রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (২য় পর্ব)
রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (২য় পর্ব)
‘পালাজ্জো ডুকেল’ (Palazzo ducale) বা ডজের প্রাসাদ মার্কস স্কোয়ারের আরেক অনবদ্য সুন্দর স্থাপত্য। এটি ভেনিসের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে সুন্দর প্রাসাদগুলোর একটি। গথিক স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন এই পালাজ্জো ডুকেল। পালাজ্জো ডুকেল ছিলো ডজের বাসভবন। ডজ ছিলেন ভেনিসের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দ্বারা আজীবনের জন্য নির্বাচিত নেতা এবং ম্যাজিষ্ট্রট। ৭২৬-১৭২৭ শতাব্দী পর্যন্ত ডজ এর শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এই ব্যবস্থা কোন রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না, ছিল রীতিমতো গণতান্ত্রিক।
ডজের প্রাসাদের বাইরের দেয়াল স্বর্ণ এবং বহুমূল্য রত্ন খচিত! এই প্রাসাদের সাদা মার্বেল পাথরের থামের মাঝে রয়েছে দুটি গোলাপি রঙের থাম। এখান থেকেই ডুকেল অপরাধীদের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করতেন এবং এই থামেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হতো এবং জনসাধারণেকে প্রদর্শনের জন্য কয়েক দিন পর্যন্ত মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত ব্যক্তিকে এখানেই ঝুলিয়ে রাখা হতো যাতে অন্যরা অপরাধ করা থেকে বিরত থাকে।
গ্রান্ড ক্যানালের তীর ঘেঁষে রয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর আরও একটি প্রাচীন স্থাপত্য, স্যান্টা মারিয়া ডেলা স্যালুট (Santa Maria della Salute)। এটি একটি গির্জা। এই গির্জা নির্মাণের পিছনে রয়েছে একটি বেদনাদায়ক ইতিহাস। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে ভয়ংকর প্লে রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ মৃত্যুবরণ করে। তৎকালীন ডজ ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন। এই ভয়ংকর পরিস্থিতি জনসাধারণকে ধর্মের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করে। প্লেগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বেঁচে থাকা দশ হাজার মানুষ পিয়াজ্জা সান মার্কসে বা সেইন্ট মার্কস স্কয়ারে তিন দিন তিন রাত ক্রমাগত হাঁটতে থাকে এবং প্রার্থনা করতে থাকে প্লেগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য! তখনই তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা এমন একটি গির্জা তৈরি করবে যা আগে কেউ কখনও দেখেনি।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী চাইনিজ নট ও দারোয়ানের গল্প
জনতা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করে ব্যাসিলিকা স্যান্টা মারিয়া ডেলা স্যালুট গির্জা তৈরি করে। ১৬৩১ সাল এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৬৮১ সালে শেষ হয়। মাতা মেরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এই গির্জা তাঁকে উৎসর্গ করা হয়। যেহেতু প্লেগের মতো ভয়ংকর রোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এই গির্জা তৈরির অঙ্গিকার করা হয়েছিল তাই এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সেইন্ট মেরী অব দি হেলথ্’। ১৬৩১ সাল থেকে ভেনিসের বাসিন্দারা প্রতি বছর ২১ নভেম্বর সেইন্ট মার্কস স্কয়ারের এই গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করে। গির্জাটি চুনাপাথরে তৈরি এবং গির্জার অভ্যন্তরের বিভিন্ন বেদীতে মাতা মেরীর বা কুমারী মেরীর জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য সম্বলিত কারুকার্য স্থাপন করা হয়েছে।
ভেনিসের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দেখা অসমাপ্ত রেখে আজাদ সাহেব দুপুরের খাবারের জন্য আমাদের নিয়ে গেলেন একটি রেস্তোরাঁয়। সেখানে পরিচয় হলো মনোয়ার ক্লার্ক সরকার নামে এক ভদ্রলোকের সাথে। অত্যন্ত আন্তরিকতা পূর্ণ আচরণ। এক রকম জোর করেই আমাদের খাবারের মূল্য পরিশোধ করলেন। অত্যন্ত কর্মোদ্যমী মানুষ। অল্প বয়সে ভাগ্যান্বেষনে ভেনিসে এসেছেন। নিজের নামের সাথে ক্লার্ক জুড়ে দেওয়ার কাহিনী জানালেন। বাংলাদেশ থেকে ভেনিসে আসার পর ক্লার্ক পদবী ধারী এক পরিবারের সাথে তাঁদের বাসায় থাকতে শুরু করেন। ওই পরিবারের সহযোগিতায় তাঁর পক্ষে ইতালিতে থাকা এবং জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ হয়েছিল।
সেই কৃতজ্ঞতা থেকে মনোয়ার সাহেব নিজের ‘সরকার’ পদবীর সাথে ‘ক্লার্ক’ পদবীও যোগ করে নিয়েছেন। বর্তমানে ভদ্রলোক ভেনিসে ছয়টি আবাসিক হোটেল এবং একাধিক রেস্তোরাঁর মালিক! ইতালি ছাড়াও লন্ডনে তাঁর হোটেল ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন। নিকটেই তাঁর নিজস্ব একটি আবাসিক হোটেল আমাদের দেখাতে নিয়ে গেলেন। দুপুরের খাবারের পর আজাদ সাহেব আর একটি সুন্দর স্থান দেখাতে নিয়ে গেলেন। এবার কোন প্রাসাদ কিংবা গির্জা নয় এবার প্রকৃতির কাছে। এটি ঐতিহাসিক একটি পার্ক। এটি কেবলমাত্র ভেনিসের সবচেয়ে বড় পার্কই নয়, ইউরোপের অন্যতম বড় পার্ক। উনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ‘গিয়ার্দিনি ডেলা বিয়ান্নেলে’ (Giardini della Biannele) নামের এই পার্ক তৈরি করেছিলেন। এখানে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী চৈনিক দাওয়াই বাওহে ওয়ান
ভেনিসের অপরুপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মন ভরে গেল! আমাদের পরের গন্তব্য প্রাচীন সভ্যতার আরেক লীলাভূমি ইটালির রাজধানী রোম।
‘রোম’ ভ্রমণ শুরু করার আগে ভেনিসে আমাদের সারাদিনের সহযোগী আজাদ খান সাহেবের কথা না জানালে তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞা প্রকাশ করা হবে। এমন পরোপকারী, অমায়িক মাটির মানুষ সচরাচর চোখে পড়ে না। জাবেদের গাড়ি আমাদের যখন ভেনিসে পৌঁছে দিল, তখন রাত দুইটা। পরদিন সকল আটটায় আজাদ সাহেব আমাদের হোটেলের সামনে তাঁর গাড়ি নিয়ে উপস্থিত এবং নিজের কাজ-কর্ম স্থগিত রেখে সারা দিন ঘুরে ঘুরে আমাদেরকে ভেনিস দেখালেন! সন্ধ্যায় আামাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিলেন। পরের দিন আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিতে আবার তাঁর গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। কিন্তু তারপরও আজাদ সাহেবের ঋণ মুক্ত হতে পারি নাই আমরা!
রোম যাত্রায় ঘটলো এক বিপত্তি। রোম যাওয়ার জন্য আগেই ট্রেনের টিকেট কাটা হয়েছিল। আজাদ খান আমদের পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের কারণে আমদের স্টেশনে পৌঁছাতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। যাহোক, আমরা রীতিমতো দৌড়ে ট্রেনে উঠতে গেলাম। কিন্তু প্লাটফর্মে ঢোকার আগেই একজন আমাদের জানালেন, দূর্ঘটনার কারণে আমাদের রোমের ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে আজাদ সাহেবকে ফোন করা হলে উনি আবার আমাদেরকে নিতে স্টেশনে হাজির। আমাদেরকে একটা রেস্তোরাঁয় খাবার খাইয়ে একজন বাংলাদেশির গাড়ি ভাড়ায় ঠিক করে দিলেন। জাবেদের কাছে জানা গেল, আজাদ সাহেবের এই পরোপকারী মনোভাব কেবলমাত্র আমাদের জন্য নয়, যখনই বাংলাদেশের কোন মানুষ ভেনিসে বেড়াতে যায়, মিলানোর কনসুলেট আজাদ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী টেরাকোটা আর্মি
শুধুমাত্র পরোপকার করাই নয়, বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি নিয়েও কাজ করে চলেছেন আজাদ সাহেব। কয়েকজন বাংলাদেশি মিলে ‘ভেনিস বাংলা স্কুল’ এবং ‘ভেনিস বাংলা মিউজিক’ প্রতিষ্ঠা করেছেন! নিজেও গানের সঙ্গে বাদ্য যন্ত্রে সংগীত করেন। নিজের সন্তানদেরও বাংলার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন! নিজের কাজের ক্ষতি করে আমাদেরকে এত সময় দেওয়ার কথা বলে ধন্যবাদ জানালে জবাব দিলেন, কাজ তো সব সময়ই করি, বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষদের দেখা পাওয়া কিংবা তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ তো তেমন একটা হয় না! কাজেই বাংলাদেশের কোন মানুষের দেখা পেলে মনটা খুশিতে ভরে যায়।
সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ, অথচ আমাদের জন্য এত কিছু করলেন আপন জনের মতো। এমন একজন ভাল মানুষের নিকট থেকে বিদায় নিতে গিয়ে আমাদের মনও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। আজাদ সাহেবের সাথে আর কোনদিনও দেখা হবে না হয়তো। তবে মহৎপ্রাণ এই মানুষটির কথা মনে থাকবে সারাজীবন।
বিকাল প্রায় পাঁচটায় আমরা রোমে পৌছালাম। মোহাম্মদ ইউসুফ নামে এক বাংলাদেশী মালিকের হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশি লোকজনের আতিথেয়তা মুগ্ধ করার মতোই! বাঙালি যে স্বভাবগত ভাবেই অতিথিপরায়ণ, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। উন্নত দেশের মানুষেরা অতিথির জন্য এক টাকাও খরচ করে না! কয়েকটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা রোমে অবস্থান কালে ইউসুফ সাহেব একদিন আমাদের জন্য হোটেল রুমে ইতালির ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘পিজ্জা’ পাঠালেন। শুধু তাই নয়, রোমের হোটেলে দুই দিন অবস্থান করা বাবদ ইউসুফ সাহেব আমাদের নিকট থেকে কোন ‘বিল’ পরিশোধ করতে দিলেন না! অর্থ গ্রহণ না করার বিষয়ে বললেন, “আমরা প্রবাসীরা আপনজনদের ছেড়ে বিদেশে থাকি, কাজেই কোন বাংলাদেশির দেখা পেলে, তাদের সাথে খানিকটা সময় কাটাতে পারলে মনটা খুশিতে ভরে যায়। অনেক অর্থই তো রোজগার করি, দেশের মানুষের দেখা তো সব সময় পাই না।”
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী ঘুরে এলাম পর্তুগাল
ইটালির বাংলাদেশ দূতাবাসের গাড়ি বিকেলেই আমাদেরকে রোমের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দেখাতে নিয়ে গেল। রোমকে বৈশ্বিক শহর বা সাম্রাজ্যিক শহরও বলা হয়।
রোম শহরটিকেই একটি যাদুঘর মনে হয়। কারণ এর রাস্তাগুলো প্রাচীন আমলের ঘোড়ায় টানা গাড়ির চলার মতোই অবিকল রেখে দেওয়া হয়েছে! পাথরের তৈরি রাস্তা কিছুটা ফাঁকা রেখে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল ঘোড়ার যাতে খুড় ফেলতে কোন সমস্যা না হয়। আশেপাশের বেশির ভাগ স্থাপনায় প্রাচীন ঐতিহ্য বিদ্যমান।
একটি প্রবাদ আছে ‘Rome was not built in a day’. সত্যিই রোম একদিনে তৈরি হয়নি। প্রায় ২৮ শতাব্দীর বেশি সময় সময় ধরে রোমের ইতিহাস বিস্তৃত! খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ অব্দের কাছাকাছি সময়ে রোম প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ইউরোপের তথা পৃথিবীর প্রাচীনতম মানব বসতিগুলোর অন্যতম!
আরও পড়ুন রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
রোমান সাম্রাজ্যে কয়েক দিন (২য় পর্ব)