রোদেলা-দুপুর-কাঁদে-১ম-পর্ব
খলিফা আশরাফ (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

রোদেলা দুপুর কাঁদে (১ম পর্ব)

রোদেলা দুপুর কাঁদে (১ম পর্ব)

খলিফা আশরাফ

 

বিকেলের কফি হাতে বারান্দায় বসেছে অনিমা। সপ্তাহ দুয়েক আগে PhD সেরে আবার ভার্সিটিতে যোগদান করেছে সে। বাসায় দূর সম্পর্কের এক খালা আর একটা ছোট কাজের মেয়ে থাকে তার সঙ্গে। ভার্সিটির একই বিল্ডিংয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষক থাকেন। অনিমা থাকে তিন তলায়। কোলাহলমুক্ত ছিমছাম এলাকা। বিকেলে বারান্দায় বসে কফি খেতে বেশ ভালোই লাগে। হঠাৎ একটা ইগড গাড়ি এসে নিচে দাঁড়ালো। ড্রাইভার ত্বরিত দরজা খুলে দিতেই একজন সৌমশ্রী প্রোঢ় ভদ্রলোক নামলেন। অনিমা জানে, তার কোন গেস্ট আসার কথা নয়। কফিতে চুমুক দিলো সে। কিন্তু বেল বাজছে তার ফ্লাটেই। এগিয়ে গেলো অনিমা। কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিলো। ভদ্রলোক তাকে দেখে বললেন,

‘আমি অনিমা ইসলামকে চাইছিলাম’।
‘আমিই অনিমা’, বললো সে।
‘মা, আমি অনিকের বাবা। তুমি কি আমাকে দু’মিনিট সময় দিতে পারো?’
বিনীত আর্জি ভদ্রলোকের কণ্ঠে।
অনিকের বাবা! নিউরোনের কোষগুলো নড়ে উঠলো যেন। সেন্সরি নিউরোনে প্রবল ধাক্কা। কোনমতে সামলে নিয়ে অনিমা বললো,
‘আসুন’।

আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ

কাজের মেয়েটাকে নাস্তর ইশারা দিয়ে অনিকের বাবাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসলো অনিমা। কোন রকম সৌজন্য বা ভণিতা না করেই ভদ্রলোক হাত জোড় করে বললেন,
‘তুমি আমার ছেলেটাকে বাঁচাও মা। ও মরে যাচ্ছে’।
কথাটা শুনতেই উদ্গ্রীব হয়ে উঠলো মন, ভেতরটা হুহু করে কেঁদে উঠলো অনিমার। গভীর উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞাসা করলো,
‘কেন, কি হয়েছে অনিকের’?
উথলে ওঠা আবেগের প্রাবল্যকে দ্রুত সংযত করলো সে। হৃদয়ের উত্থাল পাথালকে সংহত করলো কষ্টের কাঠিন্যে। চকিতে মনে পড়লো তার নিদারুণ প্রত্যাখানের কথা। এই সেই অহংকারী দাপুটে শিল্পপতি মি. চৌধুরী, যিনি তার আরাধ্য স্বপ্নকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছিলেন, ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন নির্দয় অবজ্ঞায়। অনিমার চোয়াল দৃঢ় হল, ইস্পাতের মতো কঠিন মুখে বললো,
‘আমি ওই অধ্যায় আমার জীবন থেকে মুছে ফেলেছি মি. চৌধুরী’।
ততোক্ষণে নাস্তা এসে গেছে। সামনে কফির পেয়ালায় ধোঁয়া উড়ছে। চৌধুরী সাহেবকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজে তুলে নিলো এক কাপ। ভাবলেশহীন পাথুরে চেহারা অনিমার। বারবার ক্ষমা চাইলেন মি. চৌধুরী। অনুতাপের অশ্রু তার চোখে। কিন্তু অনিমা অনড়, কঠিন। তার একই কথা, অতীতকে টানতে চায় না সে । বৃদ্ধের করুণ আকুতি,
‘তুমি আমাকে ক্ষমা করো মা। আমি তোমার পায়ে পরছি’।

আরও পড়ুন গল্প দীপ্তিদের দেবতা

আক্ষরিক অর্থেই অনিমার পায়ে হাত দিতে গেলেন তিনি। তাড়াতাড়ি সরে গেলো অনিমা।
‘ছি ছি একি করছেন ? আপনি আমার বাবার বয়েসি। তাঁকে ধরে সোফায় বসালো অনিমা। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই তিনি বললেন,
‘বাবাকে কি ক্ষমা করা যায় না মা? শুধু একবার তুমি অনিককে দেখে এসো। ও মরে যাবে মা। তুমি ওকে বাঁচাও”।
করুণ চোখে চেয়ে আছে মি. চৌধুরী। এত দিনের অবরুদ্ধ ভালোবাসার প্লাবন ফুঁসে উঠছে, কঠোরতার বাঁধকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে চাইছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে অনিমা বললো,
‘আমাকে ভাবতে সময় দিতে হবে’।
‘ঠিক আছে মা। আমি আবার কাল আসবো’। চোখ মুছতে মুছতে বেড়িয়ে গেলেন তিনি।

চৌধুরী সাহেব বেড়িয়ে যেতেই নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়লো অনিমা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে অনিকের জন্য। কি হয়েছে অনিকের? কেন তার বাবা এমন করে বলছে? নিষ্করুণ যন্ত্রণায় ছটফট করছে অনিমা। গভীরভাবে ভালোবাসে সে অনিককে। আজও সেই ভালোবাসা নিবিড় জড়িয়ে আছে তাকে, একটুও মলিন হয়নি, বিস্তৃত হয়নি কোনো কিছুই। ৪/৫ বছর দেখা হয়নি দু’জনার, কিন্তু সেই বিচ্ছিন্নতা কেবলই চোখের, অন্তরে তার শ্বাশত অধিষ্ঠান, ‘নয়ন সন্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’।

আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী নেপোলিয়ান বোনাপার্টের দেশে

সত্যিকার প্রেম কখনো মরে না, বিরহ তাকে আরও প্রগাঢ় করে। প্রেমের অনির্বাণ শিখা আঁধারেও পথ দেখায়। স্মৃতিগুলো একে একে ভেসে উঠছে অনিমার মনের পর্দায়। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করার গৌরব নিয়ে অনিমা যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয় তখন কেন যেন ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিজ্ঞানের কোন শাখায় না গিয়ে ইকোনমিক্স তার বেশি পছন্দ হয়েছিলো। অনেকে তাকে ইংরেজি সাহিত্য পড়ার কথাও বলেছিলো, তখন তার দু’একটি লেখা সাহিত্য পাতায় প্রকাশ হচ্ছিলো, কিন্তু তাতে মন টানেনি অনিমার। তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিলো, ইকোনমিক্সেই ‘টপ স্কোর’ করতে পারবে সে।

ভর্তি হয়ে দেখলো, বেশ কিছু স্ট্যান্ড করা ছাত্র/ছাত্রী আছে ইকোনমিক্সে, ভালোদের ছড়াছড়ি। অনিক নামের ছেলেটাও ডাবল স্ট্যান্ড করা, লড়াইটা তার সাথেই। দু/চার নম্বরের হেরফেরে অবস্থান এদিক ওদিক হচ্ছে। খুব বড়লোকের ছেলে, নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আসে। দারুণ সপ্রতিভ, কোন দেমাগ নেই, ভীষণ আড্ডাবাজ, মাতিয়ে রাখে সবাইকে। পক্ষান্তরে অনিমা অনেকটাই অন্তর্মুখী, পড়াশুনা, ক্লাশ, লাইব্রেরি আর হল, এই তার পরিসীমা। মাঝেমধ্যে টিএসসিতে কোন সাহিত্য আলোচনা হলে যায় সে।

পত্রিকায় টুকটাক লেখালেখি করে, কিন্তু কোন আড্ডাবাজিতে থাকে না সে। তবে কারো সাথেই অসদ্ভাব নেই তার, সবার সাথেই প্রাণবন্তু, হাসিখুশি। তারপরও সকলের মধ্যে থেকেও সে যেন একটু আলাদা। এই আলাদা ভাবটাই দৃষ্টি কেড়েছিলো অনিকের। তাদের মধ্যে পড়াশুনায় প্রতিযোগিতা থাকলেও ঈর্ষা ছিলো না। বরং মধুর লড়াইটা দু’জনেই উপভোগ করতো।

আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি

দারুণ সুন্দরী ছিলো অনিমা। যেমন গায়ের রং, তেমনি মায়াময় চেহারা। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু লম্বা, হালকা পাতলা গড়ন। যে কারোর চোখে পড়ার মতো। সে ইচ্ছে করেই কারো সাথে তেমন ঘনিষ্ট হোত না। একটা স্বাতন্ত্র বজায় রাখতো। স্বাতন্ত্রের বেড়া ভাঙ্গতে অনিকই প্রথম এগিয়ে এসেছিলো। লাইব্রেরি ওয়ার্কের সময় রেফারেন্স বই নিয়ে আলোচনা, নোট করা ইত্যাদি বিষয়ে অনিকই আগ বাড়িয়ে কথা বলতো অনিমার সাথে। প্রথম দিকে জড়তা থাকলেও অনিকের সদাচার আর সহযোগিতা করার মানসিকতা সেই আড়ষ্টতা সহজেই ভেঙ্গে দিয়েছিলো। ধীরে ধীরে তারা দু’জন ভালো বন্ধু হয়ে উঠলো। টিএসসিতে সাহিত্য আলোচনাতেও একসাথে যেতো, কিন্তু বসে অখণ্ড আড্ডা দেয়া কখনো হয়নি।

ভেতরে দু’জনের ভাঙ্গাগড়া চললেও মুখ ফুটে বলেনি কেউ। অনার্সের ফার্স্ট, সেকেন্ড ইয়ারে অনিমা প্রথম অনিক দ্বিতীয়। অনিকই কংগ্রাচুলেট করলো অনিমাকে। একেবারে স্বচ্ছন্দ, কোন ঈর্ষাকাতরতা নেই। যেন ওর ফার্স্ট হওয়াতেই সে বেশি খুশি। অনিকের এই ঔদার্য অনুভূতিপ্রবণ করে তোলে অনিমাকে। সময়ের পরিক্রমা আরও কাছে নিয়ে আসে তাদের। কিন্তু মুখ খোলেনি কেউই। সতীর্থদের মধ্যে নানা গুঞ্জন, সবই ওরা হেসে নাকচ করে দেয়। এভাবেই প্রায় আড়াই বছর কেটে গেলো। হঠাৎ একদিন অনিকের দেয়া বইয়ের মধ্যে একটা চিঠি পেলো অনিমা। অনিক লিখেছে,

অনিমা,

তোমাকে আমার মনের কথা বলা হয়নি কখনো, বলতে পারিনি আমি। কিন্তু ভালোবাসা যখন শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে হৃদয়কে জড়িয়ে ফেলে, তখন সাড়া না দিয়ে আর কোন উপায় থাকে না। ভেতরের রক্তক্ষরণে আমি ক্লান্ত, অব্যক্তের দুঃসহ ভার আমি আর বইতে পারছি না অনিমা। আমি তোমাকে ভালোবাসি অনিমা।

অনিক

আরও পড়ুন রোদেলা দুপুর কাঁদে-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

রোদেলা দুপুর কাঁদে (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

খলিফা আশরাফ জীবন ঘনিষ্ঠ একজন কবি ও গল্পকার। তাঁর লেখায় মূর্ত হয়ে ওঠে সমসাময়িক কাল, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার বিপর্যয় এবং মানুষের অভাবিত সার্থলোলুপতার ক্লিষ্ট চিত্র। তিনি বৈরী সময়কে গভীর ব্যঞ্জনায় অনুপম রূপায়ন করেন তাঁর লেখায়, সামাজিক অন্যায় অসঙ্গতি এবং নির্মমতার কারুণ্য ফুটিয়ে তোলেন অন্তর্গত তীক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: বিপরীত করতলে, কালানলে অহর্নিশ, অস্তিত্বে লোবানের ঘ্রাণ; গল্পগ্রন্থ: বিল্লা রাজাকার ও সেই ছেলেটি, অগ্নিঝড়া একাত্তুর, একাত্তরের মোমেনা, পাথরে শৈবাল খেলে; ছড়াগ্ৰন্থ: ভুতুড়ে হাওয়া, কাটুশ-কুটুশ। তিনি  ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। 

error: Content is protected !!