রক্তে জ্বলে একাত্তর (৪র্থ পর্ব)
রক্তে জ্বলে একাত্তর (৪র্থ পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
রাত আস্তে আস্তে গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে আর দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোটের শেষ অংক হিসেব কষে চলেছে। খান্দানি সুলতান পরিবার চায় ক্ষমতাসীনদের কাঁধে ভর দিয়ে আবার সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। আর অন্য দিকে একজন শিক্ষিত যুবক চায় একজন সৎ নিবেদিত এ প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে দেশের সঠিক নেতৃত্ব দিতে। মাথায় শত চিন্তা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে রাশেদ। ভোরে উঠতে হবে। আগামীকালের ভোটযুদ্ধে তাকে জিতে হবে, তবে নির্বাচনের মাধ্যমে। ভোট কারচুপি কাউকে করতে দেয়া হবে না।
সকাল ৮টা হতে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলবে। সব কেন্দ্রে সাহসী নির্লোভ পুলিং এজেন্ট দেয়া হয়েছে। আর ভোটারা যাতে নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্র যেতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষ করে মহিলা ভোটারদের জন্য। ভোর হতেই সবাই কাজে লেগেছে। রাশেদের মা আর তার স্ত্রী বিশেষভাবে তদারকি করছে। আর সঙ্গে আছে তাদের একদল ছাত্র-ছাত্রী যারা এখন নবীন ভোটার। এবারে নতুন ভোটারদের প্রতিজ্ঞা একটা, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন হোক।
সকাল ১০-১১ টা পর্যন্ত ভোটারের উপস্থিত খুব একটা বেশি মনে হচ্ছে না। তবে মহিলা ভোটারের সংখ্যা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রাম অঞ্চলে পুরুষ মানুষ কাজ-কর্ম শেষ করে দুপুরের পরে সাধারণত এসে থাকে। বাস্তবে তাই ঘটতে শুরু করলো। দুপুর একটার পর হতে ভোটার বাড়তে শুরু হয়েছে। আইন শৃংখলা বাহিনী সর্তকের সাথে টহল দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া আছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। একই দিনে অনেক ইউনিয়ন পরিষদে নিবার্চন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাই কর্তৃপক্ষ ব্যস্ত আছেন। তবে রাশেদের ইউনিয়নে একটু বেশি নজদারিতে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন গল্প একটি মিষ্টি স্বপ্ন
ভোট শেষ হতে আর মাত্র ঘন্টাখানেক বাকি। বাজারে চলছে ভোটের হিসেব। শামসুর চায়ের দোকান সকাল হতে খোলা। আশেপাশে আর তিন-চারটি চায়ের দোকান আছে। লোকের ভিড় একটু বেশি। যারা বাম হাতে কিছু পেয়েছে তাদের সঙ্গীসহ চা-সিগারেট ফুঁকছে আর কে জিতবে তা নিয়ে নানান যোগ-বিয়োগ কষে যাচ্ছে। বেলা সাড়ে তিনটের দিকে শাহিন তার কজন চেলাসহ শামসুর দোকানে এসে বসলো। মুখটা শুকনো। কেমন যেন পানি ছাড়া পুঁটি মাছের মত, নড়ন-চড়ন নেই। মুখে চোখে দুর্চিন্তার ছাপ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রহিম মাস্টার শাহীনকে লক্ষ্য করে বললো,
── শাহিন, কি বুঝতে পারছো? শমু সুলতান পাস করবে তো?
── মাস্টার চাচা, ভোটের চেহারা দুপুরের পর হতে বদলে গ্যাছে।
── বুঝলাম না তোমার কথা।
ঠিকই তাই। দলের ভোট দলের লোকই পাবে, উড়ে এসে জুড়ে বসে মার্কা পাওয়া যায়, ভোট পাওয়া যায় না।
── তয় তোমরা তো সাপোট দিয়েছিলে।
── কি আর করবো? এককালে আমাদের সাথেই ছিল, তাই আর কি।
মনে মনে হাসে রহিম মাস্টার আর ভাবে সারা দেশে তোমরা হাইব্রিড হয়ে কুকর্ম করছো, এটা সরকারি দল পড়ে টের পাবে।
── তাহলে কি রাশেদ জিততে চলছে?
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে শাহিন বললো,
── পরিস্থিতি তাই বলছে।
── তাতে তোমার কি? মাঝখানে কিছু কামিয়ে নিলে।
শাহিন কোন প্রতিবাদ না করে শামসুকে চা দিতে বলে পকেট হতে নতুন সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। তখন বিকেল চারটে বাজে। ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে মাত্র। কিছুক্ষণের মধ্যে ভোট গণনা শুরু হবে। চারিদিকে টানটান উত্তেজনা। সুলতান পরিবারে চলছে আয়োজন। গরু-খাসী প্রস্তুত শুধু ফলাফলের অপেক্ষায়। মেজ সুলতান শেষ বয়সে জয়ে স্বপ্ন দেখছে আর নতুন কোন ফন্দি আঁটছে মনে মনে। লোকে বলে, ‘ময়লা যায় না ধুলে, খাজলত যায় না মরলে’ কথাটা এই বুড়ো সুলতানের বেলায় সঠিক।
আরও পড়ুন গল্প আড়ালের চোখ
ইতোমধ্যে লোকজন বাজারে আসতে শুরু করে দিয়েছে। আর সাথে সাথে ভাসছে নানান গুজব। কড়া পাহারায় ভোট গণনা চলছে। প্রায় সাড়ে পাঁচটার দিকে বাছেদ শিকদার এসে জানালো, তিন সেন্টারের ভোটের ফলাফল সে জেনেছে। দুটোতে রাশেদ আর একটা শমু সুলতান জিতেছে, তাও আবার বার ভোটে।
বাজারে শমু সুলতানের সমর্থকদের চেহারা হঠাৎ বেলুনের মত ফুস করে চুপসে গেলো। শাহিন মূহুর্ত্বের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল। ব্যাপারটা কেমন যেন ধু্ঁয়াশা মনে হচ্ছে। এত টাকা খরচ করে সরকার সমর্থক দলের নেতা, তারপর চেয়ারম্যান প্রার্থী। কোথায় যেন লবন-চিনির গোলমাল আছে।
একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন রহিম মাস্টার। এমন সময় সাহেব আলী এসে হাজির। সুলতান পরিবারের বিশ্বাসী কর্মচারী সাহেব আলী। প্রায় দশ-বার বছর যাবৎ এ বাড়িতে কাজকর্ম দেখাশুনা করে আসছে। রহিম মাস্টার লক্ষ্য করলেন সাহেবের মনটা ভার। রহিম মাস্টার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির লোক। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। এলাকায় তাদের একটা আলাদা পরিচয় আছে। রাশেদের পরিবারের সাথে আত্মীয়তা সূত্রে সম্পর্ক। একটা কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। সাহেব আলীর বড় ছেলে মালেক আবার মাস্টারের স্কুলের ছাত্র। তাই সেই হিসেবে সম্পর্কটা খারাপ নয়। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কাছে ডেকে পাশে বসতে বলে সামসুকে এককাপ চা দিতে বললেন। খুশিতে গদো গদো হয়ে উঠলো সাহেব আলী। মাস্টার সাহেব বুঝে নিলেন ঔষধ ধরেছে।
── তা সাহেব আলী, মনটা ভার কেন? ভোটে তো জিতে যাচ্ছো।
বিস্ময় ভরা চোখে মাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
── মাস্টার ভাই, আমি ভোটের কথা চিন্তা করছি না।
── তবে কি নিয়ে চিন্তা করছো?
এবার সাহেব আলী মুখটা মাস্টার সাহেবের কানের কাছে নিয়ে বলল,
── গতরাতে মাহি সুলতান আর তার মেঝ চাচার মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে তর্ক বিতর্ক হয়েছে।
── বলো কি?
──হ তাই। মাহি সাহেব তাদের সম্পত্তি বুঝে দিতে তার চাচাকে বলেছে। শুধু তাই নয় এর জন্য সে আর দুদিন থাকবে। মাহি সাহেব এবার পাকাপোক্ত হয়ে এসেছে। আর কতকাল বাবার সম্পদ অন্য ভোগ করবে।
── চিন্তার কথা তো সাহেব আলী।
আরও পড়ুন গল্প হলেও সত্য
সাহেব আলী আর কোন কথা না বলে, চা খেয়ে কাপটা রেখে উঠে গেল। রহিম মাস্টার আবার সরল অঙ্ক কষতে বসে গেলেন। এবার নির্বাচনের হারজিত জিনিসটা তার মাথায় নেই। সুলতান পরিবারের নাটকের শেষ দৃশ্য দেখার অপেক্ষায়।
অনেক আগেই সন্ধ্যা হয়েছে। ছোট-বড় দোকানে বিদ্যুৎ আলোয় আলোকিত। জনগণের মুখে যা শোনা যাচ্ছে তাতে তরুণ রাশেদ অনেক ভোটে এগিয়ে আছে। কোথাও কোথাও কম-বেশি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে। রহিম মাস্টার বেশি দেরি না করে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। তিনটি গ্রাম পর রাশেদের গ্রাম। রাশেদের সাথে তাদের রক্তের সম্পর্ক আছে। সেও চায় শিক্ষিত এবং সৎ ছেলে হিসেবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আসুক। রহিম মাস্টার আর সুলতান পরিবার একই গ্রামে, তবে এপাড়া ওপাড়া। দুই পরিবাবের মধ্যে সে রকম কোন ঘনিষ্ঠতা নেই আবার শত্রুতাও নেই। তবে একাত্তরের কিছু কার্যকলাপ নিয়ে সম্পর্কটা শীতল।
দীর্ঘ পঁত্রিশ বছর পর বড় সুলতানের মেঝ ছেলে মাহি সুলতান কি শুধু তার সমবয়সী চাচাতো ভাইকে ভোটে জেতানোর জন্য গ্রামে এসেছে, না-কি পারিবারিক হিসেব-নিকেষ করতে এসেছে। বড় সুলতান মারা যাওয়ার পর তার ছেলে-মেয়েরা গ্রামমুখী হয়নি। এক মাহি ছাড়া অন্যরা বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে। কদাচিৎ বাংলাদেশে আসলে ঢাকায় তাদের বুনিয়াদী ধানমন্ডি বাসায় উঠে। রহিম মাস্টারের মাথার ভেতরে গাজনা বিলের আশ্বিনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যদিও এ সব নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু আজ এমন হচ্ছে কেন? শমু সুলতান প্রায় বলে বেড়াত সুলতান পরিবারের সকল স্থাবর সম্পত্তির মালিক তার বাবার। অপেক্ষায় সবুর মিলবে। আগামীকাল সকাল অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। এটা পারিবারিক ভোট যুদ্ধ। রাজনীতি শুধু মাঠে ময়দানে হয় না ঘর-সংসারে গড়ায়। মাঠের রাজনীতি চোখে পড়ে আর পারিবারিক রাজনীতি চলে অন্দর মহলে।
আরও পড়ুন রক্তে জ্বলে একাত্তর-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
রক্তে জ্বলে একাত্তর (৪র্থ পর্ব)