রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (শেষ পর্ব)
রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (শেষ পর্ব)
রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতাধর সম্রাটদের পতনের পর সাম্রাজ্যের ক্ষমতা চলে যায় চার্চের বা গির্জার হাতে এবং কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত গির্জার মাধ্যমেই রোমান সাম্রাজ্য পরিচালিত হতে থাকে। রেঁনেসাসের শুরু থেকে প্রায় সব পোপই রোম শহরটিকে শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত করার চেষ্টা চালিয়ে যান। রেঁনেসাস স্থপতিরা রোমকে তাঁদের স্থাপত্য কর্মের কেন্দ্রে পরিণত করেন এবং শহরটি জুড়ে শ্রেষ্ঠ সব শিল্প কর্ম তৈরি করেন। রোম ১৮৭১ সালে ইতালিয় রাজ্যের এবং ১৯৪৬ সালে স্বাধীন ইতালির রাজধানী হয়। রোমের সব প্রাচীন স্থাপনাই ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।
‘ভ্যাটিক্যান সিটি’ বা পোপের দেশ! এক দেশের অভ্যন্তরে আরেক দেশ! বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতা হারানোর পর পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম স্বাধীন রাষ্ট্র ভ্যাটিক্যান সিটির কর্নধার হন ‘মহামান্য পোপ’। ইতালির রাজধানী রোমের অভ্যন্তরে মাত্র ১০৯ একরেরও কম আয়তনের জায়গায় ‘ভ্যাটিক্যান সিটি’র অবস্থান! খ্রিস্টানদের ধর্ম গুরু পোপ এবং তিনিই ভ্যাটিক্যান সিটির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ভ্যাটিক্যান সিটির ইতিহাস বহু প্রাচীন। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৪০০ বছর পর সেইন্ট পিটার্সের কবরের উপর একটি গির্জা নির্মিত হলে ওই এলাকা একটি তীর্থ স্থান এবং বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হয়। ১০০৯ সালে পাপাল ( পোপের শাসনাধীন এলাকা) কোর্ট ফ্রান্সে স্থানান্তরিত হলে স্থানটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ১০৭৭ সালে এই গির্জা পুনরায় রোমে ফিরিয়ে আনলে এখানে আ্যপস্টলিক প্যালেস (ঈশ্বরের প্রেরিত দেবদূত) সিস্টিন চ্যাপেল (পোপের ব্যক্তিগত প্রাসাদ) ‘সেইন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা’ ভ্যাটিক্যান সিটির সীমানার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আরও পড়ুন ভ্রমণ কাহিনী নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেশে
এসব চ্যাপেলের মধ্যে সিস্টিন চ্যাপেলে রেঁনেসাস যুগের বিশ্ব বিখ্যাত চিত্রকর মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর আঁকা অসাধারণ সব চিত্র কর্ম স্থান পেয়েছে। বছরে প্রায় ৬০ লক্ষ পর্যটক এই চ্যাপেল দেখতে যায়!
১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত ইতালিতে চার্চের প্রভাব ছিল বলতে গেলে এক চেটিয়া। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব ইউরোপের সব দেশের গির্জার আধিপত্যে আঘাত হানে। ১৮৪৮ সালে ইতালিতে অস্ট্রিয়ান আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সংগ্রামের মাধ্যমে এক বিপ্লব সংঘটিত হয়। এ বিপ্লব সম্পূর্ণভাবে সফল না হলেও চার্চের শাসনে একটা বড় ধাক্কা দেয়। ১৮৭০ সালে ৯ম পোপ রাজত্বের সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। মূলত সেই সময় থেকেই রোমান সাম্রাজ্যের পতনের শুরু হয়। ১৯২৯ সালে সম্রাট ৩য় ভিক্টর ইমানুয়েল এবং পোপ একাদশ পায়ার্সের মধ্যে ‘ল্যাটারান’ নামের এক চুক্তির মাধ্যমে ইতালি এবং ভ্যাটিকান সিটি-উভয়ই স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে প্রাচীন সভ্যতার লীলা ভূমি রোমের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস।
ইতালিতে রয়েছে লাখ লাখ বাংলাদেসশি। ইতালির যেখানেই গেলাম, অভিবাসী বাংলাদেশির দেখা মিললো। ভ্যাটিকান সিটি দেখা শেষ করে ফেরার সময় এক বাংলাদেশি অভিবাসীর দোকান থেকে কিছু স্যুভেনির কিনলাম। রোম, মিলান কিংবা ভেনিসের মতো পরিচ্ছন্ন শহর নয়; রাস্তার এখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা যায় যা উন্নত দেশগুলিতে বিরল।
রোম ভ্রমণ শেষে আমরা আবার মিলানে ফিরে গেলাম জাবেদের বাসায়। পরদিন সকালেই মিলানোর গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা গুলো দেখতে গেলাম। মিলানোর অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান ‘ডুমো’। ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে মিলানোর আর্চবিশপ দুটি প্রাচীণ ক্যাথিড্রালের জায়গায় একটি নতুন ক্যাথিড্রাল নির্মাণের ঘোষণা দেন। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে। কয়েক শতাব্দী ধরে চলেছিল এর নির্মাণ কাজ। ১৯৬৫খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ প্রায় ৫৭৯ বছরে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়! তবে এর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী আমি ভিআইপি?
এরপর গেলাম ‘ডুমো দ্য মিলানো’তে। এটা পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম গির্জা। এই চার্চের অভ্যন্তরে ৩৫৬ ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট এক দন্ডের উপর স্থাপন করা হয়েছে সম্পূর্ণ স্বর্ণের তৈরি ‘মাতা মেরীর’ মূর্তি। ১ লক্ষ ৮৩ হাজার স্কয়ার ফুট আয়তনের বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই গির্জা। ফরাসি গথিক স্থাপত্যের এক বিস্ময়র সৃষ্টি এই ডুমো দ্য মিলানো। এর নকশা তৈরিতে অংশ নিয়েছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত চিত্র শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। গোলাপী আভা যুক্ত সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি এই ক্যাথিড্রাল! প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ একত্রে এই বিশাল গির্জায় প্রবেশ করতে পারে। এর অভ্যন্তরে রয়েছে বিশ্বখ্যাত চিত্র শিল্পীদের হাজার হাজার শিল্প কর্ম। গির্জার বিশাল চত্বরে একটু দূরে দূরেই তৈরি করে রাখা হয়েছে অনবদ্য সব ভাস্কর্য।
‘লাস্ট সাপার মিউজিয়াম’ রেনেসাঁ যুগের বিশ্বখ্যাত আর এক যাদুঘর। এই যাদুঘরে স্থান পেয়েছে লিওনার্দো দ ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্র ‘দি লাস্ট সাপার’। খ্রিস্টান ধর্মালম্বীরা বিশ্বাস করেন যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করার আগে তিনি তাঁর বার জন সঙ্গীকে নিয়ে যে শেষ আহার করেছিলেন, সেই দৃশ্যাবলী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে অংকন করেন। এই চিত্র কর্মে মানুষের আবেগ, অনুভূতি সহ মানব চরিত্রের বিভিন্ন দিক অসাধারণ ভাবে ফুটে উঠেছে। এই চিত্র কর্ম দেখার জন্য শিল্প বোদ্ধারা ছাড়াও অসংখ্য মানুষ এই যাদুঘরে ভীড় জমায়।
স্ফোরজা ক্যাসল বা স্ফোরজেসকো (Sforzesco Castle) মিলানোর আরও একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটিও একইভাবে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। রেনেসাঁস যুগে মিলানোর ডিউক লুডোভিকো স্ফোরজার (Ludoviko Sforza) বাসভবনের জন্য এই ক্যাসলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রাচীন একটি দূর্গের উপর এই ক্যাসল তৈরি করা হয়েছে। এই ক্যাসলের অভ্যন্তরে রয়েছে একটি যাদুঘর। যাদুঘরে রয়েছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম। পরবর্তী সময়ে রেনেসাঁস যুগের আরেক কিংবদন্তি শিল্পী মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর দক্ষ হাতে এইসব চিত্র কর্ম আরও উৎকর্ষতা পায়। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি প্রথমে ডিউকের সেনাবাহিনীতে কাজ শুরু করেন, পরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে এবং সবশেষে চিত্র শিল্পী হিসাবে ডিউকের প্রাসাদে যোগ দেন।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী ঘুরে এলাম পর্তুগাল
বছরে প্রায় দশ লক্ষ পর্যটক মিলানোর এই বিখ্যাত স্থাপনা দেখতে ভীড় করেন! মাত্র ৪ দিন ইতালি ভ্রমন করে ৩টি শহরের খানিকটা দেখা হল! কম পক্ষে মাস খানেক সময় নিয়ে ইতালি ভ্রমণ করলে আড়াই হাজারেরও বেশি পুরনো ঐতিহাসিক শহরটি দেখতে পারলে হয়তো এর খানিকটা দেখা সম্ভব সবটা নয়! ইতালির যে কোন স্থাপত্য দেখলেই বিস্ময়াভিভূত হতে হয় এবং মনে প্রশ্ন জাগে হাজার হাজার বছর আগে ইতালির শাসক গন স্থপতি এবং চিত্র শিল্পীদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এই সব অনবদ্য স্থাপনা গুলো তৈরি করেছিলেন যেগুলো দেখতে সারা বিশ্বের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পরে। ইতালি জুড়েই হয়তো চার্চের ছড়াছড়ি। তিনটি শহরেই যে ব্যাসিলিকা বা গির্জা দেখা হলো, তার প্রতিটিতেই মহা মূল্যবান রত্নরাজির ব্যবহার অবাক করার মতো! মহা পরাক্রমশালী সম্রাট এবং পরবর্তীতে গির্জার শাসন কালেও গির্জা নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় চোখে পড়ার মতো!
দেখতে দেখতে স্বপ্নের মতো উড়ে গেল চারটি দিন! বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এলো। জাবেদ, জাবেদের মা এবং স্ত্রী স্বর্নার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে আমরা জেনেভার বাস টার্মিনালের দিকে যাত্রা করলাম। বাস স্টেশনে পৌঁছে জানতে পারলাম, আমাদের বাস আধা ঘণ্টার মতো দেরিতে ছাড়বে। জাবেদের ড্রাইভার মিঃ সুনাক একজন শ্রীলঙ্কান। অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী এবং আন্তরিক মানুষ। দুদিনের পরিচয়েই আমাদের সাথে একটা হৃদ্যতাপূর্ন সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
ফুটবল প্রেমী মানুষদের নিকট ইতালির ‘এসি’ মিলান ফুটবল দল অনেকের কাছেই প্রিয়। বাস দেরিতে ছাড়বে জেনে মিঃ সুনাক আমাদেরকে নিয়ে গেলেন মিলানের বিখ্যাত ‘এসি মিলান’ স্টেডিয়াম দেখাতে। বিখ্যাত এই স্টেডিয়াম দেখা শেষ করে মিঃ সুনাকের নিকট বিদায় নিয়ে আমরা জেনেভার বাসে চড়ে বসলাম।
আরও পড়ুন রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (শেষ পর্ব)