রক্তে-জ্বলে-একাত্তর-৩য়-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

রক্তে জ্বলে একাত্তর (৩য় পর্ব)

রক্তে জ্বলে একাত্তর (৩য় পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

গ্রামের বয়স্ক ছামাদ শেখ এসে শামসুর চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। কেটলির পানি টগবগ করে ফুঁটছে আর ফুঁটুন্ত পানি বাষ্প হয়ে কেটলির নল দিয়ে বের হয়ে, সামনে বসা বাবুল সরদারের মুখে লাগছে। বাবুল সরদারের মনের ভেতরে কেমন যেন তাপ অনুভব করছে। এটা কিসের অনভূতি বুঝে উঠতে পারছে না। ভাবছে আজকের সকালটা কেমন যাবে। ছামাদ শেখ চারদিকে তাকিয়ে বাবুল সরদারের পাশে গিয়ে বসলো। যদিও বাবুল সরদার বয়সে বেশ ছোট। কিন্তু ছেলেটা সব খবর রাখে।
─ বাবুল, বড় সুলতানের মেজ ছেলে নাকি বাড়ি আয়ছে?
─ হ। হুনচি। তাকে তো কোনদিন চামড়ার চোহে দেহিনি। শুধু নামই হুনছি। আপনি তারে কহুনো দেখছেন?
─-বয়সে আমার চেয়ে বছর পাঁচেক ছোট হবে। এখন দেখতে ক্যামন অয়চে কে জানে। হুনলাম বাক্সো ভরে টাকা আনছে ভোট কেনার জন্য।
─ চাচা, মনে হয় হাওয়া দক্ষিণ দিকে বইতে শুরু করছে।
─-কেন, সরকার দলের মার্কার কি হবে?
─ এখানেই তো কিন্তু। পুরাতন প্রতিশোধ চাচা। রাশেদ সাহেব মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের শিক্ষিত পোলা। আর হের মা প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার। খেলা তো চলবেই।

আরও পড়ুন গল্প কাঠগোলাপ ও প্রেম

সকালের বাজার বেশ জমে উঠেছে। শামসুর চায়ের দোকানের সামনে আস্তে আস্তে জনগণের ভীড় বেড়ে চলেছে। এই বাজারটি বলতে গেলে ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যবর্তী স্থানে। নিত্যদিন নতুন নতুন মানুষের দেখা মেলে। আর শামসুর চায়ের দোকানটা পজিশন মত জায়গা এবং লোক হিসেবে স্বজন কথা কম বলে। হঠাৎ এলাকার জনসেবক কর্মী প্রধান শাহিন মন্ডল উপস্থিত হলো তার দলবলসহ। নিজেকে জনসেবক হিসেবে প্রচার করে থাকে। তাকে দেখে আশ্বাস্ত হলো চায়ের দোকানের সামনে বসা লোকজন। সুলতান বাড়ির মেজ ছেলের খোঁজ-খবর পাওয়া যেতে পারে। শাহিন আবার সরকারের ঘোর বিরোধী দলের স্থানীয় পর্যায়ের উদায়নমান নেতা। প্রতিদিন ফেসবুকে তার কর্মকান্ডের ফিরিস্তি থাকে। এখন শমু সুলতানের আন্ডারগ্রান্ড কর্মী।
এসেই বেঞ্চের শেষ প্রান্তে বসে চায়ের অর্ডার দিলো। বাবুলের সাথে একটু ভাব আছে, যদিও বিপরীত মেরুর মানুষ দুজনই।
─ শাহিন, তুমি তো সুলতান সাহেবের বাড়িতে আসা যাওয়া করছো। তা মেঝ সাহেবের খবর কি?
শাহিন গরম চায়ের গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক নজর তাকিয়ে শামসুকে আরো কড়া করে গ্লাসটা ভরে দিতো বললো।
─ দাঁড়াও আগে চা খেয়ে নেই। বলবো বলেই তো বসলাম।
শাহিনের কথা শুনে আশেপাশের সবাই নড়েচড়ে বসলো। শামসু চলদি করে কড়া চা বানিয়ে শাহিনের হাতে দিলো। শাহিন আয়েশে কালো দুটো ঠোঁট কাঁচের গ্লাসে আলতোভাবে লাগিয়ে, চু শব্দ করে চুমুক দিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,
─ ভোটের ফলাফল পেয়ে গেছি। কথা যখন দিয়েছি, কথা রাখবো। তবে ভোটের কথা থাক। মেঝ সুলতান মাহির কথা বলি, তা মন দিয়ে শোন। ঢাকা হতে বাড়ি পর্যন্ত শমু সুলতানের বড় ছেলে সারাক্ষণের সঙ্গী ছিলো। সে আবার মাহি সাহেবের ফ্যাক্টরীতে চাকরি করে। জানো তো আমরা এক সাথে এসএসসি পাস করেছি, তাই বেশ ভাল বন্ধুত্ব আছে। বিস্তারিত তার মুখেই শোনা।

আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

মাহি সুলতান পঁত্রিশ বছর পর পৈতৃক বাড়িতে পা রাখবে। ভাবখানা এমন গ্রামের চাষাভুষা তাকে দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। মাথার ভেতরে হরেক রকম চিন্তা নিয়ে, দামী পাজোরা গাড়িতে চড়ে ঢাকা ত্যাগ করেছে মাহি সুলতান। সাথে চাচাতো ভাই শমুর বড় ছেলে গাইড বনাম বডি গার্ড হিসেবে আছে। আর ড্রাইভার আলম তো আছেই।

ঠিক দুপুর বারোটার দিকে তাদের ইউনিয়নের সীমানায় গাড়ি ঢুকতেই সামনের সীটে বসা ভাতিজা শামিম সুলতান বললো,
─ চাচা, আমরা এখন আমাদের ইউনিয়নের সীমানায় ঢুকে পড়েছি।
─-তাই না-কি?
─ জী।

মাহি দুচোখ মিলে দেখছে চারিদিকের দৃশ্য। পঁত্রিশ বছর আগে যা দেখেছিল, এখন সেই দৃশ্য আমুল পরিবর্তন হয়েছে। রাস্তার দুধারে পাকা-আধাপাকা ঘড়-বাড়ি। নতুন নতুন রাস্তা আর বাজার। সব রকমের যানবাহন চলাচল করছে। ভাবছে এত উন্নতি হয়েছে গ্রামাঞ্চল! পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ কোনটাই কমতি নেই। চোখে পড়ছে স্কুল-কলেজ আর ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন রঙের পোশাকে পরে চলাফেরা। প্রায় আধা ঘন্টার মধ্যে নিজ গ্রামের সীমানায় ঢুকেছে মাহির নতুন কেনা পাজোরা গাড়ি। এলাকা সম্পর্কে শামিম তার চাচাকে আগেই বলেছে। মাহি কৌতুহল এবং অবিশ্বাস্য চোখে নিজের গ্রামকে অবলোকন করছে। এতটা পরিবর্তন হয়েছে! গ্রামে পাকা রাস্তা আবার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আছে। বাজার পেরিয়ে পৈতৃক বসতবাড়ির আঙ্গিনায় গাড়ি এসে থামলো। মনের ভেতরে কাঁচ ভাঙ্গা একটা শব্দ হলো।

আরও পড়ুন গল্প পরাভূত

পঁত্রিশ বছর আগে এক রাতের অন্ধকারে শমু সুলতানের হাত ধরে সুলতান পরিবাবের ঐতিহাসিক বাড়ি হতে চোরের মত পালাতে হয়েছিল। এর পিছনে ছোট চাচার চক্রান্ত ছিলো। আজ আবার তার অনুরোধে আসতে হলো। গাড়িতে বসে বসে ভাবছে, তার চাচাতো ভাই শমসের সুলতান কিভাবে সরকারি দলের নেতা হয়েছে। আবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছে। সব ঘটনা শমুর বড় ছেলে শামীমের পেট হতে বের করে নিয়েছে। শামিম তারই ফ্যাক্টরীতে ভাল বেতনে চাকরি করে। চাচার কাছে একটু ভাল মানুষ সাজতে বাপের ছলাকলার কূট কৌশল, মাহি চৌধুরীর কানে ঢেলে দিয়েছে। উপরে ওঠার জন্য কারো মাথায় তো পা রাখতেই হয়, ইতিহাস তাই বলে। বুদ্ধিমান মাহি সুলতান বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছে।

বাড়ির ছেলে এসেছে সবাই খুশি। আয়োজনের কমতি নেই। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম। আগামীকাল সকাল ৮টা হতে ভোট আরম্ভ হবে। নির্বাচনী প্রচারণী বন্ধ। ভেতরে ভেতরে চলেছে প্রচার। শমসের সুলতানের মনে ভেতরে একটা সুপ্ত বাসনা বিকেলে মাহিকে নিয়ে গ্রামটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবে আর দোয়া চাইবে। কিন্তু শমসের সুলতানের আশায় গরম ঘি ঢেলে দিলো থানার এস আই বিমল দত্ত। এসআই বিমল দত্ত এই এলাকার সবার পেটের খবর রাখে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। বয়স ত্রিশের কোঠায়। মানানসই চেহারা। সৎ এবং পরিশ্রমী। বিমল দত্তকে দেখে শমু সুলতান বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। সামনের পাটির চারটি উচু দাঁত বের করে একগাল হাসি এবং আদাব দিয়ে তাদের বুনিয়াদী বৈঠাকখানায় নিয়ে বসালো। এস আই বিমল দত্ত একটা সোফায় বসে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন।
─ আপনাদের নতুন অতিথির সাথে পরিচিত হতে এলাম।
─ অতিথি কি স্যার? এ বাড়ির বড় চাচার মেঝ ছেলে। ঢাকায় মস্ত গার্মেন্টসের মালিক।
─ জানি শমসের সাহেব।

আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একজন মধ্যম বয়সী সুদর্শন ব্যক্তি বৈঠাকখানায় ঢুকে হাত তুলে আদাব দিয়ে সামনে সিঙ্গেল একটা সোফায় বসলো। বিমল দত্তের চোখ এড়ায়নি ভদ্র লোকের গায়ে দামী কারুকার্যে পাঞ্জাবী এবং পরিধানে সাদা পাজামা আর পায়ে দামী স্যান্ডেল।
─ বলুন, এস আই সাহেব আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি।
─ না, না। আপনার সাহায্যের কোন প্রয়োজন হবে না। বড় বাবুর নির্দেশে এসেছি আপনার সাথে দেখা করতে।
এস আই এর কথাগুলো শুনে মাহি সুলতান ভেতরে ভেতরে পুলকিত হলো আর শমসের সুলতান আকাশের চাঁদ পেলো। ভাবছে কিভাবে সরকার দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করা যাবে, তার শলাপরামর্শ করতেই ওসি স্যার পাঠিয়েছেন।
─ দেখুন। আপনি এই বাড়ির ছেলে হলেও ভোটার নন এবং আপনার আসাটা উদ্দেশ্যমুলুক। আমাদের গোয়েন্দা তথ্য তাই বলে। সুতরাং আপনি আমাদের অতিথি। আজ বিকেল হতে আগামীকাল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বাড়িতেই আরাম করুন। আপনার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারণ আপনি একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি। আদাব। এবার চলি।
চৌকস এসআই বিমল দত্ত কোন সময় না দিয়ে বৈঠাকখানা হতে বের হয়ে, সোজা তার বাইকে উঠে সজোড়ে স্টার্ট দিয়ে উধাও হয়ে গেলো। বৈঠাকখানায় উপস্থিত সবাই গোলক ধাঁধায় পড়ে গেলো। বুদ্ধিমান এবং চতুর মাহি সুলতান যা বুঝার বুঝে নিয়েছে। এই সময়ে শমুর বিশেষ হায়ার করা কর্মী শাহিন উপস্থিত ছিল। তার মুখে বিস্তারিত ঘটনা সন্ধ্যাকালীন শামসুর চায়ের দোকানে উপস্থিত সবাই শুনে অবাক হয়ে যায়। শাহিন তো ঠিকই বলেছো।
─ তা বাবা শাহিন, তুমি তো আবার শমুর বেগার খাটছো।
─ না চাচা। কথা যখন দিয়েছি শ্যাষতক থাকব।

আরও পড়ুন গল্প তিল তাল

শাহিন চা শেষ করে গ্লাসটা রেখে চায়ের দাম পরিশোধ করে চলে গেল। সবাই কিছুটা নিশ্চুপ। ভোটের আবহাওয়া এত তাড়াতাড়ি পাল্টে যাবে কেউ ভাবতেই পারেনি। খবরটা রাশেদের কানে গিয়ে পোঁছেছে। সুযোগটা কাজে লাগানোর জন্য তার কর্মী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুরো রাত কাজ করতে হবে। এছাড়া প্রত্যেকটি কেন্দ্রে বাছাই করা পুরুষ-মহিলা এজেন্ট দিতে হবে। হাতে মাত্র আজকের রাত। শমু সুলতানকে অর্থের বিনিময়ে নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী করা হয়েছে, তা সবার কাছে পরিস্কার। এছাড়া দলের কতিপয় লোভী কর্মীকে অর্থ দিয়ে কাজে লাগিয়েছে। আবার অন্য দিকে রাজনীতি চাল তো একটা আছেই। রাজনীতি মানেই কূটকৌশল। বিরোধী দল স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। তবে অনেক জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে প্রতিদ্বন্দিতা করছে। এটা একটা রাজনৈতিক চাল।

এখানে ভুল প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তাই সজাগ থাকতে হবে। শুধু প্রশাসন নিরপেক্ষতা বজায় রাখলে আর কোন চিন্তা নেই। সৈয়দ রাশেদ হাসান উপজেলা পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক এবং একটা বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। এই ইউনিয়নে রয়েছে তার অসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী। তারা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় পরিচয় সে একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান।

আরও পড়ুন রক্তে জ্বলে একাত্তর-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

রক্তে জ্বলে একাত্তর (৩য় পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!