রক্তে-জ্বলে-একাত্তর- ৫ম-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  মুক্তিযুদ্ধ,  সাহিত্য

রক্তে জ্বলে একাত্তর (৫ম পর্ব)

রক্তে জ্বলে একাত্তর (৫ম পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

রাত নয়টার মধ্যে ভোট গণনা শেষ। সবগুলো নির্বাচনী কেন্দ্রের ভোট যোগফলে রাশেদ বেসরকারি ভাবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। তৃতীয় স্থানে অবস্থান সরকারি দলের প্রার্থী শমসের সুলতান ওরফে শমু সুলতান। স্থানীয় নেতাদের কোন্দলের ফসল। এমপি সাহেব রাশেদকে নীরব সমর্থন দিয়েছেন। রাশেদের পরিবারের সঙ্গে এমপি সাহেবের বাবার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো, এখনো আছে। তাঁরা আজ কেউ জীবিত নেই। কিন্তু রেখে গেছেন সুসন্তান। আগামীকাল নতুন একটা সুর্য উঠবে, নতুন আলো নিয়ে। আর নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান নতুন পথ দেখাবে, এই ইউনিয়নের তরুণ সমাজকে।

সকাল নয়টার মধ্যেই রহিম মাস্টার তার স্কুলের উদ্দেশে বের হলেন। তার স্কুল ভোট কেন্দ্র ছিল। কি অবস্থায় আছে কে জানে, ভাবতে ভাবতে বাই-সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। পথের মধ্যেই দেখা হয়ে গেল সাহেব আলীর সঙ্গে। সাহেব আলীর বিমর্ষ চেহারায় এলোমেলো চুল। দেখেই মনে হচ্ছে কোন সংকটে পড়েছে। কিন্তু সে তো অতি সাধারণ ছাপোষা একজন নিরীহ মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে সুলতান পরিবারকে বিশ্বস্থতার সাথে সেবা করে যাচ্ছে। রহিম মাস্টার সাইকেল থামিয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়ালেন। সাহেব আলী কাছে আসতে,
── সাহেব আলী, তোমার চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন?
সাহেব আলী বেশ কিছু সময় নীরব থেকে বললো,
── মাস্টার চাচা, সুলতান পরিবারের ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
──মানে?
── মানে আবার কি? এতদিন মেঝ সুলতান আর তার মেঝ ছেলে নিজের তালুক মনে করে ভোগ-দখল করে রেখেছে। এখন বড় সুলতানের মেঝ ছেলে মাহি সুলতান ষোল আনা বুঝে নিতে চাইছেন।
── বল কি সাহেব আলী!
শুধু তাই নয় ভূমি অফিস হতে দশটার দিকে লোক আসবে। তাদের উপস্থিতিতে মিমাংসা করেই তবে ঢাকা যাবে। মনে হয় কোমর বেঁধে এবার বাড়িতে এসেছে। মাস্টার চাচা তাড়া আছে যাই।

আরও পড়ুন গল্প বিষফুল

কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে রহিম মাস্টার। মাথার ভেতরে কেমন চক্কর দিতে শুরু করেছে। হঠাৎ পঁত্রিশ বছর আগের ঘটনার কথা মনে পরে গেল তার। ঘটনা তো আর চাপা পড়ে থাকে না। কেন রাতের আঁধারে মাহিকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। সফল একজন গার্মেন্টস মালিক হয়ে গ্রামে ফিরেছে, তাও আবার নির্বাচন উপলক্ষে। সব যেন কাকতালীয় ব্যপার। অপেক্ষায় মেওয়া ফলে। সাহেব আলী তার হাতিয়ার।

সকাল হতে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে সাজ সাজ রব। মাঠের একপাশে একটা মঞ্চ তেরি করা হয়েছে। গতরাতেই কড়া নির্দেশ জারি করা হয়েছে, কেউ যেন কোন প্রকার আনন্দ মিছিল, এমন কি মিষ্টি বিতরণ হতে বিরত থাকে। সবাই এক সঙ্গে আনন্দ মিছিল করবে। তাই সবাইকে স্কুল মাঠে সমবেত হওয়ার আহবান জানানো হয়েছে। এখানে নাকি রাশেদের মা এলাকাবাসির কাছে কি যেন আর্জি জানাবেন। ইতোমধ্যে লোকজন মাঠে আসা শুরু করেছে। আধা ঘন্টার মধ্যে মাঠ ভর্তি হয়ে গেল। রাশেদ আর তার মা কিছুক্ষণ আগে এসে অধ্যক্ষ স্যারের রুমে অবস্থান করছে। রাশেদ এই কলেজের শিক্ষক। সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।

রহিম মাস্টার যথাসময় এসেছেন। সাহেব আলীকে খোঁজার চেষ্টা করছেন। আবার ভাবছেন সুলতান বাড়ির গৃহকর্মী এখানে কেন আসবে। মনের কথা মনে থাকতেই সাহেব আলীকে দেখা গেলো শমসের সুলতানের সাথে। যাক, সুমতি হয়েছে। এবার বাছা ধনের সোজা পথে হাঁটতে হবে। রহিম মাস্টার ভিড় ঠেলে সাহেব আলীর কাছে দাঁড়াতেই দু’জনের চোখাচোখি হলো। সাহেব আলী বুঝতে পারছে মাস্টার চাচা তার জন্য অপেক্ষা করছে। শমু সুলতানকে বসার ব্যবস্থা করে অন্যত্র চলে গেল। মাস্টার তার অনুসরণ করে মাঠের নির্জন একটা জায়গা এসে দু’জনে দাঁড়িয়ে ডানে-বামে দেখে নিলো।
── মাস্টার চাচা, সুলতান পরিবার দুখন্ড হয়ে গেল। বাড়ির ভাগ মাহি ছেড়ে দিয়েছে। মাঠের জমি এককানিও ছাড়বে না। এই যে স্কুলের পিছনে তাদের বিশাল জমি রয়েছে, এটা মাহির মায়ের নামে। এতদিন যা শুনে আসছি, তা সবই মিথ্যে। সব পাকা করে রেখে যাচ্ছে। আবার এসে সব ফাইনাল বন্দোবস্ত করে যাবে। তবে এতদিন পর একটা কথা বুঝলাম।

আরও পড়ুন ওরা তেরোজন

── কি কথা?
মাহি তার চাচাকে বললো, আপনি আমার বাবাকে আসল ঘটনা না বলে রাতের আঁধারে আমাকে বাড়ি হতে বের করে দিয়েছিলেন। আপনার মনের ভেতরে এত বড় দূরভিসন্ধি ছিলো তা আপনার বড় ভাই বুঝতে পারেননি। তাই আপনাকে সম্মান করা আমার পক্ষে অসম্ভব। শেষ বয়সে এসে এলাকার লোকের সাথে আবার বিশ্বাসঘাতকতা করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু জনগণ তা হতে দেয়নি। তারা একজন ভাল এবং সুযোগ্য নেতা খুঁজে পেয়েছে।
── এত কথা বলেছে? মাহি এখন কোথায়?
দেখলাম ঢাকায় রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাশেদা বুবুর মা’র বাড়িতে গতকাল হতে খাওয়া-দাওয়া করছে।

কথা শেষ না হতে একটা গাড়ি এসে থামলো কলেজ গেটের সামনে। গাড়ি হতে নামলো মাহি সুলতান। নেমে সোজা অধ্যক্ষ স্যারের রুমে ঢুকেই দেখতে পেলো একজন মহিলা বসে আছে। মহিলা ব্যতিত অন্য কোন লোক নেই। আর এই মহিলা হলেন রাশেদা খাতুন, এই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। আর এই কলেজের অধ্যক্ষ সাহেব তার শ্বশুর পক্ষের ঘনিষ্ট আত্মীয়। তার কাছ হতে অনুমতি নিয়ে আজকের আয়োজন। রাশেদা খাতুন গভীর মনোযোগ সহকারে কি যেন পড়ছিল।
── প্লিজ, আসতে পারি?
মিসেস রাশেদা একজন পুরুষ কণ্ঠ শুনে একটু ঘাড় বাঁকা করে তাকিয়ে দেখলো একজন অপরিচিত ভদ্রলোক। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে কোন অভিজাত ঘরের ধনী সন্তান। মিসেস রাশেদা উঠে দাঁড়িয়ে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বললো,
── আসুন, তবে স্যারকে তো আজকে পাওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন অন্তর্জাল ও মৃত্যু

আগন্তুক ভদ্র লোকের চোখের দিকে সরাসরি তাকাতেই, একটা বিদ্যুৎ ঝলকে সারা শরীর উত্তেজিত হয়ে উঠলো মিসেস রাশেদার। সে কি দেখছে! দুই ভ্রুর মাঝখানে সেই কাটাদাগ এখনো মিশে যায়নি। ছোট দাগটি এখনো স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল। স্মৃতির ডগায় ভেসে উঠে কিশোরী বয়সে ফেলা আসা একটা ঘটনার কথা । তার বয়স আর কত হবে, এসএসসি পরীক্ষার্থী। এ বয়সে মেয়েদের মন-শরীরে অনুভূতি ছেলেদের চেয়ে একটু বেশি। যৌবনের চিহ্ন জায়গাগুলো উঁকি মেরে তাকাতে চাইছে। সবেমাত্র শরীরে যৌবনের ঢেউ লেগেছে। আর মাহি সুলতান কলেজের ছাত্র। ছোট বয়স হতে তারা এক সঙ্গে খেলাধুলা করেছে। বছরে একবার মাহির তার বাবা-মা এবং ভাই-বোনদের সাথে গ্রামের বাড়িতে এসে কিছু দিন কাটিয়ে যেতো।

রাশেদা মাহিদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ছোট বয়সে তার বাবা মারা যাওয়ার পর বিধবা মা তার দুই সন্তানসহ বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সুলতান বাড়ির বেশ ক’টা বাড়ির পর রাশেদার নানা বাড়ি। মধ্যবিত্ত পরিবার রাশেদার নানার। তবে সুলতান পরিবারের সাথে রক্তের সম্পর্কে আছে বলে রাশেদার মামা-খালারা বেশ গর্ব করে প্রচার করে থাকে। কিন্তু সম্পর্কের ভাটা পড়ে রাশেদাকে নিয়ে। আজ অব্দি তা চলে আসছে। খোন্দকার বংশের মেয়ে রাশেদা। সরকারি ভাল পদে চাকরি করতেন রাশেদার বাবা। অকালে তার মৃত্যু হয়। রাশেদার বড় ভাই খোন্দকার সাহেদ রহমান তার বাবার আদর্শে মানুষ হয়েছে। কিন্তু তার মা বিধবা অবস্থায় শ্বশুর বাড়িতে থাকাটা আত্মসম্মানে লাগে, তাই মেয়েকে নিয়ে বাবার কাছে চলে আসে। কিন্তু একমাত্র ছেলে সাহেদ তার দাদার আশ্রয়ে লেখাপড়া শেষ করে শহরে ভাল চাকরি করে। নানা বাড়ির সাথে তার সম্পর্কটা শীতল। বিশেষ করে সুলতান পরিবারের অহংকার মনোভাব তার কাছে পীড়াদায়ক। তবে মা-ছোট বোনকে অবহেলা করে না। নিয়মিত কর্তব্য পালন করে আসছে।

আরও পড়ুন গল্প খোয়ার

মাহির সাথে রাশেদার আস্তে আস্তে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটা রাশেদার মা ভাল করে জানতো। সুলতান পরিবারের বড় সুলতান সপরিবারের গ্রামের বাড়ি আগমন হলে রাশেদার মা-র কদর বেড়ে যেত। রান্না-বান্নায় সে ছিলো পটু। তাছাড়া বড় গিন্নী ছোটবেলা থেকে তাকে স্নেহ করতেন। আবার রাশেদার বাবা বড় গিন্নীর সম্পর্কে ঘনিষ্ট আত্মীয়। রাশেদার মা ছোটবেলা হতে নিজেদের বুনিয়াদী আভিজাত শ্রেণির পরিবারের মেয়ে বলে শ্বশুর বাড়ি এমন কি স্বামীর সাথে মাঝে মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করতো। রাশেদার বাবা ছিলেন শান্ত স্বভাবের ভদ্রলোক। রাশেদা অনেকটাই মার স্বভাব পেয়েছিল। কিন্ত মানুষের স্বভাব বদলায় যখন সে বাস্তবের সাথে মোকাবেলা করে। রাশেদার জীবনে সেটাই ঘটেছিল আজ হতে পঁত্রিশ বছর আগে। একদিনের জন্যও ভুলে যায়নি রাশেদা। মিথ্যে অপবাদ নিয়ে সুলতান বাড়ি হতে মাসহ তাকে চিরদিনের জন্য বের হতে হয়েছিল। ভাবতে ভাবতে তার শরীরের ভেতর তোলপাড় করছে। মাহিকে বসতে বলবে কি-না বুঝে উঠতে পারছে না।

আরও পড়ুন রক্তে জ্বলে একাত্তর-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

রক্তে জ্বলে একাত্তর (৫ম পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!