রোদেলা দুপুর কাঁদে (শেষ পর্ব)
রোদেলা দুপুর কাঁদে (শেষ পর্ব)
অনিকের অসুস্থতার মধ্যেই মাস্টার্সের রেজাল্ট হয়ে গেলো। রেকর্ড নম্বর পেয়ে অনিমা ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কিছুদিনের মধ্যেই ভার্সিটির ডাক পেলো শিক্ষকতার জন্য। যোগদান করলো সে। কিন্তু এই অর্জনে তাঁর কোন উচ্ছ্বাস নেই, বরং সারাক্ষণ অন্তর্দহনে পুড়ছিলো অনিমা। তার সঙ্গে আর এক সহপাঠী, যে শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছে, অনিক থাকলে সেই-ই আসতো সেখানে। প্রতি মুহূর্তে অনিকের শূন্যতা কুরে কুরে খায় তাকে। বাবা বারবার বিয়ের কথা বললেও উচ্চতর ডিগ্রীর অজুহাতে এড়িয়ে যায় সে। সে ভালো করেই জানে, তাঁর হৃদয়ে অনিকের জন্য যে জায়গা, অন্য কাউকে দিয়েই তা পূর্ণ হবে না। হয়তো আজীবন এই শুন্যতাই বয়ে বেড়াতে হবে তাকে।
বছর না ঘুরতেই ইংল্যান্ডে PhD করার সুযোগ পেলো সে। চলে গেলো অনিমা। এই দীর্ঘ সময়ে অনিকের কোন খোঁজ নিতে পারেনি অনিমা। কারণ কারো সাথেই কখনো এ ব্যাপারে আলাপ করেনি সে। PhD শেষ করে মাত্র দু’সপ্তাহ এসেছে অনিমা। একটু থিতু হবার আগেই আজ অনিকের বাবার আগমন। হয়তো ওর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলেন তিনি। বাবার মন সর্বদাই সন্তানের জন্য উদগ্রীব থাকে। সেটা সে বুঝেছে নিজের বাবাকে দিয়ে। তাঁর দুঃসময়ে বাবার নীরব ক্রন্দন আর ব্যাগ্রতা দেখেছে সে। আজ অনিকের জন্য মি. চৌধুরীও সব আভিজাত্য, অহংকার, মান-সম্মান পিছনে ফেলেই ছুটে এসেছেন তার কাছে।
আরও পড়ুন গল্প জারজ
অনিকের চিঠিটা তখনো হাতে ধরা অনিমার। কাঁদছে সে। কিছুতেই কান্নাকে থামাতে পারছে না। বারবার অনিকের চেহারা ভেসে উঠছে, কি করুণ মিনতি তার চোখে! উদগত অশ্রুর প্লাবন বাঁধ ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসছে। আবার বিছানায় লুটিয়ে পড়লো অনিমা। কাঁদতে কাঁদতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে সে। খাবার জন্য খালা এসে যখন ডাকলো, তখন রাত সাড়ে দশটা। খেতে ইচ্ছে করছে না অনিমার। ডিনার করবে না বলে শুধু এক কাপ কফি দিতে বললো খালাকে। ইংল্যান্ডে থাকতেই কফির অভ্যাসটা হয়ে গেছে তার। পাশেই অনিকের চিঠিটা পড়ে আছে। সেটা তুলে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো আনিমা। অনিকের স্পর্শ পাচ্ছে সে
রাতেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না অনিমা। হৃদয় বলছে, “যাও অনিমা, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছে অনিক, তুমি ওকে বাঁচিয়ে তোল’। কিন্তু মাথা বলছে, “না, যেয়ো না, ওরা অহংকারী, হৃদয়হীন, তোমার ভালোবাসাকে অপমান করেছে’। ভালোবাসা আর আত্মমর্যাদার যে যুদ্ধ, তাই-ই বুকের মধ্যে রক্ত ঝরাচ্ছে তার। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কফিটা খাওয়ায় একটু ভালো লাগছে অনিমার। একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে নিলো সে। লাইট অফ করে অনিকের চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো অনিমা।
আরও পড়ুন গল্প স্বপ্ন জল
সাধারণত সাড়ে ছয়/সাতটায় উঠে পড়ে অনিমা, আজ যখন সে উঠলো তখন আটটা বেজে গেছে। ঘুমের বড়ি খেয়েও ভালো ঘুম হয়নি রাতে, ঝিমুনি আছে কিন্তু ঘুম নেই। ভেতরের যে টানপোড়েন সেটাই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। শরীরটা ভালো লাগছে না তার। ভার্সিটিতেও যেতে ইচ্ছে করছে না। ফোন করে না যাবার কথা জানিয়ে দিলো সে। হালকা ব্রেকফাস্ট করে কফির মগ হাতে নিজের ঘরে ফিরে এলো অনিমা। সারাদিন এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে কাটলো তার। এ অস্থিরতা অনিকের জন্য, অনিকের দীর্ঘ অসুস্থতার জন্য। কেমন আছে অনিক? এতোদিনেও কেন সে সুস্থ হয়নি? সে কি খুব বেশি অসুস্থ? ওর জন্য তার ভেতরে এতো তোলপাড় কেন? বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো অনিমা।
বিকেলে মি. চৌধুরী আসলেন, সঙ্গে তার মিসেস। সেই অহংকারী মহিলা, যিনি সেদিন তাদের ভালোবাসাকে আভিজাত্যের দুই পায়ে পিষ্ট করেছিলেন। আজ তাঁর কণ্ঠে আকুতি ঝরে পড়ছে, অনুকম্পা প্রত্যাশী হয়ে করজোড়ে মিনতি করছেন, পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাইছেন। বলছেন, অনিমা ছাড়া বাঁচবে না অনিক। বাবা মায়ের এই অসহায়ত্ব তাকেও বিচলিত করছে। অনিককে সে ভালোবাসে নিজের চেয়েও। অনিক ছাড়া তার জীবনও অসম্পূর্ণ, অর্থহীন। এতোদিন অপেক্ষা তো তারই জন্য।
আরও পড়ুন গল্প পক্ষিরাজের ডানা
মিসেস চৌধুরী বললেন,“মা, আমি অনুতপ্ত, তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমাকে ক্ষমা করে তুমি অন্তত একবার অনিককে দেখে আসো। তারপর তোমার যা ইচ্ছে তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ো। প্লিজ মা, শুধু একবার’!
মিসেস চৌধুরীর চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। অনিমার বুকটাও ভারী হয়ে উঠছে। অনেক কষ্টে কান্না দমন করে সে বললো, ‘কাল বিকেলে আমি যাবো’।
‘মা আমি নিজে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। সোৎসাহে বললেন চৌধুরী। তার দরকার হবে না। আমি নিজেই যাবো’। উঠে দাঁড়ালো অনিমা।
চৌধুরী দম্পতি বুঝেছেন, আর কথা বাড়ানো অমূলক। তাঁরাও উঠে পড়লেন। যাবার সময় মিসেস চৌধুরী অনিমার হাত জড়িয়ে ধরে বারবার ক্ষমা চাইলেন। তাঁদের যাবার পর নিজ ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো অনিমা। তার চোখে অশ্রুর প্লাবন ।
পরদিন বিকেলে অনিকদের বাসায় গেলো অনিমা। চৌধুরী দম্পতি তার অপেক্ষাতেই ছিলেন। বিস্তর আপ্যায়নের আয়োজন করেছেন তাঁরা। অনিমা কফির কাপটা তুলে নিলো শুধু। কিছুক্ষণ সৌজন্য বিনিময়ের পর অনিকের কাছে যেতে চাইলো সে। মিসেস চৌধুরী নিয়ে গেলেন তাকে অনিকের ঘরে। অনিক জানতো অনিমা আসবে। অধীর অপেক্ষা তার। অনিককে দেখে থমকে দাঁড়ালো অনিমা। কোথায় তার অনিক? সেই সুদর্শন অনিকের কঙ্কাল দেখছে যেন সে। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো তার। মিসেস চৌধুরী আঁচলে চোখ মুছে বললেন, ‘তোমরা কথা বলো মা, আমি নিচে আছি’। বেড়িয়ে গেলেন তিনি।
আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা
অনিমাকে দেখেই উঠতে গেলো অনিক। বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। ছুটে গেলো অনিমা। খুব যত্ন করে খানিকটা তুলে পিঠের নিচে বালিশটা আড়াআড়ি করে দিয়ে দিলো। চেয়ার টেনে একেবারে অনিকের বুকের কাছে বসলো সে। চোখে জলের ধারা। শীর্ণ হাতে অনিমার হাতটা ধরলো অনিক। ম্লান কণ্ঠে বললো, “এতোদিন পরে এলে অনি?
‘হ্যাঁ অনিক, একটু দেরী হয়ে গেলো। পরিস্থিতিই দেরী করিয়ে দিয়েছে আমাকে। তবে তোমাকে কখনোই ছেড়ে যাইনি আমি। সারাক্ষণ তুমি ছিলে আমার প্রেরণা হয়ে’। কান্নাভেজা গলায় বললো অনিমা।
‘আমি জানি অনি। তুমি আসবে, সেই বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছি আমি। অনিকের ম্লান চোখে আলোর ঝিলিক।
‘অনিক, এই যে তোমার চিঠি। এটাই আমাকে শক্তি দিয়েছে। অনিকের লেখা চিঠিটি চোখের সামনে তুলো ধরল অনিমা। অবাক চোখে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে আছে অনিক। সেই কবে লিখেছিলো সে।
‘অনিক, তুমি উত্তর চেয়েছিলে, আমি তখন দিতে পারিনি। আজ আমি নিজেই এসেছি তোমার চিঠির উত্তর হয়ে। আবেগে সে জড়িয়ে ধরলো অনিককে। দু’জনের চোখের জল মিলেমিশে একাকার তখন।
আরও পড়ুন রোদেলা দুপুর কাঁদে-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
রোদেলা দুপুর কাঁদে (শেষ পর্ব)