রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (৩য় পর্ব)
রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (৩য় পর্ব)
রোম পর্যায়ক্রমে রোমান রাজ্য, রোমান প্রজাতন্ত্র এবং রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। টাইবার নদীর তীরে রোম। সাতটি পর্বত দিয়ে বেষ্টিত। প্রথম দিকে রোমান সভ্যতা গ্রীক সভ্যতার মতোই অনেকগুলো নগর রাষ্ট্রের সমষ্টি বা কনফেডারেশন ছিল, যার নাম ছিল ‘রিপাবলিকা বা প্রজাতন্ত্র’। সিনেটর বা জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শে রোম পরিচালিত হতো। রোম প্রজাতন্ত্রের স্থায়িত্বকাল ছিল পাঁচ শত বছর আর রাজতন্ত্র স্থায়ী হয়েছিল পনের শত বছর! এই দুই হাজার বছর মানব সভ্যতার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এর প্রভাব এবং ফলাফল আইনী ব্যবস্থা থেকে শুরু করে অদ্যাবধি অনেক কিছুতে রয়ে গেছে। ‘রোমান জাতি’ বসবাস করার কারণে এর নাম হয়েছে ‘রোম’।
জুলিয়াস সিজারের নাম কম বেশি আমাদের সবারই জানা। জুলিয়াস সিজার আর মিশরীয় সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রার প্রেমের কাহিনী নিয়ে কত গল্প, উপন্যাস বিশ্ব বিখ্যাত সব সিনেমা তৈরি হয়েছে। জুলিয়াস সিজার ছিলেন প্রজাতান্ত্রিক রোমের একজন জনপ্রিয় জেনারেল। তিনি রোমের আশেপাশের অনেক রাজ্য জয় করে রোমের বিস্তৃতি ঘটান। কালক্রমে তিনি একনায়ক হয়ে ওঠেন। তিনি সমৃদ্ধশালী মিশর জয় করেন এবং মিশরের রাণী ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। মূলত তাঁর সময়েই রোম প্রজাতন্ত্র থেকে সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। কাজেই জুলিয়াস সিজারকেই রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়। তবে জুলিয়াস সিজারের উত্থানে প্রজাতন্ত্রের অনেক সিনেটর ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন এবং জুলিয়াস সিজারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী চাইনিজ নট ও দারোয়ানের গল্প
শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ শতাব্দীতে ৪০-৬০ জন সিনেটর একযোগে তাঁকে আক্রমণ করে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন। তবে জুলিয়াস সিজারকে নৃশংসভাবে হত্যা করাকে রোমের জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। সিজারের মৃত্যুর পর তাঁর পালিত পুত্র অগাস্টাস রিপাবলিকানদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে রোমের সিংহাসনে বসেন। তাঁর সময়ে রোমান সাম্রাজ্য ইউরোপ ছাড়িয়ে আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। যিশু খ্রিস্টের জন্মের সময় অগাস্টাস সিজার রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের তারিখ পরিবর্তনেও জুলিয়াস সিজার এবং সম্রাট অগাস্টাস হাত দেন। জুলিয়াস সিজার নিজের নামের সাথে মিল রেখে জুলাই মাসের এবং অগাস্টাস অগাস্ট মাসের নামকরণ করেন। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে সম্রাট অগাস্টাসের হস্তক্ষেপের আগে জুলাই মাস ছিল ৩১ দিনে এবং অগাস্ট ছিল ৩০ দিনে। সম্রাট অগাস্টাস কেবলমাত্র নিজের নামে মাসের নামই করেননি আরও একধাপ এগিয়ে অগাস্ট মাস ৩১ দিন এবং ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিন করে দিয়েছেন!
রোমানরা ছিল বহু ঈশ্বরবাদী। একারণে শুরুতে রোমানরা খ্রিস্ট ধর্মের বিরোধী ছিল। যিশু খ্রিস্টের শিক্ষা অত্যাচারী রোমান শাসকেরা মেনে নিতে পারেনি। সে কারণে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী লোকজনের উপর অমানুষিক অত্যাচার শুরু করে রোমান শাসকেরা। শাসকেরা পছন্দ না করলেও জনসাধারণের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্ম ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ধীরে ধীরে উচ্চ শ্রেণির মানুষের মধ্যেও খ্রিস্ট ধর্ম প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। সম্রাট কনস্টানটাইন ৩১২ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। এর ৭০ বছর পর সম্রাট থিওডোসিয়াস খ্রিস্ট ধর্মকে রাজ ধর্মের মর্যাদা দেন। পরবর্তী এক হাজার বছর ধরে রোমানরাই এ ধর্মের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং রোম হয়ে ওঠে খ্রিস্ট ধর্মের সমার্থক। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর রোম ধীরে ধীরে পোপের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। রেনেসাঁসের শুরু থেকে পঞ্চম নিকোলাস ও সব পোপ রোমকে বিশ্বের শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী ঘুরে এলাম পর্তুগাল
যাহোক, রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস থেকে এবার রোমের বিশ্ব বিখ্যাত স্থাপনার দিকে যাওয়া যাক। প্রথমেই গেলাম রোমান সম্রাটদের নিষ্ঠুরতার প্রতীক ‘কলোসিয়াম’ দেখতে। রোমের কলোসিয়াম তৈরির সাথে জড়িয়ে আছে এক নিষ্ঠুর শাসকের নিষ্ঠুরতার ইতিহাস! এই নিষ্ঠুর শাসকের নাম ‘নিরো’। নিরোর নামের সাথে জড়িয়ে আছে একটি প্রবাদ আর তা হলো রোম যখন পুড়ছিলো, ‘নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ এই প্রবাদের কারণ হলো নিরো ছিলেন সবচেয়ে নিষ্ঠুর আর ক্ষমতা লোভী। সিংহাসনে বসার ক্ষেত্রে তাঁর ছোট ভাই যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেজন্য নিরো তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। মায়ের সাথে সমস্যা হওয়ায় মাকেও হত্যা করেন! অত্যাচারী শাসক হিসাবে রোমের সিনেট তাঁকে ‘জনগণের শত্রু’ আখ্যা দিলে তিনি প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং মাত্র ৩০ বছর বয়সে নিরো আত্মহত্যা করেন। নিরোর শাসন কালে তীব্র জনরোষ থেকে কয়েকটি গৃহযুদ্ধের অবতারণা হয়।
সে সময় রোমান সম্রাট ভেসপিয়ান জনতার সন্তুষ্টি এবং সাম্রাজ্যের হারানো খ্যাতি ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু স্থাপনা তৈরির ঘোষণা দেন। এর মধ্যে একটি ছিল এমন একটি বিনোদনের স্থান তৈরি করা-যেখানে হাজার হাজার মানুষ এক সাথে বসে কোন কিছু উপভোগ করবে। সম্রাট নিরোর গোল্ডেন প্যালেসের সামনে বিশাল বাগান ও ফোয়ারা ছিল। সেখানে এই কলোসিয়াম তৈরি কর হয়। ৭২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ভেসপিয়ানের সময় এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং এবং তাঁর পুত্র সম্রাট টিটোসের সময় শেষ হয়। ষাট হাজার ইহুদি শ্রমিক দিন রাত পরিশ্রম করে এক যুগেরও কম সময়ে এই কুখ্যাত বিনোদন স্থল কলোসিয়াম নির্মাণের কাজ শেষ করেন। কলোসিয়ামে মানুষের সাথে মানুষের (যাদেরকে গ্লাডিয়েটর বলা হতো) অথবা মানুষের সাথে হিংস্র পশুর (বাঘ, সিংহ, হাতী, চিতাবাঘ গন্ডার) খেলা চলতো! এই ভয়ংকর খেলায় হিংস্র পশুর সাথে লড়াই করে জীবন নিয়ে ফিরে আসার সৌভাগ্য কম মানুষেরই হতো। যারা হিংস্র পশুর সাথে লড়াই করে বেঁচে ফিরত তাদেরকে বীরের মর্যাদা দেওয়া হতো।
আরও পড়ুন আমাদের আত্রাই নদী
শিকারের জন্যও কলোসিয়াম ব্যবহৃত হতো। বিনোদনের জন্য একদিনে এক হাজার পশু পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে! ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট অনারিয়াস এই নিষ্ঠুর খেলা বন্ধ করলেও পরবর্তী আরও এক শত বছর পর্যন্ত মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের শাস্তি কলোসিয়ামে এ ভাবেই কার্যকর করা হতো! অপরাধীদের নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে অন্যদেরকেও সতর্ক বার্তা দেওয়া হতো। ৪২২ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্রাট তৃতীয় থিওডোসিয়াস ভ্যালেন্টাইন এর সংস্কার করেন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে সংস্কারের মাধ্যমে এটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে!
কলোসিয়ামে প্রবেশের জন্য ৮০টি দরজা রাখা হয়েছিলো। ৭৬ টি দরজা দিয়ে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতো, দুটি দিয়ে সম্রাট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রবেশের ব্যবস্থা ছিল। একটি দিয়ে বিজয়ী যোদ্ধারা বের হতেন, একটি দিয়ে পরাজিত হিংস্র পশুর মৃতদেহ কিংবা পরাজিত নিহত যোদ্ধার মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা হতো! মৃত গ্লাডিয়েটর অথবা পশুর রক্ত শুষে নেওয়ার জন্য পুরু বালির স্তর রাখা হয়েছিল। প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার দর্শক এক সঙ্গে বসে খেলা দেখতো; বাকী পাঁচ হাজার দাঁড়িয়ে এই নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর খেলা দেখতো! কি ভয়ংকর বিকৃত বিনোদন! তথাকথিত সভ্য মানুষের পক্ষেই কেবল এমন নিষ্ঠুর অমানবিক বিনোদন উপভোগ করা হয়তো সম্ভব!
রোমানরা এই একটি মাত্র স্থাপনা তৈরি করে পৃথিবীর সামনে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছিল। প্রতি বছর সারা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষ কলোসিয়াম দেখতে রোমে ছুটে যায়! যে কারণে কলোসিয়ামে প্রবেশের টিকেট পাওয়া বেশ কষ্টকর!
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী আমি ভিআইপি?
কলোসিয়াম দেখা শেষ করে আমরা রোমের আর একটি অনন্য সুন্দর স্থাপনা দেখতে গেলাম, সেটি হলো ‘ট্রেভি ফাউন্টেন’। ইতালিয়ান ভাষায় (Fontana di Trevi)। ট্রেভি ফাউন্টেনের পিছনে রয়েছে পালাজ্জো পলি (PalazzyPoli) নামের ‘বারোক’ ( স্থপতির তৈরি যোদ্ধা এবং বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি দ্বারা অলংকৃত প্রাসাদকে বারোক স্টাইল বলা হয়।) স্থাপত্যের এক প্রাসাদ। ১৫০০ শতাব্দীর এই প্রাসাদকে ১৭-১৮ শতকে সংস্কার করে এর সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়। প্রাচীন রোমের এক বিস্ময়কর স্থান এই প্রাসাদ এবং ঝর্ণা! প্রাসাদের সামনে ৮৫ ফুট উঁচু এবং ১৬০ ফুট প্রশস্ত এই ঝর্ণা । পক্ষিরাজ ঘোড়া, ঘোড়ার পাশেই কোন যোদ্ধা এবং এদের মুখ থেকে অবিরল ধারায় পানি পড়ছে সামনের বিশাল এক জলাশয়ে! হাজার হাজার মানুষ রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে এই অপরুপ দৃশ্য দেখছে, ভীড়ের কারণে ভাল ভাবে দেখার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়, কখন একটু জায়গা ফাঁকা পাওয়া যায়ন।
জলাশয়ে ডুবে আছে শত শত খুচরা মুদ্রা! দর্শকরা ডান হাতে বিভিন্ন মূল্য মানের ধাতব মুদ্রা হাতে নিয়ে পিছনে ঘুরে বাঁ কাঁধের উপর দিয়ে জলাশয়ে ছুঁড়ে ফেলছে, এই বিশ্বাস থেকে যে তারা মনে মনে যা আশা করবে, তাই পূরণ হবে! এভাবে পানিতে ছুঁড়ে ফেলা মুদ্রা পরে সংগ্রহ করা হয় এবং বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় প্রদান করা হয়। এভাবে পানিতে ছুঁড়ে ফেলা ‘কয়েন’ থেকে প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ ইউরো সংগৃহীত হয়!
আরও পড়ুন রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (৩য় পর্ব)