড়ে উঠেছে! চারদিকে শুধু হরেক রঙের ফুল আর ফুল! লেক কুমোর পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে খাবারের দোকান, স্যুভেনির শপ। কিছু স্যুভেনির কিনলাম। দোকানগুলোতে অনেক বাংলাদেশি লোকজন কাজ করছে। লেক কুমোর পাড়ের অপূর্ব সুন্দর নিসর্গের মাঝে খানিকটা সময় কাটিয়ে ফিরে গেলাম মিলান শহরে জাবেদের বাসায়।
মিলান শহর দেখা আপাতত অসমাপ্ত রাখা হল, আবারও মিলানে ফিরে আসার জন্য। জাবেদের বাসায় মজাদার রাতের খাবার খাওয়ার পর, জাবেদের গাড়ি রাতেই আমাদের পৌঁছে দিল আমাদের গন্তব্যের মূল আকর্ষণ স্বপ্নের ভেনিস শহরে।
পরের দিন শুরু হলো ভেনিস শহর দর্শন। মিলান থেকেই জাবেদ ভেনিসে বসবাসরত আজাদ খান নামে এক ভদ্রলোকের সাথে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। সকাল আটটায় আজাদ খান ওনার নিজের গাড়ি নিয়ে আমাদের হোটেলের সামনে এসে হাজির। অমায়িক মাটির মানুষ। প্রায় বিশ বছরের বেশি সময় ধরে ভেনিসে বসবাস করছেন। বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায় বাড়ি। ভেনিসে কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন। সরকারি জমি লিজ নিয়ে ধান, গম, ভুট্টা, শাক-সবজি, ফলের চাষ করছেন। বাংলাদেশের অনেক মানুষ তাঁর কৃষি খামারে কাজ করছেন। গাড়িতে যাওয়ার সময় চোখে পড়লো মাইলের পর মাইল জুড়ে সবুজ ধান, গম, ভুট্টার খেত আর হলুদ চাদরে ছাওয়া সর্ষে ক্ষেত। চোখ জুড়িয়ে গেল। দেখলাম কৃষি প্রধান বাংলাদেশের মানুষের কৃষির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। শুধুমাত্র ইটালিতেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি থেকে শুরু করে আফ্রিকা এমনকি আমেরিকার বিভিন্ন এলাকাতেও বাংলাদেশিরা বিভিন্ন ফসল, শাক-সবজি, ফল ও ফুলের চাষ করে পৃথিবীর অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী শানশি লাইব্রেরি ও মোরগ ডাক
‘গ্রান্ড ক্যানাল’ ভেনিসের সবচেয়ে বড় ক্যানাল বা খাল। আজাদ সাহেব ক্যানালের পাড়ে গাড়ি পার্ক করে আমাদের নিয়ে ক্যানালের পাড়ে ওয়াটার বাসের ঘাটে নিয়ে গেলেন। সেখানে টিকেট কেটে ওয়াটার বাসে করে গ্রান্ড ক্যানাল পাড়ি দিয়ে আমাদের মূল ভ্রমণ শুরু হলো। ভ্রমণ শুরুর আগে ভেনিসের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের দিকে নজর ফেরানো যাক।
ভেনিস উত্তর-পূর্ব ইতালির একটি সমৃদ্ধশালী এলাকা। ‘ভেনেটি’ নামের প্রাচীন এক গোষ্ঠীর নামে ভেনিসের নামকরণ। মূলত অনেকগুলো দ্বীপের সমন্বয়ে এটি সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শহরটি গড়ে তোলা হয়েছিল। কালক্রমে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এটি সমৃদ্ধশালী এক জনপদে পরিণত হয়েছে। ভেনিসের ছোট ছোট দ্বীপগুলো চারশত সেতু দ্বারা সংযুক্ত! এর মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে অসংখ্য খাল। পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে শহর ভেনিস। মূল আকর্ষণের ঐতিহাসিক স্থানগুলো হেঁটেই দেখতে হয়। গাড়ি বা অন্য কোন যানবাহনে চলাফেরার কোন সুযোগ নেই। ঐতিহাসিক জায়গাগুলো দেখতে গেলে গলির মতো অপ্রশস্ত রাস্তা ধরেই যেতে হয়। প্রাচীন ঐতিহ্যের সব কিছুই অবিকৃত রেখে দেওয়া হয়েছে। শহর জুড়েই গ্রান্ড ক্যনালের জল ধারা কল কল রবে ছুটে চলেছে। এক রাস্তার সাথে অন্য রাস্তা সংযুক্ত করা হয়েছে ছোট ছোট সেতু দিয়ে। গলির দুই পাশ দিয়েই পুরনো দিনের বাড়ি-ঘর। অতীতকে ধ্বংস না করে কিভাবে ভবিষ্যতকে নির্মাণ করা যায়-সেটা এসব দেশে না এলে বোঝা যায় না।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী টেরাকোটা আর্মি
ভেনিসের মূল আকর্ষণ ‘গন্ডোলা’। ভেনিসের ঐতিহ্যবাহী এই নৌকায় না চড়লে ভেনিস দেখা অর্থহীন বলে আমার মনে হয়। গন্ডোলা ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের নৌযানে ভেনিসের খালে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পর্যটকদের রয়েছে। অন্য নৌযানের ভাড়াও তুলনামূলকভাবে কম। তবে ভেনিস দেখতে গিয়ে গন্ডোলায় না চড়লে ভেনিস দেখাটা মনে হয় অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। গন্ডোলায় একসাথে চারজন বসার ব্যবস্থা রয়েছে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ভাড়া আশি ইউরো! তবে আজাদ সাহেব জানালেন, স্থানভেদে কোনও কোনও গন্ডোলার ভাড়া দেড়শ ইউরোও হয়ে থাকে। একজন মাঝি বৈঠা হাতে অত্যন্ত দক্ষ হাতে গন্ডোলা চালায়। অসংখ্য খাল এবং ছোট ছোট সেতুর নীচ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের নৌযানকে পাশ কাটিয়ে বৈঠা হাতে গন্ডোলা চালানো বেশ কৌশলের কাজ। এজন্য গন্ডোলার মাঝিকে রীতিমতো ট্রেনিং নিতে হয়।
গন্ডোলা ভ্রমণ শেষ হলে আজাদ সাহেব আমাদের নিয়ে গেলেন আরও কয়েকটি জায়গা দেখাতে। এ সময় আজাদ সাহেব শাইখ আহমেদ নামে আর এক প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভেনিসের একটা খোলা চত্বরে একটা ছোট মনিহারী দোকান। আমাদের সাথে আলাপ শেষে তাঁর দোকানের কিছু ‘স্যুভেনীড়’ আমাদের উপহার দিলেন।
শিহাব আহমেদ সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আবার ভেনিসের কিছু প্রাচীন ঐতিহ্য দেখতে গেলাম। আমাদের এবারের গন্তব্য সেইন্ট মার্ক স্কয়ার বা পিয়াজ্জা সান মার্কো (Piazza san Marco)। সেইন্ট মার্ক স্কয়ার ভেনিসের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থান। মধ্য যুগ থেকে এ স্থানকে ভেনিসের কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই স্কয়ার বা চত্বরকে ভেনিসের সর্বাধিক পরিদর্শিত স্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। মার্কস স্কয়ারের চারপাশেই প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো গড়ে ওঠেছে। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন এই স্কয়ারের সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, এর নাম দিয়েছিলেন পৃথিবীর বৈঠকখানা। উনিশ শতক থেকেই এখানে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অফিস এবং ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী ঘুরে এলাম পর্তুগাল
ভেনিসের প্রধান ক্যাথিড্রাল সেইন্ট মার্ক গির্জাও এই স্কয়ারে। নবম শতাব্দীতে সাধু-সন্তদের দেহাবশেষ রাখার জন্য এটা নির্মাণ করা হয়। ওই সময় ভেনিসের বনিকেরা মিশর থেকে সাধু-সন্তদের মৃতদেহ পাচার করতো। নির্মাণের শুরুর দিকে এটি আগুনে পুড়ে যায়। পরবর্তীতে সেইন্ট মার্ক ব্যাসিলিকাকে এক অসাধারণ স্থাপত্য রুপে গড়ে তোলা হয়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনা সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে একে ধাপে ধাপে তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানের যে ব্যাসিলিকা দেখা যায়, তা বহু জাতির অবদানের সাক্ষী। বাইজান্টাইন স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন ‘সেইন্ট মার্ক ব্যাসিলিকা’। তার সাথে যুক্ত করা হয়েছে গ্রীক স্থাপত্য শৈলীর অনুকরণে স্বর্ণের ব্যবহার। যে কারণে সেইন্ট ব্যাসিলিকাকে ‘স্বর্ণের গীর্জা’ বলা হয়।
মার্কস স্কয়ারে মাঝখানে রয়েছে নবম শতাব্দীতে নির্মিত ‘বেল টাওয়ার’ নামের ৯৯ মিটার উঁচু এক টাওয়ার। সমুদ্রে জাহাজের এবং বহিঃশত্রুর উপর নজর রাখার জন্য টাওয়ারটি নির্মাণ করা হয়। ১৯০২ সালে টাওয়ারটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে সেইন্ট ব্যাসিলিকার উপর পড়ে, এর একটি কলাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে বিষয়টি প্রচারিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় এটি পুনঃনির্মিত হয়।
আরও পড়ন ভ্রমণকাহিনী কুনমিংয়ের বৃষ্টি ও শৈশবের বৃষ্টিবিলাস
মার্কস স্কয়ারে গেলেই চোখে পড়বে ষোড়শ শতকের শেষের দিকে তৈরি রিয়াল্টো ব্রিজ বা ‘পন্টে ডি রিয়াল্টো’ (Ponte de Rialto)। ভেনিসের প্রাচীনতম সেতু। রেনেসাঁ যুগের স্থাপত্য ও প্রকৌশল বিদ্যার এক আশ্চর্য নিদর্শন। আন্তোনিও দি পন্তে নামের একজন প্রকৌশলী ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আন্তোনিও কনটিনো এর নকশা তৈরি করেন। গ্রান্ড ক্যানেলের অপ্রশস্ত অংশে একটি মাত্র স্পানের উপর ছোট্ট একটি সেতু। নির্মাণ শৈলীর কারণে এই ছোট্ট সেতুটিই ভেনিসের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। গ্র্যান্ড ক্যানেলের উপর নির্মিত এ সেতু ভেনিসের পরিবহন এবং ব্যবসা- বাণিজ্যের প্রাণ।
আরও পড়ুন রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (১ম পর্ব)